বাসস
  ০৪ আগস্ট ২০২৫, ১৮:৫৪

গাজীপুরে একদফা দাবিতে রাস্তায় নেমে শহীদ হন তোফাজ্জল হোসেন

ফাইল ছবি

মুহাম্মদ হেদায়েত উল্লাহ

গাজীপুর, ৪ আগস্ট, ২০২৫ (বাসস) : ২৪ এর ৪ আগস্ট শেখ হাসিনার পদত্যাগের একদফা দাবিতে গাজীপুরে স্কুল, মাদ্রাসা, বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রী, পোশাক শ্রমিকসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মীরা রাস্তায় নেমে আসে। গাজীপুরের কালিয়াকৈর, শিববাড়ি মোড় ও শ্রীপুর মাওনা মহাসড়ক এলাকায় দফায় দফায় আওয়ামী লীগ ও পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষের ঘটনায় তোফাজ্জল হোসেন  (২২) নামে এক নির্মাণ শ্রমিক নিহত হন। শত শত মানুষ হন গুলিবিদ্ধ।

ঘটনার বর্ণনা দিয়ে কালিয়াকৈর এলাকার স্থানীয় বাসিন্দা ইউনুস আলী বাসসকে বলেন, ৪ আগস্ট গাজীপুরের কালিয়াকৈরে সকাল থেকে শিক্ষার্থীদের অসহযোগ আন্দোলন শুরু হলে বিভিন্ন পোশাক কারখানার শ্রমিকরা কারখানার ভেতরে বিক্ষোভ শুরু করেন। পরে মৌচাক, তেলিচালা ও কোনাবাড়ী এলাকার সব কারখানা ছুটি ঘোষণা করা হয়। কারখানা শ্রমিকরা বের হয়েই সরকারবিরোধী স্লোগান দিয়ে কালিয়াকৈর উপজেলার চন্দ্রার দিকে যেতে শুরু করেন। এসময় চন্দ্রা এলাকায় আওয়ামী লীগের লোকজন পুলিশ পাহারায় সশস্ত্র মহড়া দিচ্ছিলো। ফলে সামনে না গিয়ে শ্রমিকরা সফিপুর আনসার একাডেমির গেটে অবস্থান নিয়ে বিক্ষোভ শুরু করেন। 

শ্রমিকরা এ সময় ’একদফা এক দাবি, খুনি হাসিনা কবে যাবি’, ‘দিয়েছিতো রক্ত, আরো দিবো রক্ত’, ‘রক্তের বন্যায়, ভেসে যাবে অন্যায়’, ‘আমার ভাই কবরে, খুনি কেন বাহিরে’, ‘দফা এক দাবি এক, খুনি হাসিনার পদত্যাগ', ‘আমার ভাইয়ের রক্ত, বৃথা যেতে দিবো না’,  ইত্যাদি স্লোগান দিতে থাকে। একপর্যায়ে বেলা দেড়টার দিকে আনসার সদস্যরা বিক্ষোভকারীদের লক্ষ্য করে রাবার বুলেট ও শটগানের গুলি ছুড়ে। এসময়  আনসার ও আন্দোলনকারীদের মধ্যে ধাওয়া পাল্টা ধাওয়ার ঘটনা ঘটে। পরে বিপুলসংখ্যক আনসার সদস্য একযোগে রাবার বুলেট, সাউন্ড গ্রেনেড ও শটগানের গুলি ছুড়তে থাকলে গোটা এলাকা রণক্ষেত্রে পরিণত হয়। এতে আন্দোলনকারী, পথচারীসহ দুই শতাধিক লোক ছররা গুলিবিদ্ধ হয়ে আহত হন।

এদিকে গাজীপুরের শ্রীপুরে ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কের জৈনা বাজার নাসির গ্লাস ফ্যাক্টরি এলাকায় ছাত্রজনতা ও শ্রমিকদের বিক্ষোভ মিছিলে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা হামলা চালায়। এতে নেত্রকোনা জেলার কেন্দুয়া উপজেলার আব্দুর রশিদের ছেলে তোফাজ্জল হোসেন নিহত হন। এই ঘটনায় শ্রীপুর এলাকায় ছাত্রছাত্রীদের পাশাপাশি কারখানা শ্রমিকসহ হাজার হাজার সাধারণ মানুষ মহাসড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ করতে থাকে। ফলে এই সড়কে সকল প্রকার যান চলাচল বন্ধ হয়ে যায়।

টঙ্গীর গাজীপুরা, কলেজ গেট, গাজীপুর চান্দনা চৌরাস্তা ও শিববাড়ি এলাকাসহ টঙ্গী ও গাজীপুর শহর সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা নিয়ন্ত্রণে রাখার চেষ্টা করেন। এসময় পুলিশ পাহারায় আওয়ামী লীগ ও যুবলীগের নেতাকর্মীরা ছুরি, চাপাতি ও দেশীয় বিভিন্ন অস্ত্র হাতে মহাসড়ক ও অলিগলিতে মহড়া দিতে থাকে। সকাল ১০টার দিকে টঙ্গীর গাজীপুরা এলাকায় আওয়ামী লীগের অস্ত্রধারীদের হামলায় কয়েকজন মাদ্রাসা শিক্ষার্থী ও পোশাক শ্রমিক গুরুতর আহত হন। বেলা ১১টার সময় মুষলধারে উপেক্ষা করে গাজীপুর শিববাড়ি মোড়ে ঢাকা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (ডুয়েট) শিক্ষার্থীরা জড়ো হয়ে বিক্ষোভ করে। এসময় পূর্বদিক থেকে আসা আওয়ামী লীগের একটি সশস্ত্র মিছিল এসে ছাত্রদের ওপর হামলা চালালে চাপাতির কোপে আন্দোলনকারীদের বেশ কয়েকজন গুরুতর আহত হন।

টঙ্গী পূর্ব থানা বিএনপির যুগ্ম আহ্বায়ক বেনজির আমেদ বাসসকে বলেন, ৪ আগস্ট সরকার জাবেদ আহমেদ সুমনের নেতৃত্বে বিএনপির বিপুল সংখ্যক নেতাকর্মী গাজীপুর চান্দনা চৌরাস্তা এলাকায় বিক্ষোভ মিছিলে যোগ দেন। দুপুরের পর গাজীপুর কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় ও ভাওয়াল বদরে আলম কলেজের কয়েক হাজার শিক্ষার্থীর সঙ্গে বিএনপি, জামায়াত ও তাদের অঙ্গ সংগঠনের বিপুল সংখ্যক নেতাকর্মীরা একটি বিশাল বিক্ষোভ মিছিল নিয়ে চান্দনা চৌরাস্তায় পৌঁছলে পরিস্থিতি সম্পূর্ণ পাল্টে যায়। ছাত্রজনতার মিছিল দেখে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা মহাসড়ক ছেড়ে পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়। 

সকাল থেকে মারমুখী অবস্থানে থাকলেও দুপুরের পর পুলিশ, র‌্যাব ও বিজিবি সদস্যরা শান্তভাবে সড়কের দুই পাশে সতর্ক অবস্থান নেয়। দুপুরের পর ছাত্র-জনতার মিছিলে পর্যায়ক্রমে যোগ দিতে থাকে আশপাশের পোশাক কারখানার হাজার হাজার নারী শ্রমিক। বিপুল সংখ্যক নারী শ্রমিকও এই মিছিলে যোগ দেন। বিক্ষোভ মিছিলটি এসময় চান্দনা চৌরাস্তা থেকে বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইন্সটিটিউটের সামনে দিয়ে শিববাড়ি মোড় হয়ে গাজীপুর শহরের বিভিন্ন সড়ক প্রদক্ষিণ করে। দেশব্যাপী ছাত্রজনতার ওপর নির্বিচারে গুলি করে মানুষ হত্যার দায়ে খুনি শেখ হাসিনার পদত্যাগের এক দফা দাবিতে হাজার হাজার ছাত্র জনতার শ্লোগানে শ্লোগানে গোটা এলাকা প্রকম্পিত হয়ে ওঠে।

গাজীপুর মহানগর ইসলামী ছাত্র শিবিরের সভাপতি রেজাউল ইসলাম বাসসকে বলেন, ৩ আগস্ট একদফা আন্দোলনের ঘোষণার পরই হাসিনা সরকার আবার কারফিউ জারি করে। এই কঠিন পরিস্থিতিতে ইসলামী ছাত্রশিবির ঢাকা মহানগরকে ১২টি ভাগে ভাগ করে পরিকল্পনা গ্রহণ করে। গাজীপুর মহানগর শিবিরের অবস্থান কর্মসূচির দায়িত্ব পড়ে ঢাকা যমুনা ফিউচার পার্কের সামনে। কেন্দ্র থেকে আন্দোলন বেগবান করার দায়িত্ব বর্তায় তৎকালীন কেন্দ্রীয় প্রশিক্ষণ সম্পাদক আব্দুর রহিম, ঢাকা মহানগর উত্তর সভাপতি আনিছুর রহমান ও গাজীপুর মহানগর সেক্রেটারি রেজাউল ইসলামের ওপর। 

তিনি বাসসকে বলেন, ৪ আগস্ট ২০২৪ কারফিউয়ের মধ্যে আন্দোলন অব্যাহত রাখা ছিল এক বড় চ্যালেঞ্জ। গাজীপুর মহানগর ও ঢাকা মহানগর উত্তরের নির্ধারিত স্পট ছিল ঢাকা যমুনা ফিউচার পার্কের সামনে। 

ছাত্রশিবিরের তৎকালীন মহানগর সেক্রেটারির নেতৃত্বে মহানগর সকল জনশক্তি বিভিন্ন গ্রুপে বিভক্ত হয়ে যমুনা ফিউচার পার্কের উদ্দেশ্যে রওনা হই। পথে পথে পুলিশ, বিজিবি, র‌্যাব, ও সেনাবাহিনীর কড়া নজরদারি। রাস্তায় গাড়ি থামিয়ে আমাদের ফোন গুলো চেক করা হয়। আমরা আমাদের জনশক্তিদের পূর্বেই ঘোষণা দিয়ে দিই মোবাইলের সাংগঠনিক ডকুমেন্ট হাইড করে রাখার জন্য। বাটন ফোন নিয়ে যাওয়ার পরামর্শ দেই। টঙ্গীর আব্দুল্লাহপুর যাওয়ার পর পুলিশ গাড়ি থেকে আমাদের নামিয়ে দেয় এবং গাড়িগুলো ঢাকা প্রবেশ বন্ধ করে দেয়। এরপর রিকশা নিয়ে ও পায়ে হেঁটে আমরা এয়ারপোর্ট পর্যন্ত যাই। এয়ারপোর্টে পৌঁছার পর আমাদের কয়েকজন সহযোদ্ধাদের গ্রেফতার করে পুলিশ। গ্রেফতার হওয়া সত্ত্বেও আমাদের মনোবল ছিল প্রবল। আমাদের চোখে সারাদেশের শহীদদের রক্ত ছলছল করছিলো। আমরা সিদ্ধান্ত নিয়েছি আমাদের সবাইকে যদি গ্রেফতার হতে হয় তবুও আন্দোলন চালিয়ে যেতে হবে। হাসিনার পতন না হওয়া পর্যন্ত মাঠ ছাড়া যাবেনা। এটাই ছিল আমাদের প্রতিজ্ঞা।

সকাল ১১টায় আমরা শিবিরের কিছু সংখ্যক জনশক্তি নিয়ে মিছিল শুরু করি। শিবির সাহস করে আন্দোলন শুরু করায় সাধারণ মানুষ, স্কুলকলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররাও সাড়ে ১১টা থেকে ১২টার মধ্যে মিছিলে যুক্ত হতে থাকে। বিকাল ৩টায় কওমি মাদ্রাসার ছাত্ররাও বিশাল মিছিল নিয়ে রাস্তায় নামে। ছোট আকারে শুরু হওয়া এই মিছিল দ্রুতই হাজার হাজার মানুষের অংশগ্রহণে এক বিশাল সমাবেশে পরিণত হয়। যমুনা ফিউচার পার্ক এলাকা কানায় কানায় পূর্ণ হয়ে যায়। রাতের দিকে আওয়ামী লীগ ও প্রশাসনের হামলা হতে পারে তাই বিকাল ৫টায় মিছিলের সমাপ্তি ঘোষণা করা হয় এবং পরদিন ৫ আগস্ট সকাল ৯টায় সবাইকে একই স্থানে উপস্থিত হয়ে গণভবন অভিমুখে যাওয়ার ঘোষণা দেওয়া হয়।