শিরোনাম
মোহাম্মদ শাহাদাত হোসেন
ফেনী, ৪ আগস্ট, ২০২৫ (বাসস) : জেলায় এক বছর আগে ২০২৪ সালের গণঅভ্যুত্থানের এই দিনে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ডাকা অসহযোগ আন্দোলনের প্রথমদিনে ছিল ফেনী ছিল রণক্ষেত্র। সেদিন নিরস্ত্র ছাত্র জনতার উপর নির্বিচারে গুলি ছুঁড়ে হত্যাযজ্ঞ চালায় আওয়ামী লীগ, ছাত্রলীগ ও যুবলীগের ক্যাডাররা।
আন্দোলনের সময় মাঠে সক্রিয় গণমাধ্যম কর্মী শফিউল্লাহ রিপন জানান, “সেদিন বেলা সাড়ে ১১ টায় মহিপাল ফ্লাইওভারের নিচে জড়ো হয় হাজার হাজার ছাত্র-জনতা। দুপুর দেড়টার পর তখনকালীন ফেনী-২ (সদর) আসনের সংসদ সদস্য ও জেলা আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক নিজাম উদ্দিন হাজারীর নির্দেশে আওয়ামী লীগ ও সহযোগী সংগঠনের নেতাকর্মীরা মহিপালে এলোপাতাড়ি গুলি করে। তখন শত শত রাউন্ড গুলির শব্দে প্রকম্পিত হয় মহিপাল ও এর আশপাশের এলাকা। প্রথমে প্রতিরোধের চেষ্টা করা হলেও গুলির মুখে পিছিয়ে আসেন ছাত্র-জনতা।" এসময় গুলিবিদ্ধ হয়ে ৬ শিক্ষার্থী সহ ৮ জন প্রাণ হারান বলে তিনি উল্লেখ করেন।
ফেনী শহর ব্যবসায়ী সমিতির অন্যতম নেতা মুশফিকুর রহমান পিপুল জানান, “একসময়ের সন্ত্রাসের জনপদ হিসেবে খ্যাত ফেনীতে এমন হত্যাকাণ্ড অতীতের সকল বর্বরতাকে ছাড়িয়ে যায়। রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ড অতীতে হলেও এমন প্রাণহানি দেখেনি ফেনীর মানুষ।"
আরেক গণমাধ্যম কর্মী শাহজালাল ভূঁইয়া জানান, “সেদিন বেলা সাড়ে ১১ টায় মহিপাল ফ্লাইওভারের নিচে কর্মসূচি পালন করে ছাত্র-জনতা। দুপুর ১ টা পর্যন্ত স্লোগান, দেশাত্মবোধক গান ও বক্তৃতার মাধ্যমে সময় পার করে তারা। এরপর তিন-চার ভাগে বিভক্ত হয়ে নামাজও আদায় করে তারা৷ বেলা দেড়টার দিকে ট্রাংক রোড থেকে মহিপালের দিলেগুলি ছুঁড়ে অগ্রসর হয় আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা। পিডিবির সামনে ছাত্র-জনতা প্রতিরোধের চেষ্টা করেও গুলির মুখে পিছিয়ে যান। একপর্যায়ে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা মহিপাল চৌধুরী মার্কেটের সামনে পৌঁছে আন্দোলকারীদের উদ্দেশ্যে এলোপাতাড়ি গুলি ছুড়ে। এ সময় গুলিতে ফেনী সরকারি কলেজের শিক্ষার্থী ইশতিয়াক আহমেদ শ্রাবণ, সদর উপজেলার ফাজিলপুরের সাইদুল ইসলাম, পাঁচগছিয়ার ওয়াকিল আহমেদ শিহাব,সোনাগাজীর সাকিব,দাগনভূঞার সরোয়ার জাহান মাসুদ, লক্ষীপুরের সাইফুল ইসলাম, আরাফাত ও বিপ্লব প্রাণ হারান।”
ওইদিনের প্রত্যক্ষদর্শী আজিজ আল ফয়সাল জানান, “সেদিন এলোপাতাড়ি গুলিতে আহত হয় চার শতাধিকেরও বেশি মানুষ। সাড়ে তিনটার সময় গুলি শেষ হয়ে যাওয়ায় ছাত্র-জনতার প্রতিরোধের মুখে পিছু হটে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা। পরে মহিপাল দখলে নেয় তারা।এ সময় পাশে থাকা পুলিশ বক্সে আগুন ধরিয়ে দেয় বিক্ষুব্ধ ছাত্র-জনতা।”
আন্দোলনে থাকা তখনকার শহর শিবিরের অর্থ সম্পাদক মেহেদী হাসান মেশকাত বলেন, ‘সেদিন শুধু শিক্ষার্থীরা অংশগ্রহণ করেনি বরং সকল শ্রেণিপেশার মানুষ স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ করে। মহিপালের ব্যবসায়ীরা নিজেদের দোকানে সাধ্য অনুযায়ী আন্দোলনকারীদের জন্য ফল, বিস্কুট পানিসহ নানারকমের পানীয় খাবার নিয়ে আসেন। মহিপাল ফ্লাইওভারের নিচে পুলিশ বক্সের সামনে পুলিশ, বিজিবি সদস্যরা দাঁড়িয়ে ছিলেন। যোহরের আজানের কিছুক্ষণ পর আন্দোলনকারীদের একাংশ যোহরের নামাজে দাঁড়ালে আওয়ামী সন্ত্রাসীদের সশস্ত্র ক্যাডাররা নিরস্ত্র শিক্ষার্থীদের উপর গুলি করে নির্মম হত্যাযজ্ঞ চালায়।’
আন্দোলনের অন্যতম সংগঠক জামাল উদ্দিন বলেন, “আমার সামনে ৫ জন নিরীহ ছাত্রের লাশ পড়ে ছিল, সন্ত্রাসীদের গুলির সামনে কেউ এগিয়ে আসতে পারেনি। আমি কয়েকজনকে পাঠাই রিকশা নিয়ে আসার জন্য, সন্ত্রাসীরা সরে যাওয়ার কিছুক্ষণ পর সবাই নিহত হওয়া ৫ জনের লাশ নিতে এগিয়ে আসে। লাশগুলো নিয়ে কয়েকটি রিকশায় উঠানো হয়। দুয়েকজনকে পাশের ফার্মেসীতে চিকিৎসা দেয়ার চেষ্টা করা হয়। সন্ত্রাসীদের হত্যাকাণ্ডের সুবিধার জন্য সরকার মোবাইল নেটওয়ার্ক বন্ধ করে দেয়, পুরো যোগাযোগ বন্ধ হয়ে যায়। সকল হাসপাতালে চিকিৎসা দেয়া বন্ধ করতে নির্দেশনা দেয় এমপি নিজাম হাজারী। কোনো এম্বুলেন্সকে শহীদদের লাশ বহন করার জন্য পাওয়া যায়নি। সবাই ছিল সন্ত্রাসী নিজামের ভয়ে তটস্থ। সেদিন মোট ৮ জন শহীদ হন।”
তখন আন্দোলনে থাকা বর্তমান মহিপাল সরকারি কলেজ ছাত্রদলের সভাপতি গাজী সালাউদ্দিন আমান বলেন, “তখন আমরা সবাই নামাজ পড়ার জন্য দাঁড়িয়ে যাই। মহান আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করি যেন এই স্বৈরাচার সরকার অচিরেই ধ্বংস হয়ে যায়। এই সুযোগ কাজে লাগিয়ে আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগের ক্যাডার বাহিনী আন্দোলনকারীদের উপর নির্বিচারে গুলি করতে থাকে। যার জন্য আমরা মোটেও প্রস্তুত ছিলাম না। আমরা ভেবেছিলাম হয়ত তারা আমাদের ভয় লাগানোর জন্য বলেছিল আমাদের প্রতিহত করা হবে। কিন্তু তারা এমন বীভৎস হত্যাকাণ্ড ঘটাবে তা আমরা কল্পনাও করতে পারিনি। চোখের সামনে ঝরে যায় ভাইদের তরতাজা প্রাণ। শত শত ভাই আহত হন। তারা একবার নয় দুইবার নয় পরপর তিনবার আমাদের উপর এমন আক্রমণ চালায়। সেই দিন প্রশাসনের ভূমিকা ছিল খুবই নীরব। কিন্তু এত কিছুর পরেও আমাদের ভাইরা স্থান ছেড়ে যায়নি। তারা শেষ পর্যন্ত লড়েছিল।’
তিনি বলেন, ‘আজও যখন মহিপাল দিয়ে কোথাও যাই নিজের কাছে মনে হয় শহীদ ভাইদের রক্তের উপর দিয়ে হেঁটে যাচ্ছি। ৪ তারিখে বাংলাদেশের সবচেয়ে বেশি হত্যাকাণ্ড চলে ফেনীর এই মহিপালে। যা দেখে সারা বাংলাদেশ কেঁদেছিল।”
জেলায় জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) এর অন্যতম সংগঠক শাহ ওয়ালিউল্লাহ মানিক বলেন, সেদিন মুহুর্মুহু গুলিতে রণক্ষেত্রে পরিণত হয় পুরো মহিপাল এলাকা। আন্দোলনের সহযোদ্ধারা আহত ও নিহতের নিয়ে যান ফেনী জেনারেল হাসপাতালে। সেখানে সৃষ্টি হয় এক বিভীষিকাময় পরিস্থিতির।সেদিন ওই হাসপাতালের সব ডাক্তার নেমে এসেছিলেন জরুরি বিভাগে।
ওইদিনের ঘটনার বর্ণনা দেন সিনিয়র স্টাফ নার্স মো. তরিকুজ্জামান। তিনি বলেন, ‘৪ আগস্ট আমরা সকালে ডিউটিতে ছিলাম। আমি, সাজ্জাদ ও আলো দিদি। বেলা আনুমানিক একটার দিকে হঠাৎ রোগী আসা শুরু করলো। যেগুলো ছিল গানশট ইনজুরি। প্রথমে মনে করেছিলাম গন্ডগোল পর্যায়ের কিছু রোগী। কিন্তু এরপর থেকে আসা শুরু করলো সব স্টুডেন্ট। গোটা জরুরি বিভাগের চেহারা পাল্টে গেছে। ইমার্জেন্সিতে শুধু রক্ত আর রক্ত। কেউ নিয়ে আসছে ডেড বডি, কেউ নিয়ে আসছে আহতদের। এখানে পা ফেলার জায়গা ছিল না। যে যেভাবে পেরেছি সেবা দিয়েছি। সব ডিপার্টমেন্টের সিনিয়র ডাক্তাররা ছুটে এসেছিলেন, সিনিয়র নার্স, ওয়ার্ড থেকে হেল্পিং নার্সরা এসেছিলেন সেবা দিতে। সবাই মিলেই সেবা দিয়েছি।’
মেডিকেল অফিসার নাজমুল হক সাম্মি বলেন, ‘৪ আগস্ট ছিল পীড়াদায়ক। আমরা ডাক্তার হিসেবে এ অবস্থা ফেইস করেছি। কী বিপজ্জনক অবস্থা ছিল ইমারজেন্সি রুমের। ঠিক দুপুরে খবর এলো গুলিবিদ্ধ কিছু রোগী আসছে, সবাই প্রস্তুত হয়ে যান। নার্স-ডাক্তার যে যেভাবে ছিলেন সবাই প্রস্তুত হয়ে থাকেন। আমরা প্রস্তুত হলাম। দুপুর একটার দিকে একটার পর একটা রোগী আসতে লাগলো। প্রতিটি রোগীর ক্রিটিক্যাল অবস্থা। বিশেষ করে ব্লিডিং বেশি ছিল বলে আমরা হিমশিম খেয়ে যাচ্ছিলাম।
সেদিনের স্মৃতিচারণ করে ফেনী জেলা জামায়াতের আমির মুফতি আব্দুল হান্নান জানান, ‘শহীদদের জানাজায় এলাকাবাসী ও স্বজনদের অংশ নিতে বাধা দেয় আওয়ামী সন্ত্রাসীরা। ময়নাতদন্ত ছাড়াই দ্রুত রাতে তাদেরকে দাফন করতে বাধ্য করা হয় পরিবারের সদস্যদের।’
ফেনী জেলা বিএনপির আহবায়ক শেখ ফরিদ বাহার গতবছরের গণঅভ্যুত্থানকালে ৪ আগস্টের হত্যাযজ্ঞের স্মৃতিচারণ করেন এবং সেদিনের বর্বর হত্যাকাণ্ডে জড়িতদের বিচার দাবি করেন।