বাসস
  ০৪ আগস্ট ২০২৫, ১৮:০৪

৪ আগস্ট খুলনায় আন্দোলনকারীদের বিজয় উল্লাস

’২৪ এর ৪ আগস্ট বেলা পৌনে ১১টার দিকে নগরীর শিববাড়ি মোড়ে অবস্থান নিয়ে সড়ক অবরোধ করে ছাত্র-জনতা। ছবি : বাসস

।। মুহাম্মদ নুরুজ্জামান।। 

খুলনা, ৪ আগস্ট ২০২৫ (বাসস): সারাদেশে ৫ আগস্ট বিজয় উল্লাস হলেও খুলনা জেলা ৪ আগস্টেই চূড়ান্ত বিজয়ের স্বাদ লাভ করে। যার অংশ হিসেবে খুলনার আওয়ামী দুর্গ হিসেবে খ্যাত পতিত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার চাচা শেখ আবু নাসেরের বাড়ি ‘শেখ বাড়ি’ ও আওয়ামী লীগ কার্যালয়ে হামলা ও অগ্নিসংযোগ করে বিক্ষুব্ধ ছাত্র-জনতা। এরই ধারাবাহিকতায় ৪ আগস্ট খুলনা প্রেসক্লাব, বাংলাদেশ বেতার খুলনা কেন্দ্র, জেলা পরিষদসহ আওয়ামী বন্দনায় রত প্রতিষ্ঠানগুলোতে দফায় দফায় হামলা ও ভাঙচুরের ঘটনা ঘটে। একইসাথে  নগরীর বিভিন্ন স্থানে স্থাপিত বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ভাস্কর্যও ভাঙচুর করা হয়। যদিও এ সময় একটি সুযোগ সন্ধানী চক্র ব্যাপক লুটপাট চালায়। 

প্রত্যক্ষদর্শীদের সাথে কথা বলে জানা যায়, সরকারের পদত্যাগের একদফা দাবিতে ডাকা অসহযোগ আন্দোলনের অংশ হিসেবে চব্বিশের ৪ আগস্ট বেলা পৌনে ১১টার দিকে নগরীর শিববাড়ি মোড়ে অবস্থান নিয়ে সড়ক অবরোধ করে ছাত্র-জনতা। এদিন আন্দোলনকারীদের দফায় দফায় মিছিল ও বিক্ষোভ করতে দেখা যায়। আটকে দেওয়া হয় মোড়ের চতুর্দিকের চলাচলের পথ। আন্দোলনকারীদের স্লোগানে স্লোগানে উত্তাল ছিল শিববাড়ি মোড়। এ সময় আন্দোলনকারীদের ‘দফা এক দাবি এক, শেখ হাসিনার পদত্যাগ’, ‘দিয়েছি তো রক্ত, আরও দিব রক্ত’, ‘আঠারোর হাতিয়ার, গর্জে ওঠো আরেকবার’, ‘আমার সোনার বাংলায়, বৈষম্যের ঠাঁই নাই’- সহ বিভিন্ন ধরনের স্লোগান দিতে শোনা যায়। খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা ওইদিন বেলা ১১ টার দিকে ক্যাম্পাস থেকে একটি মিছিল নিয়ে নগরীর শিববাড়িতে যোগ দেয়।

বেলা সাড়ে ১১টার দিকে বিক্ষোভকারীদের একটি অংশ লোয়ার যশোর রোডের খুলনা মহানগর ও জেলা আওয়ামী লীগ কার্যালয়ের দিকে যাওয়ার চেষ্টা করলে তৎকালীন খুলনা জেলা আইনজীবী সমিতি ও সদর থানা আওয়ামী লীগ সভাপতি অ্যাডভোকেট সাইফুল ইসলামের নেতৃত্বে আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরা প্রকাশ্যে অস্ত্র উঁচিয়ে তাদের ওপর হামলার চেষ্টা করে। এ সময় বিক্ষুব্ধ ছাত্র-জনতার সঙ্গে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। এর পরই আওয়ামী লীগ অফিস ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ করে বিক্ষোভকারীরা। এ সময়  খুলনা মহানগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এমডিএ বাবুল রানা এবং নগর যুবলীগের সাধারণ সম্পাদক ও ছাত্রলীগের সভাপতি শেখ শাহাজালাল হোসেন সুজনকে পিটিয়ে গুরুতর জখম করে আন্দোলনকারীরা। গুরুতর আহত অবস্থায় তাদের খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের আইসিইউতে ভর্তি করা হয়। আহত জেলা ছাত্রলীগের সভাপতি পারভেজ হাওলাদার এবং খুলনা সিটি করপোরেশন (কেসিসি)’র কাউন্সিলর কনিকাসহ আরও ৩ জন হাসপাতালে  ভর্তি হন।

একই দিন  দুপুরে আন্দোলনকারীদের একটি অংশ বিক্ষোভ মিছিল নিয়ে নগরীর শেরে বাংলা সড়কের ‘শেখ বাড়ি’ হিসেবে পরিচিত সেসময়কার সংসদ সদস্য শেখ হেলাল উদ্দীন ও শেখ সালাহউদ্দিন জুয়েলের বাসভবনে অগ্নিসংযোগ করে।’ 

প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, রোববার দুপুরে আন্দোলনকারীরা একটি মিছিল নিয়ে নগরীর শেরে বাংলা রোড়ের শেখ বাড়ির সামনে গিয়ে ইটপাটকেল নিক্ষেপ শুরু করে। এ সময় ওই বাড়ির সামনে কোন পুলিশ বা নেতাকর্মী ছিল না। একপর্যায়ে তারা গেট ভেঙে ভেতরে প্রবেশ করে ব্যাপক ভাঙচুর চালায়। হামলাকারীরা ভবনের প্রতিটি তলায় আগুন ধরিয়ে দেয়। পরে স্থানীয়রা এসে আগুন নিয়ন্ত্রণে আনার আগেই সব পুড়ে ছাই হয়ে যায়। বিকেল পৌনে তিনটার দিকে আগুন নিভে গেলে বেশ কিছু পুলিশ ও এপিবিএন-এর সদস্যরা বাড়িতে আসেন। পরে যুবলীগের কিছু নেতাকর্মীকে বিক্ষোভ মিছিল নিয়ে বাড়ির সামনে আসতে দেখা যায়। বিকেল সাড়ে ৩টার দিকে ওই বাড়িতে আরেক দফা হামলা হয়।

প্রত্যক্ষদর্শীরা জানায়, পূর্ব ঘোষিত কর্মসূচি অনুযায়ী সকাল থেকে লোয়ার যশোর রোডের আওয়ামী লীগ কার্যালয়ের সামনে অবস্থান নেন আওয়ামী লীগ, যুবলীগ ও ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা। বেলা সাড়ে ১১টার দিকে কিছু আন্দোলনকারী পিকচার প্যালেস মোড় থেকে অগ্রসর হতে চাইলে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা তাদের ধাওয়া দেয়। এ সময়  দুই পক্ষের ধাওয়া, পাল্টা ধাওয়ার মধ্যে ককটেল ও গুলির শব্দ পাওয়া যায়। এ সময় আন্দোলনকারীদের ধাওয়ায় আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা পিছু হটে। আন্দোলনকারীরা আওয়ামী লীগের  কার্যালয়ে গিয়ে ব্যাপক ভাঙচুর চালায় এবং আসবাবে আগুন ধরিয়ে দেয়। কার্যালয়ের নিচে বেশকিছু মোটর সাইকেলেও অগ্নিসংযোগ করা হয়।

আওয়ামী লীগ কার্যালয়ে অগ্নিসংযোগের পর আন্দোলনকারীরা নৌপরিবহণ মালিক গ্রুপের ভবনে ভাঙচুর চালায়। শেখ হাসিনার চাচাতো ভাই ও যুবলীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য শেখ সোহেল সংগঠনটির সভাপতি ছিল। পরে আন্দোলনকারীদের একটি অংশ নগর ভবনে ইটপাটকেল নিক্ষেপ করে। এতে ভবনের কিছু কাচ ভেঙে যায়। তারা জেলা পরিষদ কার্যালয়ে প্রবেশ করে সামনে থাকা ৪টি মোটর সাইকেলেও আগুন ধরিয়ে দেয়।
দুপুর দেড়টায় তারা খুলনা প্রেসক্লাবে ভাঙচুর চালায়। পরে বিকেল সাড়ে ৪টার দিতে আরেক দফা ভাঙচুর করে প্রেসক্লাবের ভেতরে আগুন ধরিয়ে দেয়। 

অপরদিকে, খুলনা সিটি কর্পোরেশনের তৎকালীন মেয়র ও মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতি তালুকদার আব্দুল খালেকের বাসভবনে হামলাকে কেন্দ্র করে আন্দোলনকারীদের সঙ্গে পুলিশের সংঘর্ষ হয়। ৪ আগস্ট সন্ধ্যা ৬টা থেকে ৭টা পর্যন্ত প্রায় ঘণ্টা ব্যাপী এ সংঘর্ষ চলে। এ সময় উভয়পক্ষের ৩৫ জন আহত হয়। আহত ২৫ আন্দোলনকারীকে খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। এর মধ্যে অনেকেই গুলিবিদ্ধ। এর আগে বিকাল সাড়ে ৩টায় মেয়রের বাড়িতে আরেক দফা হামলা চালায় আন্দোলনকারীরা। ওই সময় বাড়ির সামনে একটি মোটর সাইকেল ও চেয়ার ভাঙচুর করে।

খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের শিক্ষার্থী ও বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের খুলনা মহানগরের যুগ্ম সদস্য সচিব মুহিব্বুল্লাহ মুহিব সেদিনের স্মৃতিচারণ করে বাসসকে বলেন, ৪ আগস্ট চূড়ান্ত আন্দোলন শুরু হয়। ওইদিন আমরা সকাল ১০ টায় শিববাড়ি মোড়ে জড়ো হই। সেখানে প্রচুর পরিমাণ ছাত্র-জনতা যোগ দেয়। ওইদিন আমাদের কাছে খবর আসে- ছাত্রলীগ, যুবলীগ ও সোনাডাঙা থেকে শ্রমিকলীগ আমাদের ওপর আক্রমণ করবে। এ কারণে আমরা নিরাপত্তার জন্য হাতে লাঠি এবং রড রাখি। তারপর বেলা বাড়ার সাথে সাথে ছাত্র-জনতার অংশগ্রহণ আরও বাড়তে থাকে। সেখানে প্রায় ২০ হাজার লোকের সমাগম হয়। আন্দোলন চলতে চলতে এমন সময় খবর আসে যে, শেখ হাসিনার পতন হয়ে গেছে। তখন সবাই উল্লাসে ফেঁটে পড়ে। তখন হাতে থাকা পানির বোতল এবং খাবারের প্যাকেট ছুড়ে উল্লাস করতে করতে একটি অংশ মিছিল নিয়ে আওয়ামী লীগ অফিসের দিকে চলে যায়। এরমধ্যেই খবর আসে, আওয়ামী লীগ অফিসে অ্যাডভোকেট সাইফুলসহ আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরা আমাদের ওপর আক্রমণ করার জন্য অস্ত্র নিয়ে অপেক্ষা করছে। এক পর্যায়ে অ্যাডভোকেট সাইফুল অস্ত্র নিয়ে বের হয়। কিন্তু ছাত্র-জনতার মিছিল দেখে তারা পিছু হটে। ওই সময় আওয়ামী লীগ অফিস, শেখ বাড়ি ও প্রেসক্লাবসহ বিভিন্ন স্থানে আওয়ামী লীগের স্থাপনায় হামলার ঘটনা ঘটে। তবে তার কিছুক্ষণ পরে শোনা যায়, হাসিনার পতন হয়নি। 

মুহিব বলেন, ওইদিনই ঢাকার সমন্বয়করা ঘোষণা দেয় যে, হাসিনা পতনের একদফা দাবিতে ‘লং মার্চ টু ঢাকা’ ৬ তারিখের পরিবর্তে ৫ তারিখে অনুষ্ঠিত হবে। তখন আমাদের মনে আশা তৈরি হয় যে, আগামীকালই শেখ হাসিনার শেষ দিন। তখন আমরা চিন্তা করলাম যে ঢাকায় যাবো। কিন্তু ঢাকায় যাওয়া সম্ভব হচ্ছে-না, গোপালগঞ্জসহ বিভিন্ন জায়গায় আক্রমণ হচ্ছে। তখন আমরা খুলনাতেই আন্দোলনের সিদ্ধান্ত নিই।