শিরোনাম
এস কে রাসেল
কিশোরগঞ্জ, ৪ আগস্ট ২০২৫ (বাসস): গত বছরের ৪ আগস্ট। সারাদেশে ৫ আগস্ট ফ্যাসিবাদমুক্ত হলেও, কিশোরগঞ্জ মুক্ত হয় তার আগেরদিন ৪ আগস্ট। সেই ঐতিহাসিক দিনে ছাত্র-জনতার ১ দফা দাবির আন্দোলনে শহীদ হন কিশোরগঞ্জের সাহসী যুবক রুবেল আব্দুল্লাহ (৩৫)।
২০২৪ সালের ৪ আগস্ট সকাল থেকেই কিশোরগঞ্জ শহরের বিভিন্ন পয়েন্টে আন্দোলনরত ছাত্র-জনতার পাশে দাঁড়ান রুবেল। কখনো পানির বোতল হাতে দিয়ে তাদের তৃষ্ণা মেটান, কখনো মিছিলে যোগ দিয়ে রাজপথে হাঁটেন। সকাল সাড়ে ১০টার দিকে ঈশা খাঁ রোডে পুলিশ ও আওয়ামী লীগ-যুবলীগ-ছাত্রলীগের সমন্বিত বাহিনীর গুলিতে আহত হন তিনি। আহত অবস্থায়ও তিনি এক আহত আন্দোলনকারীকে কোলে করে হাসপাতালে পৌঁছে দেন। পরে সেখানেই তিনি মৃত্যুবরণ করেন।
সরকারি গেজেট নং- ৪৩৫ অনুযায়ী স্বীকৃত এই শহীদের স্থায়ী ঠিকানা কিশোরগঞ্জ জেলার করিমগঞ্জ উপজেলায় হলেও তিনি থাকতেন জেলা শহরের নীলগঞ্জ রোডে। কালীবাড়ি মোড়ে ‘মক্কা মোটরস’ নামে একটি দোকানে পুরোনো মোটরসাইকেল কেনাবেচা করতেন। তার স্ত্রী মাজেদা আক্তার একজন গৃহিণী। তাদের তিন সন্তান—বড় মেয়ে জান্নাতুল ফেরদৌস নুন (১০), দ্বিতীয় মেয়ে জান্নাতুল মাওয়া (৮) এবং ছোট ছেলে মোহাম্মদ ইবনে আব্দুল্লাহ, যার বয়স মাত্র সাড়ে তিন বছর।
গতবছরের ৩ আগস্ট বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতারা একদফা কর্মসূচি ঘোষণা করে। তারই ধারাবাহিকতায় ৪ আগস্ট সকাল থেকে আন্দোলনকারী ছাত্র-জনতা শহরের গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্ট দখলে নিয়ে আন্দোলন শুরু করে।
এর আগে ওইদিন সকালে জেলা আওয়ামী লীগ অফিসের সামনে অবস্থান নেয় আওয়ামী লীগ, যুবলীগ ও ছাত্রলীগের সশস্ত্র নেতাকর্মীরা। সকাল সাড়ে ১০টার দিকে জেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আশফাকুল ইসলাম টিটুর বাসা থেকে আগ্নেয়াস্ত্র নিয়ে এসে আন্দোলনকারীদের লক্ষ্য করে গুলি চালানো হয়। আন্দোলনকারীরা পাল্টা প্রতিরোধ গড়ে তুললে আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীরা পালিয়ে গিয়ে টিটুর বাসায় আশ্রয় নেয়।
এরপর পরিস্থিতি আরও উত্তপ্ত হয়ে ওঠে।আন্দোলনকারীরা জেলা আওয়ামী লীগের অফিসে আগুন দেয়। বেলা সাড়ে ১১টার দিকে টিটুর বাসা থেকে আবারও আন্দোলনকারীদের লক্ষ্য করে গুলি চালানো হয়। তখন আন্দোলনকারীরা টিটুর বাসায় হামলা চালিয়ে আগুন ধরিয়ে দেন। এই পুরো সময়জুড়েই রুবেল আব্দুল্লাহ আন্দোলনকারীদের পাশে ছিলেন পানির বোতল হাতে, মিছিলের সামনে।
আহত অবস্থায়ও তিনি একজন আহত আন্দোলনকারীকে কোলে করে কিশোরগঞ্জ ২৫০-শয্যা জেনারেল হাসপাতালে নিয়ে যান। পরে সেখানে রুবেল আব্দুল্লাহ’র শারীরিক অবস্থার অবনতি হলে তাকে সৈয়দ নজরুল ইসলাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়া হয়। সেখানেই শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন তিনি।
রুবেলের ছোট ভাই রফিকুল ইসলাম তোফায়েল জানান, সংঘর্ষের দিন রুবেল আব্দুল্লাহ নিজের টাকায় ৫ ডজন বোতল পানি কিনে আন্দোলনকারীদের মাঝে বিতরণ করেছিলেন।
আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়কারী আশরাফ আলী সোহান বলেন, “রুবেল ভাই ঢাকার মুগ্ধের মতোই ‘পানি! পানি!’ বলে সবার তৃষ্ণা মেটাচ্ছিলেন। গুলিতে নিজে আহত হয়েও অন্য একজনকে হাসপাতালে পৌঁছে দেন।”
আন্দোলনের প্রথমসারির ছাত্রদল নেত্রী নুসরাত জাহান বলেন, “শহীদ রুবেল আব্দুল্লাহ ভাই তার স্ত্রী ও তিনটি শিশুসন্তান আমাদের মধ্যে থেকে চলে গেছেন। এই পরিবার যেন একা না হয়ে পড়েন, সেই চেষ্টা আমাদের থাকবে। আমরা ছাত্রদল পরিবার হিসেবে সবসময় তাদের পাশে থাকবো।’
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের কিশোরগঞ্জ জেলার তৎকালীন নেতা হাফেজ ইকরাম হোসেন বলেন, “যারা সরাসরি আন্দোলনকারীদের গুলি করেছিল, তারা এখনো ধরাছোঁয়ার বাইরে। অবিলম্বে তাদের গ্রেফতার করে আইনের আওতায় আনার দাবি জানাই।”
তৎকালীন আন্দোলনের সমন্বয়কারী এবং বর্তমানে গণঅধিকার পরিষদের কিশোরগঞ্জ জেলা শাখার সাধারণ সম্পাদক অভি চৌধুরী বলেন, ‘সারাদেশ ৫ আগস্ট ফ্যাসিবাদমুক্ত হলেও কিশোরগঞ্জ একদিন আগেই ৪ আগস্ট মুক্ত হয়েছিল। কারণ সেদিন দল-মত নির্বিশেষে সবাই রাস্তায় নেমে এসেছিল একদফা বাস্তবায়নের দাবিতে।’
কিশোরগঞ্জ জেলা জামায়াতে ইসলামীর আমির অধ্যাপক মো. রমজান আলী বলেন, ‘কিশোরগঞ্জে আন্দোলনে প্রাণ দিয়েছেন ১৮ জন শহীদ। আমরা জামায়াতের পক্ষ থেকে প্রতিটি শহীদ পরিবারকে আর্থিক সহায়তা করেছি। আহতদের চিকিৎসার পাশাপাশি খোঁজখবরও নিচ্ছি। যাদের আত্মত্যাগে আজকের ফ্যাসিবাদমুক্ত বাংলাদেশ পেয়েছি, তাদের পরিবারকে আমরা কোনোদিন ভুলবো না, ইনশাআল্লাহ সবসময় পাশে থাকবো।’