বাসস
  ০৪ আগস্ট ২০২৫, ১৫:৫০

ছাত্রদের প্রবল প্রতিরোধের মুখে পিছু হটে আওয়ামী লীগ

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের চুয়াডাঙ্গার শিক্ষার্থীদের এক দফা দাবিতে ৪ আগস্ট সর্বাত্মক অসহযোগ আন্দোলন। ছবি: বাসস

/ বিপুল আশরাফ /

চুয়াডাঙ্গা, ৪ আগস্ট ২০২৫(বাসস): বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের চুয়াডাঙ্গার শিক্ষার্থীরা এক দফা দাবিতে ৪ আগস্ট সর্বাত্মক অসহযোগ আন্দোলনের ডাক দেয়। ২০২৪ এর ৩ আগস্ট, শনিবার রাতেই এ কর্মসূচি চূড়ান্ত করা হয়। এতে চুয়াডাঙ্গার পরিবেশও উত্তপ্ত হয়ে ওঠে। 

৪ আগস্ট ২০২৪। রোববার। দিনব্যাপী চুয়াডাঙ্গা শহর ছিল উত্তেজনাপূর্ণ। মানুষের মনে উদ্বেগ আর উৎকণ্ঠা। সরকার পতনের এক দফা দাবিতে জেলা সদর ছাড়াও উপজেলা এবং গুরুত্বপূর্ণ বাজারগুলোতে বৈষম্যবিরোধী শিক্ষার্থীদের সাথে সাধারণ মানুষ আন্দোলনে অংশ নেয়। ফলে আন্দোলনে উত্তাল হয়ে ওঠে চুয়াডাঙ্গা। কোথাও কোথাও বিক্ষোভ প্রদর্শন করতে গিয়ে বাধার মুখে পড়েন তারা। বেলা ১১টা থেকে চুয়াডাঙ্গা- মেহেরপুর সড়কের ভালাইপুর বাজারে সড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ করেন আন্দোলনকারীরা। একই সাথে শহরের কোর্ট মোড় এলাকাতেও বিক্ষোভ করতে গেলে ক্ষমতাসীন দলের নেতা-কর্মীদের বাধার মুখে পড়ে ছাত্ররা। দর্শনা শহরে বিক্ষোভ মিছিল নিয়ে আন্দোলনকারীরা বাসস্ট্যান্ডে জড়ো হলে তাদের ওপরেও হামলা চালানো হয়। এছাড়াও জেলার বদরগঞ্জ, জীবননগর ও আলমাডাঙ্গায় বিক্ষোভ সমাবেশ করে শিক্ষার্থীরা। এদিকে এমন পরিস্থিতিতে জেলাজুড়ে এক অজানা আতঙ্ক বিরাজ করতে থাকে ।  

এক দফা দাবি আদায়ের লক্ষ্যে পূর্ব ঘোষণা অনুযায়ী রোববার বেলা ১১টার দিকে শহরের কোর্ট মোড়ে শিক্ষার্থীরা উপস্থিত হতে থাকে। এ সময় তাদের প্রতিরোধ করতে যুবলীগ, ছাত্রলীগ, স্বেচ্ছাসেবক লীগসহ অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনের নেতা-কর্মীরাও সেখানে আলাদা আলাদাভাবে জড়ো হয়। জেলা যুবলীগের কয়েকজন সদস্য সেখানে আসা শিক্ষার্থীদের জোর করে বাড়িতে পাঠিয়ে দেয়। আবার কাউকে কাউকে ইজিবাইকে তুলে দিয়ে স্থান ত্যাগ করতে বলে। তারপরও শিক্ষার্থীরা ধীরে ধীরে সমবেত হতে থাকে।

প্রত্যক্ষদর্শীরা জানায়, কোর্ট মোড়ে দাঁড়াতে না পেরে শিক্ষার্থীরা আইনজীবী ভবন চত্বর ও জেলা প্রশাসকের কার্যালয় চত্বরে বিচ্ছিন্নভাবে অবস্থান নেয়। জেলা ছাত্রলীগের কর্মীরা জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের গেটে অবস্থান নেয়। তারা বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের একটি ব্যানার কেড়ে নিয়ে ছিঁড়ে ফেলে। তারা কোর্ট মোড় এলাকা থেকেও বিচ্ছিন্নভাবে দাঁড়িয়ে থাকা শিক্ষার্থীদের বের করে দেয়। কিছু শিক্ষার্থী বিচ্ছিন্নভাবে সরে পড়েন। এর কিছুক্ষণ পরেই কাঠপট্টি এলাকা থেকে কিছু শিক্ষার্থী বিক্ষোভ মিছিল বের করার চেষ্টা করে। এ অবস্থায় তারা মিছিল নিয়ে হাসপাতাল রোড এলাকায় যায়। সেখানে সনো টাওয়ারের পাশের গলিতে ছাত্রলীগ ও যুবলীগের কর্মীরা ছাত্র-ছাত্রীদের মিছিলে হামলা চালায়। এতে কয়েকজন শিক্ষার্থী গুরুতর আহত হন। এ সময় যুবলীগের নেতা কর্মীরা মোটরসাইকেল নিয়ে হাসপাতাল রোডসহ শহরের বিভিন্ন অলি গলিতে মহড়া দেয়। এ ঘটনার খবর ছড়িয়ে পড়লে শহরের বড় বাজার, শহীদ আবুল কাশেম সড়ক, কোর্ট রোড, পুরাতন হাসপাতাল রোডের বেশির ভাগ দোকানপাট দুপুরের দিকে বন্ধ করে দেন ব্যবসায়ীরা। বিকেলের দিকে অল্প কিছু দোকানপাট খোলা হয়। সারাদিনে চুয়াডাঙ্গা থেকে কোনো বাস ছাড়েনি। ফলে ইজিবাইক, লেগুনা ও পাখিভ্যানযোগে সাধারণ মানুষ চলাচল করে। 

আওয়ামী বাঁধার মুখে শহরে আন্দোলনকারীরা জমায়েত হতে না পারলেও রোববার সকাল সাড়ে ১০ টার দিকে চুয়াডাঙ্গার ভালাইপুর বাজারে অবস্থান নেয় আন্দোলনকারীরা। এ সময় তারা চুয়াডাঙ্গা-মেহেরপুর সড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ করতে থাকে। এক দফা দাবি আদায়ে সড়কে যান চলাচল বন্ধ করে দেয় আন্দোলনকারীরা। সৃষ্টি হয় যানজটের। এ সময় এক দফা দাবি পূরণ না হওয়া পর্যন্ত আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণা দেয়া হয়। তারা বলেন কেউ বাধা দিলে প্রতিরোধ গড়ে তুলবো। 

শিল্পনগরী দর্শনাতেও শিক্ষার্থীরা ফুঁসে উঠে। এদিন বেলা ১১টার দিকে দর্শনা প্রেসক্লাবের সামনে বৈষম্যবিরোধী শিক্ষার্থীরা সরকার পতনের এক দফা দাবিতে মানববন্ধন, বিক্ষোভ ও অবস্থান ধর্মঘট পালন করে। মানববন্ধন শেষে একটি বিক্ষোভ মিছিল বের করে। পরে মিছিলটি দর্শনা বাসস্ট্যান্ডে চৌরাস্তার মোড়ে অবস্থান নেয়।  অবস্থান ধর্মঘট চলাকালে সাধারণ শিক্ষার্থীদের উপর ছাত্রলীগ ও যুবলীগের নেতা-কর্মীরা হামলা ও বোমা বিস্ফোরণ ঘটায়। এতে অম্লান (১৮), নাহিদসহ (১৯) ৩ জন আহত হন। 

বৈষম্যবিরোধী ছাত্রদের আন্দোলন প্রতিহত করতে দিনব্যাপি সরব ছিল জেলার আওয়ামী লীগ ও তার অঙ্গসংগঠনসমুহের নেতা কর্মীরা। রোববার বেলা ১১টায় চুয়াডাঙ্গা জেলা আওয়ামী লীগের কার্যালয়ের সামনে থেকে মিছিল বের করা হয়। মিছিলটি শহরের প্রধান সড়ক ঘুরে বড় বাজার গিয়ে প্রতিবাদ সভা করে। সভায় বক্তব্য দেন জেলা আওয়ামী লীগের সাবেক যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক রিয়াজুল ইসলাম টোটন, অ্যাডভোকেট শামসুজ্জোহা, মুন্সি আলমগীর হান্নান প্রমুখ। জেলা স্বেচ্ছাসেবক লীগের আয়োজনে অবস্থান কর্মসূচি পালন করা হয়। তারা কেদারগঞ্জ বাজার থেকে মোটরসাইকেল শোভাযাত্রা সহকারে প্রধান প্রধান সড়ক প্রদক্ষিণ করে। এ সময় শহরের কোর্ট মোড়ে সংক্ষিপ্ত সমাবেশে বক্তব্য রাখেন জেলা স্বেচ্ছাসেবক লীগের সাবেক আহ্বায়ক ওবাইদুর রহমান চৌধুরি জিপু। 

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের চুয়াডাঙ্গা জেলা শাখার সাবেক সদস্য সচিব ও কর্মসূচির অন্যতম মুখ্য সমন্বয়ক সাফফাতুল ইসলাম বলেন, ৪ আগস্ট চুয়াডাঙ্গার বিভিন্ন স্থানে স্বৈরাচার হাসিনার বিরুদ্ধে ছাত্র জনতার আন্দোলন সংগঠিত হয়। তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য চুয়াডাঙ্গা সদর, জীবননগর উপজেলা এবং আলমডাংগা উপজেলা।

ভালাইপুরে ব্যাপক ছাত্র আন্দোলনের মুখে পুলিশ এবং আওয়ামীলীগের সমর্থকেরা পিছু হটতে বাধ্য হয়। চুয়াডাঙ্গার মতো সীমান্তবর্তী জেলায় আমরা যে সক্ষমতা দেখিয়েছি, তা শুধু স্থানীয় নয়, কেন্দ্রীয় আন্দোলনেও ইতিবাচক প্রভাব ফেলেছে। আমরা মনে করি, আমাদের অংশগ্রহণ জাতীয় পর্যায়ে ছাত্র রাজনীতিকে নতুন দিশা দিয়েছে। আমাদের নেতৃত্ব ভবিষ্যতের আন্দোলনকেও অনুপ্রাণিত করবে।

৪ আগস্ট রোববার সন্ধ্যা ৬টা থেকে কারফিউ শুরু হলে চুয়াডাঙ্গা শহরে কমতে থাকে সাধারণ মানুষের চলাচল। দিনব্যাপী আন্দোলন-উত্তেজনায় থাকা চুয়াডাঙ্গা শহর সন্ধ্যার পরই ফাঁকা হয়ে যায়। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা টহল জোরদার করে। শহরে অতিরিক্ত পুলিশের অবস্থান দেখা যায়।