বাসস
  ০৪ আগস্ট ২০২৫, ১৪:১৩

ছাত্রলীগকে পরাজিত করে ছাত্রজনতার জয়

২০২৪ সালের ৪ আগস্ট পিরোজপুর ছিল ছাত্রজনতার দখলে। ছবি: বাসস

\ মো.মিজানুর রহমান \ 

পিরোজপুর, ৪ আগস্ট, ২০২৫ (বাসস) : ২০২৪ সালের আজকের দিনে (৪ আগস্ট) পিরোজপুর ছিল ছাত্রজনতার দখলে। এর আগে ঢাকাসহ সারা দেশ বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে উত্তাল থাকলেও পিরোজপুরে আওয়ামী এবং পুলিশ বাহিনীর কারণে ছাত্র জনতা খুব একটা মাঠে নামতে পারেনি।

কিন্তু ৩ আগস্ট রাতে বৈষম্যেবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতারা সিদ্ধান্ত নেয়, যেকোনো মূল্যেই হোক ৪ আগস্ট তারা মাঠে নামবে। সেই মতে ঐদিন রাতে ছাত্ররা বিভিন্ন মেসেঞ্জার, হোয়াটসঅ্যাপ এবং ফেসবুক গ্রুপে নিজেদের মধ্যে যোগাযোগ করে পরিকল্পনা সাজাতে থাকে। একই সাথে তারা রাজনৈতিক নেতাদের সাথেও যোগাযোগ করতে থাকে। কিন্তু এই খবর গোয়েন্দা সংস্থা ও ছাত্রলীগের সন্ত্রাসীদের কাছে পৌঁছে গেলে পুলিশ রাতেই অভিযানে নামে এবং ছাত্রলীগের সন্ত্রাসীরা মোটরসাইকেলে করে শহরে আতঙ্ক তৈরি করে। এ অবস্থায় সিদ্ধান্তহীনতায় পড়ে যায় বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতা কর্মীরা। তবে রাত সাড়ে তিনটায় সর্বশেষ চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হয় পরদিন জীবন বাজি রেখে হলেও তারা রাস্তায় নামবে এবং মাঠ দখলে নেবে।

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের অন্যতম নেতা মো. মুইন উদ্দিন বলেন, চার তারিখ মাঠে নামার ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নিতে আমাদের রাত সাড়ে তিনটা বেজে যায়। এ সময় আমরা ফাইনাল সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলি জীবন বাজি রেখে হলেও আমরা মাঠে নামবোই। রাতে আমরা পুলিশের গ্রেফতারের ভয়ে বাসায় ঘুমায়নি এবং উপজেলাগুলো থেকে আন্দোলনে শরিক হতে যে সমস্ত শিক্ষার্থীরা রাতেই পিরোজপুর এসেছিল তাদের আমরা নিরাপদ জায়গায় রেখেছিলাম।

আন্দোলনের আর এক নেতা সরকারি সোহরাওয়ার্দী কলেজের অনার্সের চতুর্থ বর্ষের শিক্ষার্থী এবং আহত জুলাই যোদ্ধা শফিকুল ইসলাম বলেন, রাতের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ৪ তারিখ সকাল আটটায় আমরা বিভিন্ন দলে ভাগ হয়ে যে যার মত রাস্তায় বের হয়ে পড়ি। আমাদের লক্ষ্য ছিল পুরাতন বাস স্ট্যান্ড দখলে নিয়ে সমাবেশ করা। রাতের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী প্রথমে সেখানে মেয়েরা জড়ো হতে থাকে। তারপরে ধীরে ধীরে আমরাও সেখানে পৌঁছাতে থাকি। কিন্তু ইতিমধ্যেই ছাত্রলীগের হেলমেট বাহিনী এবং পুলিশ এসে আমাদের ছত্র ভঙ্গ করে দেয়। আমরা সেখান থেকে বাইপাস রোডের পুরাতন পেট্রোল পাম্প এর কাছে অবস্থান নেই। এরমধ্যে আমাদের লোকসংখ্যা বাড়তে থাকে। তখন সিদ্ধান্ত নেই আমরা এখন বাস স্ট্যান্ডের দিকে না গিয়ে আমরা উল্টো ঘুরে সিও অফিস মোড় হয়ে শহরে ঢুকবো।

ছাত্ররা যখন পুরাতন পেট্রোল পাম্প থেকে মিছিল নিয়ে সিও অফিসমুখী রওনা হয় তখন ধীরে ধীরে তাদের সংখ্যা বাড়তে থাকে। তারা যখন সিও অফিস পৌঁছায় তখন উত্তর দিকের পুলিশ লাইন রোড থেকে প্রায় পাঁচশত লোকের একটি মিছিল এসে তাদের সাথে যোগ দেয়। তখন তাদের আত্মবিশ্বাস আরো বেড়ে যায়। এ পর্যায়ে তারা কয়েক হাজার ছাত্রজনতার মিছিল নিয়ে শহরের দিকে এগোতে থাকে। একপর্যায়ে মিছিলটি দুপুর ১২ টার দিকে মহিলা কলেজের মোড়ে পৌঁছলে ছাত্রলীগের সন্ত্রাসীদের বাধার সম্মুখীন হয়। এ সময় শুরু হয়ে যায় তুমুল সংঘর্ষ। 

ছাত্রলীগের সন্ত্রাসীরা আগ্নেয়াস্ত্রেসহ দেশীয় অস্ত্রে সজ্জিত ছিল। তারা ছাত্রদের উপরে গুলি চালায়। কিন্তু ছাত্র জনতা গুলি উপেক্ষা করে ছাত্রলীগের সন্ত্রাসীদের উপরে আক্রমণ করে। গত ১৫ বছরে এই প্রথম ছাত্রলীগের সন্ত্রাসীরা ছাত্রজনতার আক্রমণের মুখে প্রায় ৫০/৬০ টি মোটরসাইকেল ফেলে পালিয়ে যায়। এরপরে বৈষম্যবিরোধী ছাত্রজনতার সাথে বিভিন্ন বাসা বাড়ি থেকে মা-বোন সহ অভিভাবকরা লাঠি ছোটাসহ যে যা পেয়েছে তাই নিয়ে রাস্তায় নেমে আসে। এখান থেকে মিছিল চলে যায় পুরাতন বাসস্ট্যান্ডে (বর্তমানে যার নাম বৈষম্য বিরোধী চত্বর)। এসময় পুরো এলাকা দখলে নেয়। তারা রাস্তায় জোহরের নামাজ আদায় করে এবং রাস্তায় বসেই দুপুরের খাবার গ্রহণ করে। বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের লোকজন ও অভিভাবকরা তাদের খাবার এবং পানি সরবরাহ করে। এ সময় পুরাতন বাসস্ট্যান্ড এলাকার সকল বাসা-বাড়ি আন্দোলনকারীদের জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়া হয়।

জেলা বিএনপি'র যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক শেখ রিয়াজ উদ্দিন রানা বলেন, আমাদের প্রতি কেন্দ্রের নির্দেশ ছিল, সরাসরি ছাত্রআন্দোলনের সামনে না থেকে ব্যাকআপ টিম হিসাবে তাদেরকে সাহায্য করা। সেই নির্দেশনা অনুযায়ী ছাত্ররা যেন বিপদে না পড়ে আক্রমণের শিকার না হয় সেজন্য আমি পুলিশের চোখকে ফাঁকি দিতে হেলমেট পড়ে সারাদিন ছাত্রজনতার মিছিলকে অনুসরণ করে তাদেরকে দিকনির্দেশনা, খাবারদাবার সরবরাহ এবং ফিনান্সিয়াল সাপোর্ট দেওয়ার আপ্রাণ চেষ্টা করেছি।

বেলা তিনটার পরে পুরাতন বাসস্ট্যান্ডে সাধারণ জনতার সংখ্যা আরও বাড়তে থাকে। পুরো বাসস্ট্যান্ড এবং এর আশপাশের এলাকা চলে যায় ছাত্র জনতার দখলে। এ সময় ছাত্রজনতার বৈষম্যবিরোধী মুহুর্মুহু স্লোগানে এলাকা প্রকম্পিত হতে থাকে। রাত আটটা পর্যন্ত এভাবেই চলতে থাকে।

এরপরে পরবর্তী দিনের আন্দোলনের জন্য যে যার মত নিরাপদ স্থানে চলে যায়।

তবে বাসায় ফেরার পথে শহরের স্বর্ণকার পট্টিতে ঘাপটি মেরে থাকা ছাত্রলীগ সন্ত্রাসীরা কুপিয়ে জখম করে ফাহাদ শিকদার অপি নামে আন্দোলনের সক্রিয় এক নেতাকে।

সরকারি সোহরাওয়ার্দী কলেজের হিসাববিজ্ঞান বিভাগের চতুর্থ বর্ষের শিক্ষার্থী এবং এই আন্দোলনের একজন অনলাইন যোদ্ধা আসমা আক্তার বলেন, আমি মাঠে নামিনি তবে আমার দায়িত্ব ছিল ফেসবুক মেসেঞ্জার এবং হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপে সকলের সাথে যোগাযোগ করা। সবাইকে আন্দোলনের বিষয় বিভিন্ন সিদ্ধান্ত জানানো।

পিরোজপুরের রাজনৈতিক দলসহ ছাত্রজনতা গত ১৬ বছরে ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগের অনেক জুলুম নির্যাতন ও আক্রমণের শিকার হয়েছে। কিন্তু কখনোই সেরকম কোন পাল্টা আক্রমণ করতে পারেনি। 

অবশেষে আজকের দিনে (৪ আগস্ট) ছাত্র জনতা ফ্যাসিস্টের বিরুদ্ধে জয়লাভ করে।