শিরোনাম
।। ফারাজী আহম্মদ রফিক বাবন।।
নাটোর, ৪ আগস্ট, ২০২৫ (বাসস): ২০২৪ সালের চার আগস্টের মধ্যাহ্ন। পাবনার এনায়েতপুর থানা এলাকা যেন ছিল একটু বেশিই উত্তাল। হাজারো ছাত্র-জনতার প্রতিরোধ কর্মসূচিতে অংশগ্রহণকারীদের সহায়তা করছিলেন নাটোরের আব্দুল্লাহ আল বাকী মিঠু (৩১)। কিছুক্ষণ পর নির্বিচারে গুলি চালায় পুলিশ। বুক আর মুখমন্ডলে ছররা গুলিবিদ্ধ হয়ে অচেতন হয়ে পড়েন মিঠু। একটি স্পিøন্টার বাম চোখের ঠিক পেছনে বিদ্ধ হয়। আহত-নিহত অনেকের সঙ্গে মিঠুর ঠাঁই হয় খাজা ইউনুস আলী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের জরুরি বিভাগে। পরে তার জ্ঞান ফিরলেও ফেরেনি বাম চোখের দৃষ্টি।
গুলির স্পিøন্টার ছড়িয়ে আছে মিঠুর পুরো চোখে। অসহ্য যন্ত্রণায় কাতর মিঠুকে নিয়ে এক হাসপাতাল থেকে আরেক হাসপাতালে দৌঁড়ে বেড়িয়েছেন প্রিয়তমা স্ত্রী নুপুর আর ছোট বোন শাপলা। শেষে ২ অক্টোবর জাতীয় চক্ষুবিজ্ঞান ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালে হয় রেটিনার অপারেশন।
হাসপাতালে আগত নেপালের চক্ষু বিশেষজ্ঞ টিম মিঠুর চোখ পরীক্ষা করে বলেছেন, দৃষ্টি শক্তি ফিরে পাওয়ার সম্ভাবনা ক্ষীণ। ক্ষতবিক্ষত হয়ে যাওয়া রেটিনার রক্তনালীগুলো যদি অলৌকিকভাবে জোড়া লেগে যায় আর অপারেশনে ব্যবহার করা সিলিকন ওয়েল সংশ্লেষণ হয়ে যদি একটুখানি অবস্থার উত্তরণ হয়। তবে ফলোআপে থাকতে হবে নিয়মিত।
নাটোরের অকুতোভয় জুলাই যোদ্ধা মিঠুর বাম চোখের আলো নিভে গেছে চিরতরে। রাষ্ট্রের ব্যবস্থাপনায় সিঙ্গাপুরে চিকিৎসা নিলেও আশার আলো নেই। দিশেহারা মিঠু চান সম্মানজনক কাজ আর প্রত্যাশা দ্রুত জুলাই সনদ প্রকাশের।
মিঠু বলেন, সরকারি সহযোগিতায় ২৪ জানুয়ারি থেকে ১৭ মার্চ সিঙ্গাপুরের জেনারেল হাসপাতাল ও আই হাসপাতালে চিকিৎসা নিই। অপারেশনের মাধ্যমে নয়টি স্পিøন্টার বের করা হয়। তবে বাম চোখের পেছনে, ডান কানের উপরে ও পেছনে এবং দাঁতের নীচে-মোট পাঁচটি স্পিøন্টার বের করা সম্ভব হয়নি। চিকিৎসক বলেছেন, আমার অপটিক নার্ভ পুরোপুরি ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে গেছে। বাম চোখে আর দেখতে পারবো না। এখন চোখ ক্রমশ ছোট হয়ে যাচ্ছে, লাল হয়ে আছে, অনবরত পানি পড়ছে আর সার্বক্ষণিক অসহ্য ব্যথা। এভাবেই পুরনো কর্মে ফিরেছি, পরিবারের সবার কথা বিবেচনা করে।
জানা গেছে, প্রান্তিক কৃষক বাবা আব্দুল খালেক নিজেই হৃদরোগী, এরপরও জমি বিক্রি করে সন্তানের পাশে দাঁড়িয়েছেন। সরকার মিঠুর চিকিৎসায় হেলথ কার্ড ছাড়াও দুই লাখ টাকার আর্থিক সহায়তা প্রদান করেছে, উন্নত চিকিৎসার জন্যে নিয়ে গেছে সিঙ্গাপুরে। তবে কষ্টের দিন শেষ হয়নি তার। অথচ সুস্থ থাকলে জীবন যুদ্ধে এগিয়ে যেতেন মিঠু।
মাধববাড়িয়া উচ্চ বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক আসকান আলী জানান, মিঠু ছিঠ মেধাবী শিক্ষার্থী, আচার-আচরণেও অনেক বিনয়ী।
মাধববাড়িয়া বিদ্যালয় আর নাটোরের সিটি কলেজে পড়াশুনার পর্ব শেষ করে মিঠু হেলথ টেকনোলজি অব বরিশাল থেকে রেডিওলজিতে ডিপ্লোমা করেন। এরপর ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন হাসপাতালে দক্ষতার সঙ্গে কাজ করেন। সর্বশেষ সিরাজগঞ্জের ড্যাফোডিল ইন স্পেশালিস্ট হাসপাতালে সিটিস্কান অপারেটর পদে কর্মরত ছিলেন।
বাবা আব্দুল খালেক বলেন, প্রতি মাসে ১০ হাজার টাকার ওষুধ খেতে হয় আমার। নিজের চিকিৎসা বাদ রেখে জমি বিক্রি করে ছেলের চিকিৎসা করিয়েছি। কারণ মিঠুই ছিল সংসারের একমাত্র উপার্জনক্ষম। এখন ও পুরোপুরি কর্মে ফিরতে না পারলে আমাদের কি হবে?।
আর মিঠুর প্রত্যাশা, চোখের অল্প ব্যবহার আর বাড়ির কাছে একটা সম্মানজনক কাজ পেলে জীবনযাপনটা সহজ হয়। এছাড়া পরিবারের সদস্যদের কর্মসংস্থান আর বাবার চিকিৎসায় সরকারসহ ব্যক্তি সহযোগিতা প্রয়োজন। সরকারের কাছে ‘জুলাই সনদ’ অবিলম্বে প্রকাশের দাবি জানাই। আশা করি এই সনদ প্রণয়নে সব দলের মধ্যে ঐক্য থাকবে।