বাসস
  ০৪ আগস্ট ২০২৫, ১৩:৩৬

বাগেরহাটে আন্দোলনকারীদের প্রতিরোধের মুখে পালিয়ে যায় আওয়ামী বাহিনী

৪ আগস্ট বাগেরহাটে নেতা কর্মী ও সাধারণ ছাত্ররা মাঠে নামে। ছবি: বাসস

\ আজাদ রুহুল আমিন \

বাগেরহাট, ৪ আগস্ট, ২০২৫ (বাসস) : ‘কোটা না মেধা? মেধা মেধা’, ‘‎আপোষ না সংগ্রাম? ‎সংগ্রাম সংগ্রাম’, ‘‎তুমি কে আমি কে? ‎রাজাকার রাজাকার’, ‘কে বলেছে কে বলেছে, স্বৈরাচার স্বৈরাচার’, এমনই সব জ্বালাময়ী শ্লোগানে রাজধানী ঢাকাসহ পুরো দেশ যখন হাসিনা বিরোধী আন্দোলনে উত্তপ্ত তখনও বাগেরহাটে নেই কোন প্রতিক্রিয়া এ যেন শেখ হাসিনার পিতৃভূমি আর এক গোপালগঞ্জ। এখানে  কোন মিছিল মিটিং প্রতিবাদ কিছুই নেই। শেখ হেলাল, শেখ তন্ময়, সাবেক ছাত্রলীগ নেতা বদিউজ্জামাল সোহাগ, শেখ মুজিবের সহযোদ্ধা খালেক তালুকদারসহ এমপিদের সন্ত্রাসী বাহিনীর একচ্ছত্র আধিপত্য। কোথাও টু শব্দটি করার ও জো নেই!

সরকার বিরোধী জামায়াত, বিএনপি, ছাত্রদল ও ছাত্রশিবিরের বাগেরহাটের নেতা কর্মীরা তখন কেউ জেলখানায়, কেউ পালিয়ে বেড়াচ্ছে। বাগেরহাটের সন্তানরা ঢাকায় যারা থাকেন তারা আন্দোলনে শহীদ হচ্ছেন। নিজ জেলায় এনে তাদের দাফন করতেও পুলিশ বাধা। নিহতের পরিবারের উপরও হুমকি ও চাপ আসতে থাকে।

আগস্ট মাসের শুরুতেই বাগেরহাট সরকারি স্কুলের ছাত্ররা একটি মিছিল করার চেষ্টা করে। কিন্তু ছাত্রলীগ- যুবলীগের সন্ত্রাসী কর্মী বাহিনী ভয় দেখিয়ে তাদের নিবৃত্ত করে। এরপর সরকারি স্কুল, সরকারি পিসি কলেজসহ সকল গুরুত্বপূর্ণ স্থানে পুলিশ-ছাত্রলীগসহ তাদের পেটোয়াবাহিনী পাহারা বসায়। 

এসব বাধা উপেক্ষা করে ৪ আগস্ট বাগেরহাটের কাটাখালী রামপালের ফয়লাবাজারে ছাত্র শিবিরের নেতা কর্মী ও সাধারণ ছাত্ররা মাঠে নামে। পুলিশের আওয়ামী এসপি (পুলিশ সুপার) আবুল হাসনাতের প্রত্যক্ষ মদদে আওয়ামী লীগ ও তাদের অঙ্গ সংগঠনের সন্ত্রাসীরা ঝাঁপিয়ে পড়ে আন্দোলনের নেতা কর্মীদের ওপর। এতে সাংবাদিকসহ বেশ কিছু ছাত্র ও নেতাকর্মী আহত হন।

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে বাগেরহাট জেলার প্রধান সমন্বয়ক আহমেদ আব্দুলাহ, সমন্বয়ক এস এম সাদ্দাম, সমন্বয়ক সোহেল রানা (মিডিয়া), সমন্বয়ক রনি হাওলাদার, সমন্বয়ক শেখ বাদশা (মিডিয়া+ইনফরমেশন)। জেলার সার্বিক সমন্বয়ের দায়িত্বে ছিলেন ছাত্রশিবিরের সাবেক সভাপতি নাজমুল হাসান সাইফ। ছাত্রশিবিরের অন্যতম নেতা স্বাধীন জেলার অন্যান্য রাজনৈতিক দলের সাথে সমন্বয় করেন। তারা সবাই নেপথ্যে থেকে আন্দোলনের কাজ করছিলেন। 

জুলাই গণ অভ্যুত্থানের স্মৃতিচারণ করে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের বাগেরহাট জেলার সমন্বয়ক (মিডিয়া ও ইনফরমেশন) শেখ বাদশা বাসসকে বলেন, ‘১৮ জুলাই থেকে আমরা বিভিন্ন পয়েন্টে আন্দোলন করার চেষ্টা করি। কিন্তু আওয়ামী লীগ ও তার অঙ্গ সংগঠন এবং পুলিশ সুপার আবুল হাসনাত যিনি এখন কারাবন্দি তার সরাসরি হস্তক্ষেপ, ঔদ্ধত্যপূর্ণ বক্তব্য ও পুলিশের বাধার কারণে আন্দোলনের বেশিরভাগ সময় আমরা রাস্তায় নামতে পারিনি। এসব প্রতিকূলতার ভিতর দিয়েই ৩ আগস্ট রাতে এক অনলাইন মিটিংয়ে আমরা বাগেরহাটে আন্দোলন করার সিদ্ধান্ত নেই।’ 

তিনি বলেন, ‘এর আগে শিবিরের একটি নির্বাহী কমিটির মিটিং হয়। তারা তাদের পক্ষ থেকে আহমেদ আবদুল্লাহকে প্রধান সমন্বয়ক, সোহেল রানাকে মিডিয়া সমন্বয়ক এবং শিবির নেতা রনি হাওলাদারকে সমন্বয়ক হিসেবে দায়িত্ব দেয়।’ 

মিডিয়া ও ইনফরমেশন শাখার সমন্বয়ক সাংবাদিক শেখ বাদশা বলেন, শিবিরের জেলা সভাপতি নাজমুল হাসান সাইফের সাথে আলোচনার ভিত্তিতে বাগেরহাট পৌরসভার শিবির নেতা স্বাধীন ও  বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের আহ্বায়ক এসএম সাদ্দাম ফ্যাসিবাদ বিরোধী বিভিন্ন ছাত্র সংগঠনের সাথে যোগাযোগ করে। সেদিন রাত ৯টা থেকে প্রায় ১১টা পর্যন্ত একটা অনলাইন মিটিং হয়। সেখানে ছাত্র সংগঠনগুলো ঐক্যবদ্ধ হয় এবং ৪ আগস্ট রাস্তায় নামার সিদ্ধান্ত হয়। আন্দোলনকারীদের নিরাপত্তা ও কৌশলগত কারণে তিনটি স্পট রাখা হয়। মূল পয়েন্ট ডিসি অফিসের সামনের খুলনা বাগেরহাট মহাসড়ক নির্ধারণ করা হয়।

তিনি জানান, রাত ১২টার পর কয়েকটি রাজনৈতিক দল মাঠে নামতে অপারগতা প্রকাশ করলেও আন্দোলনের মনোবল ধরে রাখার কৌশল হিসেবে তা গোপন রাখা হয়। পরের দিন সকাল ১০টায় আন্দোলন হওয়ার কথা থাকলেও আন্দোলনকারীদের উপস্থিতি কম থাকায় সাড়ে ১০টায় সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। এরই মধ্যে স্বেচ্ছাসেবক লীগের সাধারণ সম্পাদক সরদার আব্দুল কাদের, পৌরসভার কাউন্সিলর মেয়র হাবি খার ভাইপো সন্ত্রাসী বক্কার খানসহ কয়েকজন আন্দোলনকারীদের উপর হামলা করে। তবে আন্দোলনকারীদের পাল্টা ধাওয়ায় আওয়ামী লীগের সন্ত্রাসী বাহিনী পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়। কিছু সময় পর উপজেলা চেয়ারম্যান ও জেলা যুবলীগের সভাপতি নাসির সর্দার সেসময়ের এমপি শেখ তন্ময়ের পিএস শাহীনের  নেতৃত্বে আগ্নেয়াস্ত্র, রামদা, জিআই পাইপ ও অন্যান্য দেশীয় অস্ত্র নিয়ে আন্দোলনকারীদের ওপর হামলা করে। এতে সমন্বয়ক এসএম সাদ্দামের হাত ভেঙে যায়। গুরুতর আহত হন সামিউল শেখ ও হাফিজুর রহমান। এসময় আরো আহত হন নেয়ামুল, আরমান, রবিউল ইসলাম, আবু আয়ুব আনসারী, আব্দুল্লাহ আল সিনান, রেজওয়ান শেখ, সমন্বয়ক আহমেদ আব্দুল্লাহ, সমন্বয়ক রনি হাওলাদারসহ ৩০ থেকে ৩৫ জন আন্দোলনকারী। সমাবেশে থেকে বাড়ি ফেরার পথে বিভিন্ন স্থানে আওয়ামী হামলায় আহত হন সমন্বয়ক সোহেল রানা, মুসাব্বির, শাহেদসহ আরো ১০ থেকে ১৫ জন। এসময় সমাবেশে অংশগ্রহণকারী নারী শিক্ষার্থী স্নেহা জামানও আহত হন। 

২০২৪ সালের ৫ আগস্ট শেখ হাসিনার পতন হয়। এদিনের অনুভূতি বর্ণনা করে শেখ বাদশা বলেন,‎ ‘হাসিনা যখন পদত্যাগ করে তখন আসলে মনের ভেতর যে আনন্দ হয় তা প্রকাশ করার মতো ভাষা আমার জানা নেই। ১৪ শ শহীদের আত্মত্যাগে ২০ দিনের রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের ওপর যে বিজয়-এই আনন্দ বলে বা লিখে বোঝানো সম্ভব না।

আন্দোলনের একজন সমন্বয়ক ও প্রত্যক্ষদর্শী বাগেরহাট সদর উপজেলার যাত্রাপুর ইউনিয়নের হোসেন আলী শেখের পুত্র শেখ বাদশা। ডেইলি ক্যাম্পাস ও দৈনিক নিরপেক্ষ পত্রিকায় কর্মরত এই সাংবাদিক বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে একজন অন্যতম সক্রিয় নেতা। বর্তমানে তিনি বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের যুগ্ম সদস্য সচিব হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন।

বাদশা বাসসকে বলেন, ‘‎আমরা সবাই চেষ্টা করছি যে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন আলাদা স্বতন্ত্র একটা প্লাটফর্ম হিসেবে থাকুক। সব ফ্যাসিবাদ বিরোধী শক্তিকে একসাথে নিয়ে কাজ চাই। একারণেই ছাত্রশিবির এবং ছাত্রদলের সাথে ঐক্য গড়ে আমরা আমাদের মূল লক্ষ্যে পৌঁছাতে দৃঢ় অঙ্গীকারাবদ্ধ।’