শিরোনাম
\ ওমর ফারুক \
রাজশাহী, ৩ আগস্ট ২০২৫ (বাসস) : ২০২৪ সালের ৩ আগস্ট শনিবার ছাত্রজনতাসহ সাধারণ মানুষের বিক্ষোভে উত্তাল ছিল শিক্ষানগরী রাজশাহী। এদিন সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত রাজপথ বিক্ষোভকারীদের দখলে ছিল। জুলাই গণঅভ্যুথান চলাকালে এদিনই প্রথম রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের আশপাশ ছাড়াও নগরের গুরুত্বপূর্ণ এলাকায় দীর্ঘ সময় ধরে রাস্তা অবরোধ করে বিক্ষোভ করেন আন্দোলনকারীরা।
পাশপাশি আওয়ামী লীগের স্থানীয় কার্যালয় ও পুলিশ বক্স ভাংচুর করে প্রতিরোধ গড়ো তোলেন তারা।
ছাত্রজনতার নজিরবিহীন বিক্ষোভের পর দেশীয় অস্ত্রসহ পাল্টা শোডাউন দেয় আওয়ামী লীগ, যুবলীগ ও ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা। প্রত্যেকের হাতেই দেশীয় অস্ত্র ছিল বলে প্রত্যক্ষদর্শীরা জানিয়েছিল। যদিও তারা বিক্ষোভকারীদের মুখোমুখি হননি।
এই বিক্ষোভে ইসলামী ছাত্রশিবির, জামায়াত ইসলামী, ছাত্রদল, শিক্ষক-শিক্ষিকা, যুবক-কিশোরসহ সব ধরণের মানুষ অংশগ্রহণ করেন। দেশব্যাপী শিক্ষার্থীদের উপর হামলা ও নির্বিচারে মানুষ হত্যার প্রতিবাদে ৯ দফা দাবিতে ঢাকা-রাজশাহী মহাসড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ করেন শিক্ষার্থী ও সাধারণ মানুষ।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ৩ আগস্ট শনিবার সকাল সাড়ে ৯টার পর থেকেই রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের মূল ফটকের সামনে জড়ো হতে থাকেন শিক্ষার্থীরা। এ সময় বিভিন্ন দিক থেক ছাত্রজনতা ও সাধারণ মানুষ আসতে থাকেন। তখন পাশেই অবস্থান করছিলেন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর বিপুল পরিমাণ সদস্য।
সকাল সাড়ে ১০টা থেকে প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় (রুয়েট) এর মূল ফটকের সামনে অবস্থান নেয় শিক্ষার্থীরা। কিছুক্ষণের মধ্যে বৃষ্টি নামলে সেই বৃষ্টি উপেক্ষা করেই বিক্ষোভ মিছিল নিয়ে নগরের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ সড়ক প্রদক্ষিণ করেন তারা। শিক্ষক, শিক্ষার্থীসহ বিভিন্ন শ্রেণী-পেশার মানুষ এতে অংশ নেন।
বিভিন্ন দিক থেকে ছোট-বড় মিছিল নিয়ে আসতে শুরু করেন শিক্ষার্থীরা।
এ আন্দোলনে ছাত্র-জনতার উপস্থিতিকে নজিরবিহীন বিক্ষোভ বলে সেদিন মনে করেছিল নগরবাসী। কারণ এর আগে এত বড় বিক্ষোভ হতে খুব কম দেখেছেন নগরবাসী।
আরো জানা গেছে, বেলা পৌনে ১১টার দিকে নগরের ভদ্রা মোড় থেকে মিছিল নিয়ে রাজশাহী প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় (রুয়েট) গেইট দিয়ে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান ফটকে আসার পর সেখানে অব নেন আন্দোলনকারীরা। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ও রুয়েটের শিক্ষকরাও একাত্মতা পোষণ করে বিক্ষোভে যোগ দেন। এ সময় সরকারবিরোধী নানা ধরণের স্লোগান দিতে দেখা যায় আন্দোলনকারীদের।
বিক্ষোভকারীরা যেসব স্লোগান দিয়েছিল তার মধ্যে ছিল, ‘এক দুই তিন চার, স্বৈরাচার তুই গদি ছাড়,’ ‘শিবির ট্যাগের ছলচাতুরি বুইঝা গেছে জনগণ,’ ‘দফা এক, দাবি এক, স্বৈরাচারের পদত্যাগ’, ‘আবু সাঈদ মরলো কেন? প্রশাসন জবাব চাই’। স্লোগানে স্লোগানে বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়েছিল পুরো নগরীতে। এ সময় যানবাহন চলাচল বন্ধ হয়ে যায়।
পাশেই পুলিশ সদস্যরা অবস্থান করলেও তারা মিছিলে বাধা দেয়নি।
ওই দিন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের কলা অনুষদের সাবেক ডিন অধ্যাপক ড. ফজলুল হক বলেন, শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের সঙ্গে একাত্মতা পোষণ করে আমরা তাদের সঙ্গে যোগ দিয়েছি। আর কত ঘরে বসে আমার ছেলেদের রক্ত দেখবো। শিক্ষার্থীদের গায়ে গুলি করতে স্বৈরাচার সরকারের কি একটুও বুক কাঁপেনি? আজ থেকে এ আন্দোলনে গুলি চালালে সেই গুলি আগে শিক্ষকদের গায়ে লাগবে, তারপর আমাদের ছাত্রদের।
আন্দোলনকারীরা দুপুরের দিকে নগরের কাজলা গেট হয়ে ভদ্রা মোড় পার হয়ে রেলগেট শহীদ কামারুজ্জামান চত্বরে বিক্ষোভ মিছিল নিয়ে গিয়ে সমাবেশ করেন। সেখানে তারা দীর্ঘ সময় বিক্ষোভ করেন। সেখানে তারা রাস্তা অবরোধ করে রাখেন। আগুন ধরিয়ে প্রতিবাদ জানান। আন্দোলনকারীদের কেউ কেউ পাশেই অবস্থিত পুলিশ বক্সে হামলা চালানোর চেষ্টা করেন। যদিও অনেকেই বাধা দেন। সেদিন বৃষ্টি নামলেও বিক্ষুব্ধরা বৃষ্টির মধ্যেই তাদের আন্দোলন কর্মসূচি চালিয়ে যান। পুলিশ সেখানেও সতর্কভাবে অবস্থান নেয়। তবে শিক্ষার্থীদের বিক্ষোভে বাধা দেননি। রেলগেটে অবস্থান করাকালীন আন্দোলনকারীরা সেখানে বিভিন্ন স্লোগান লেখেন।
বিশ্ববিদ্যালয়ের মূল ফটকেও হাসিনার পদত্যাগ নিয়ে স্লোগান লেখেন।
বিক্ষোভ মিছিলে অংশ নিয়েছিলেন, বিএনপি চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়ার উপদেষ্টা ও রাজশাহী সিটি কর্পোরেশনের সাবেক মেয়র ও এমপি মিজানুর রহমান মিনুর সহধর্মিনী অধ্যক্ষ সালমা শাহাদাত।
তার কলেজের কিছু ছাত্রী নিয়ে তিনি মিছিলে অংশ নেন। মিছিলে অংশ নিয়ে তিনি বলেছিলেন, আমার সন্তানদের নির্বিচারে হত্যা করা হবে, আর আমরাতো ঘরে বসে থাকতে পারি না। হাসিনার পদত্যাগ এখন সময়ের দাবি। তিনি পুরো আন্দোলনজুড়েই মাঠে ছিলেন। তাকে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা বাধা দিয়েও আটকাতে পারেননি।
অপরদিকে, রাজশাহী মহানগর আওয়ামী লীগের দলীয় কার্যালয়ের সামনে তাদের নেতাকর্মীরা দেশীয় অস্ত্র নিয়ে প্রকাশ্যে জড়ো হয়। পাশেই পুলিশ অবস্থান করছিল। তারা বিক্ষোভ প্রতিরোধের চেষ্টাও করেন।
তৎকালিন রাজশাহী মহানগর পুলিশের মুখপাত্র ও অতিরিক্ত উপ-পুলিশ কমিশনার জামিরুল ইসলাম বলেছিলেন, পুলিশ আন্দোলনকারীদের বিক্ষোভে বাধা দেয়নি। তাদের নির্বিঘ্নে বিক্ষোভ করতে দেওয়া হয়েছে। কিন্তু এরপরও তারা ৩টি পুলিশ বক্সে হামলা করে ভাংচুরসহ অগ্নিসংযোগ করেছে। পুলিশ সতর্ক অবস্থানে রয়েছে।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্যতম সমন্বয়ক মিশকাত চৌধুরী মিশু বাসস’কে বলেন, পূর্ব পরিকল্পনা অনুযায়ী আন্দোলনে যাদের যোগ দেওয়ার কথা ছিল বিভিন্ন স্কুল কলেজের শিক্ষার্থীসহ, ছাত্রশিবির ও ছাত্রদলের নেতাকর্মীরা এবং অন্যান্য যারা বিক্ষোভে যোগ দিয়েছিলেন সবাইকে আমরা একস্থানে জড়ো হওয়ার আহবান জানিয়েছিলাম।
কৌশলগত কারণে আমরা যেদিকে যাবো, সেদিকের কথা প্রকাশ করিনি। যাতে ছাত্রলীগ ও যুবলীগের সন্ত্রাসীরা পাল্টা প্রতিরোধ করতে না পারে। আমরা কোনদিকে বিক্ষোভ মিছিল নিয়ে অগ্রসর হবো তা তাৎক্ষনিক সিদ্ধান্ত নিয়েছি।
তিনি বলেন, ৩ আগস্ট আমরা সফলভাবে কর্মসূচি বাস্তবায়ন করেছিলাম। এদিন আমরা মিছিল নিয়ে চলে আসার পরে ছাত্রলীগ, যুবলীগ অস্ত্র নিয়ে শোডাউন দিয়েছিল। আমাদের আন্দোলনরত কয়েকজন শিক্ষার্থীকে একা পেয়ে মারধরও করেছিল।
আমরা সেদিন সবাইকে সাথে নিয়ে বিক্ষোভ করেছি। এই বিক্ষোভে সবার অংশগ্রহণ ছিল। আমাদের দাবির প্রতি আমরা অনড় ছিলাম।
মিশু বলেন, আমরা কখনো পেশি শক্তির কাছে হার মানিনি। আমরা পুরো সময়টাতে শান্তিপূর্ণভাবে থাকার চেষ্টা করেছি। ওই মিছিলের পর থেকে আমাদের আরো বেশি করে খোঁজা হচ্ছিল। নগরজুড়ে পুলিশি অভিযান আরো বেড়ে যায়। উদ্দেশ্য ছিল আমাদের গ্রেপ্তার করে আন্দোলন বানচাল করা, কিন্ত তারা সফল হয়নি।