শিরোনাম
\ দেলোয়ার হোসাইন আকাইদ \
কুমিল্লা, ৩ আগস্ট (বাসস) : বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের পূর্ব ঘোষিত বিক্ষোভ কর্মসূচিকে ঘিরে ৩ আগস্ট শনিবার উত্তাল হয়ে ওঠে কুমিল্লা। সেদিন সকাল থেকেই নগরীর বিভিন্ন এলাকায় শিক্ষার্থীদের শান্তিপূর্ণ কর্মসূচিতে আওয়ামী লীগ, যুবলীগ, স্বেচ্ছাসেবক লীগ ও ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা ধারাবাহিকভাবে হামলা চালায়।
গুলিবর্ষণসহ ব্যাপক হামলায় অন্তত ৫০ জন আহত হন। তাদের মধ্যে ৬ জন শিক্ষার্থী গুলিবিদ্ধ অবস্থায় হাসপাতালে ভর্তি হন।
সকালে কুমিল্লা জিলা স্কুল প্রাঙ্গণে আন্দোলনকারীদের সমাবেশ থেকে বিক্ষোভ শুরু হয়। সকাল ১০টা থেকেই জেলার বিভিন্ন স্কুলকলেজের শিক্ষার্থীরা জিলা স্কুলের সামনে জড়ো হন। পরে গেটের তালা ভেঙে শিক্ষার্থীরা ভেতরে প্রবেশ করে। মিছিলে কুমিল্লা জিলা স্কুল, নবাব ফয়জুন্নেছা সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়, কালেক্টরেট স্কুল, কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা অংশ নেন।
প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, বিক্ষোভ মিছিলটি পুলিশ লাইন্সের দিকে অগ্রসর হলে হঠাৎ করে পেছন থেকে ছাত্রলীগ, যুবলীগ ও স্বেচ্ছাসেবক লীগের নেতা-কর্মীরা ধাওয়া দেন। তারা শিক্ষার্থীদের লক্ষ্য করে গুলি চালান। এতে কুমিল্লা মডার্ন হাই স্কুলের আরফান মজুমদার (১৬), কুমিল্লা সরকারি কলেজের সৌরভ চক্রবর্তী (২৫) ও আসিফ (১৮), ঢাকার সফিউদ্দিন স্কুলের মারুফ (১৬), নগরীর ঠাকুরপাড়ার মৃদুল (১৭) এবং টমছম ব্রিজ এলাকার সুজন (১৮) গুলিবিদ্ধ হন। আহতদের কুমিল্লা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল ও বিভিন্ন প্রাইভেট হাসপাতালে ভর্তি করা হয়।
এদিন নগরীর পুবালী চত্বর, রানীর দিঘির পাড় ও বাগিচাগাঁও এলাকায়ও শিক্ষার্থীদের মিছিলে হামলার ঘটনা ঘটে। ছাত্রলীগ-যুবলীগের কর্মীরা হকিস্টিক, লাঠি ও স্ট্যাম্প দিয়ে শিক্ষার্থীদের উপর হামলা চালায়। বাগিচাগাঁও ও পুলিশ লাইন্স এলাকায় শিক্ষার্থীদের উপর গুলি ছোড়া হয়।
চান্দিনা উপজেলায় দুপুরে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের কর্মসূচি চলাকালে উপজেলা ভূমি কর্মকর্তা (এসিল্যান্ড) সৌম্য সরকারের গাড়িতে আগুন দেওয়ার ঘটনা ঘটে।
ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের চান্দিনা বাসস্ট্যান্ড এলাকায় বিক্ষুব্ধরা গাড়িটিতে আগুন ধরিয়ে দেয়। ওই সময় গাড়ির ভেতরে থাকা এসিল্যান্ড ও কর্মচারীরা তাড়াহুড়ো করে বের হয়ে প্রাণে রক্ষা পান। বিকেলে কাঠেরপুর এলাকায় জেলা মৎস্য কর্মকর্তার গাড়িতেও একই ধরনের ঘটনা ঘটে।
এদিন কুমিল্লা-সিলেট আঞ্চলিক মহাসড়কের মুরাদনগরের কোম্পানীগঞ্জ ও দেবিদ্বার উপজেলার ভিংলাবাড়ি এলাকায় শিক্ষার্থীরা অবস্থান নেয়। বাঁশ ও গাছের গুঁড়ি ফেলে সড়কে যান চলাচল বন্ধ করে দেওয়া হয়। এতে প্রায় পাঁচ কিলোমিটার জুড়ে যানজটের সৃষ্টি হয়। তবে জরুরি অ্যাম্বুলেন্স ও রোগীদের জন্য পথ উন্মুক্ত রাখা হয়।
শিক্ষার্থীদের হাতে বাঁশ-লাঠি, মাথায় জাতীয় পতাকা ও মুখে লাল ফিতা বাধা ছিল। সড়কে বসে তারা স্লোগান, কবিতা ও দেশাত্মবোধক গান পরিবেশন করেন। সাধারণ মানুষও আন্দোলনকারীদের পাশে দাঁড়ায় এবং স্থানীয় দোকানদাররা তাদের বিনামূল্যে পানি ও নাস্তা সরবরাহ করেন।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে স্থানীয় সমন্বয়কারী নাছির উদ্দিন জুলাই আন্দোলনের স্মৃতিচারণ করে বাসসকে বলেন, ‘আমাদের এক দফা দাবি, শেখ হাসিনার পদত্যাগ।
যারা আমার ভাইদের গুলি করে হত্যা করেছে, তাদের বিচারের দাবিতে রাজপথে ছিলাম। তাই দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত আমরা আন্দোলন চালিয়ে যাই।’
আন্দোলনের প্রতি সংহতি প্রকাশ করে কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের (কুবি) ৫১ জন শিক্ষক ৩ আগস্ট এক বিবৃতি দেন। গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক মাহবুবুল হক ভূঁইয়ার স্বাক্ষরিত এ বিবৃতিতে শিক্ষার্থীদের উপর গুলি চালানো, নির্যাতন ও হয়রানিমূলক গ্রেপ্তারের নিন্দা জানানো হয়। বিবৃতিতে বলা হয়, ‘দেশের ভবিষ্যৎ শিক্ষার্থীদের উপর এমন হামলা গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ গড়ার পথে বড় বাধা।’ তারা অবিলম্বে নিরপেক্ষ তদন্তের মাধ্যমে হামলাকারীদের বিচার এবং গণতন্ত্রের চর্চার পরিবেশ নিশ্চিত করার দাবি জানান।
এদিকে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের শিক্ষার্থীদের উপর হামলা, গুলি বর্ষণ ও নির্যাতনের প্রতিবাদে জাতীয়তাবাদী আইনজীবী ফোরাম কুমিল্লা জেলা ইউনিট তাৎক্ষণিকভাবে বিক্ষোভ সমাবেশ ও মিছিলের আয়োজন করে। সংগঠনের সভাপতি অ্যাডভোকেট কাইমুল হক রিংকুর নেতৃত্বে কুমিল্লা আদালত প্রাঙ্গণ থেকে বিক্ষোভ মিছিল বের হয়। এ সময় আইনজীবীরা শিক্ষার্থীদের পাশে দাঁড়ানোর ঘোষণা দেন এবং আন্দোলনকারীদের বিনা পারিশ্রমিকে সব ধরনের আইনি সহায়তা দেওয়ার অঙ্গীকার করেন।
জুলাই অভ্যুত্থানের স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে কুমিল্লা জেলা পিপি অ্যাডভোকেট কাইমুল হক রিংকু বাসসকে বলেন, ‘সরকার মেধাবী ছাত্রদের গুলি করে হত্যা করে, হাজার হাজার শিক্ষার্থীর নামে মামলা দিয়ে গণতন্ত্র ও দেশের ভবিষ্যতকে হত্যার চেষ্টা করেছিল। একজন সচেতন নাগরিক হিসেবে আমরা সেদিন ছাত্রদের ন্যায্য দাবির পাশে দাঁড়িয়েছিলাম। কুমিল্লার আদালতের সকল আইনজীবী ঐদিন ঘোষণা দিয়েছিলাম, আমরা বিনা পারিশ্রমিকে তাদের সব ধরনের আইনগত সহায়তা প্রদান করব। একই সঙ্গে জনগণের দাবিকে শক্তিশালী করতে আমরা ‘ফ্যাসিস্ট হাসিনা সরকারের পতনের একদফা আন্দোলনের’ ডাক দিয়েছিলাম।’
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়ক প্রকৌশলী মো. রাশেদুল হাসান সেদিনের স্মৃতিচারণ করে বাসসকে বলেন, ‘সেদিন সকাল ৯টায় আমরা আন্দোলনের প্রস্তুতি নিতে জিলা স্কুলে যাই। গেটের তালা ভেঙে প্রবেশ করলেও সিদ্ধান্ত নিই বাইরে থেকে রাস্তা অবরোধ করব। বেলা বাড়ার সাথে সাথে প্রশাসনের সাথে তর্কবিতর্কের পর তারা আমাদের পুলিশ লাইনের দিকে সেফ এক্সিট দেয়। ঠিক ১২টায় কুমিল্লার ইতিহাসের সবচেয়ে বড় মিছিল শুরু হয়। স্টেডিয়াম থেকে জেলা পরিষদ পর্যন্ত মেয়েদের উপস্থিতি ছিল চোখে পড়ার মতো। কিন্তু সেই মিছিলে ন্যাক্কারজনক হামলা চালায় আওয়ামী লীগের সন্ত্রাসীরা।’
তিনি আরও বলেন, ‘তৎকালীন প্রশাসন শান্তিপূর্ণ সমাধানের পরিবর্তে শিক্ষার্থীদের ওপর হামলা করে পরিস্থিতিকে সংঘর্ষে রূপান্তরিত করে। রাতে সোশ্যাল মিডিয়ায় লাইভে এসে কুমিল্লার ঘটনার কথা তুলে ধরেছিলাম, যাতে সবাই জানতে পারে কী ভয়ংকর নির্যাতন হয়েছিল আমাদের উপর।’
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের আহ্বানে পরদিন ৪ আগস্ট থেকে সর্বাত্মক অসহযোগ আন্দোলনের ঘোষণা দেওয়া হয়।
৩ আগস্ট কুমিল্লার রক্তাক্ত ঘটনার মধ্য দিয়ে আন্দোলন আরও বিস্তৃত আকার নেয়।