শিরোনাম
।। মুহাম্মদ নূরুজ্জামান।।
খুলনা, ২ আগস্ট ২০২৫ (বাসস) : বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের শেষ দিকে খুলনায় চূড়ান্ত পর্যায়ের লড়াই শুরু হয় চব্বিশের ২ আগস্ট। এ দিন ছাত্র-জনতার গণ মিছিলকে বাধাগ্রস্ত করতে স্বৈরাচার শেখ হাসিনার লাঠিয়াল বাহিনী পুলিশ নিরীহ ছাত্র ও সাধারণ জনতার উপর হায়েনার মত ঝাঁপিয়ে পড়ে। রাবার বুলেট, টিয়ারশেল, সাউন্ড ও লাঠিচার্জে বহু সংখ্যক ছাত্র-জনতা আহত হয়। ক্ষুব্ধ জনতার রোষানলে পড়ে পুলিশের গাড়িতে অগ্নিসংযোগ করা হয়। এসব হামলা-পাল্টা হামলা, ধাওয়া ও পাল্টা ধাওয়ার এক পর্যায়ে পুলিশের একজন কনস্টেবল নিহত হন।
২ আগস্ট শুক্রবার জুমার নামাজ শেষে দুপুর ২টার দিকে খুলনার নিউ মার্কেট এলাকা থেকে পুলিশের বাঁধা উপেক্ষা করে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ডাকা গণমিছিল শুরু হয়। মিছিলটি শান্তিপূর্ণভাবে গল্লামারী মোড়ে পৌঁছায়। এরপরই জিরোপয়েন্টের দিক থেকে পুলিশ মিছিল লক্ষ্য করে টিয়ারসেল ছোড়ে। এ সময় পুলিশের সঙ্গে শিক্ষার্থীদের ধাওয়া পালটা ধাওয়া এবং ইটপাটকেল নিক্ষেপের ঘটনা ঘটে। এ সময় শিক্ষার্থীদের সঙ্গে স্থানীয় জনতাও যোগ দেয়। পরে বিপুল সংখ্যক আন্দোলনকারী মিছিল নিয়ে এগিয়ে গেলে পুলিশ ধীরে ধীরে পিছু হটে যায়। আন্দোলনকারীরা জিরোপয়েন্টে অবস্থান নেয়।
আন্দোলনে অংশগ্রহণকারী শিক্ষার্থীদের সাথে কথা বলে জানা যায়, দুপুরে আন্দোলনকারীদের সরিয়ে দেওয়া নিয়ে বিকেল ৪টার দিকে পুলিশের সাথে ছাত্রদের দ্বিতীয় দফা সংঘর্ষ শুরু হয়। জিরোপয়েন্ট মোড়ে অবস্থান নেয়া শিক্ষার্থীদের দুই পাশ দিয়ে ঘিরে রাখে পুলিশ। শিক্ষার্থীদের লক্ষ্য করে পুলিশ একের পর এক টিয়ালসেল ও রাবার বুলেট ছোড়ে বলে অভিযোগ করেন শিক্ষার্থীরা। এতে বেশ কয়েকজন শিক্ষার্থী আহত হন। এছাড়া শিক্ষার্থীদের একটি অংশ খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের সামনে অবস্থান নেয়। তাদেরও সাঁজোয়া যান নিয়ে ঘিরে রাখে পুলিশ। সেখানেও টান টান উত্তেজনা বিরাজ করে।
তারা জানান, ছাত্র-জনতার গণমিছিল কর্মসূচিকে কেন্দ্র করে আন্দোলনকারী ও পুলিশের মধ্যে সংঘর্ষ প্রায় এক ঘণ্টা পর নিয়ন্ত্রণে আসে। আন্দোলনকারীরা শান্তিপূর্ণভাবে সমাবেশ করবে এমন আশ্বাসে পুলিশ পিছু হটে যায়। পরে তারা খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান ফটকের সামনে সমাবেশ শুরু করে। সমাবেশ শেষে বিকেলে তারা মিছিল নিয়ে শিববাড়ি মোড়ের দিকে যেতে চাইলে পুলিশ বাধা দেয়। এ সময় আবার সংঘর্ষ শুরু হয়। এ নিয়ে একই দিনে শিক্ষার্থীদের সঙ্গে তৃতীয় দফায় সংঘর্ষে জড়ায় পুলিশ। এ সময় পুলিশ মুহুর্মুহু টিয়ার সেল ও রাবার বুলেট ছোড়ে। পুরো গল্লামারী এলাকা রণক্ষেত্রে পরিণত হয়। এতে এক পথচারীসহ কমপক্ষে ৬ জন গুলিবিদ্ধ হন। গল্লামারী ব্রিজের এক পাশে শিক্ষার্থী ও অপর পাশে অবস্থান নেয় পুলিশ। এ সময় পুলিশ শিক্ষার্থীদের লক্ষ্য করে অসংখ্য টিয়ারশেল ও রাবার বুলেট ও সাউন্ড গ্রেনেড নিক্ষেপ করে। শিক্ষার্থীরাও পুলিশকে লক্ষ্য করে ইটপাটকেল ছোড়ে। বিক্ষুব্ধ আন্দোলনকারীরা পুলিশের একটি পিকআপে আগুন ধরিয়ে দেয়।
২ আগস্ট সন্ধ্যা ৭টা পর্যন্ত গুলিবিদ্ধ (রাবার বুলেট ও শটগানের ছররা) অবস্থায় ৭ জনসহ ১৬ জনকে খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। সন্ধ্যা সাড়ে ৬টার দিকে পুলিশ পিছু হটলে পরিস্থিতি শান্ত হয়।
খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ জানায়, সংঘর্ষের পর সিরাজুল ইসলাম, আবির, নীরব, নাবিল, মিজান, সৌরভ, আবদুল্লাহ, রায়েব সুলতানা রাইবা এবং রুবিনা ইয়াসমিনকে গুলিবিদ্ধ অবস্থায় হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। তাদের শরীরে রাবার বুলেট ও শটগানের ছররা গুলি লাগে। এছাড়া আরো কয়েকজন ব্যক্তিগতভাবে প্রাথমিক চিকিৎসা নিয়ে চলে যান।
চিকিৎসকরা জানান, আহতদের অনেকের দেহে গুলি লেগেছে। এদের মধ্যে সিরাজুল ইসলাম নামে এক ব্যক্তির কপালে রবার বুলেটবিদ্ধ অবস্থায় হাসপাতালে আসেন। জরুরি ভিত্তিতে অপারেশনের মাধ্যমে তার কপালের বুলেট বের করা হয়েছে। হাসপাতালে চিকিৎসা নেওয়া কমপক্ষে ৭/৮জনের শরীরে গুলি রয়েছে। বাকিরা টিয়ারসেল, রাবার বুলেট ও ইটের আঘাতে আহত হয়েছেন।
আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের অভিযোগ, পুলিশ এদিন শান্তিপূর্ণ মিছিলে পরিকল্পিতভাবে হামলা চালিয়েছে।
বিভিন্নস্থানে বাধা সৃষ্টি করেছে। আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা নির্বিচারে টিয়ারসেল ও গুলি ছুঁড়েছে। এতে অসংখ্য শিক্ষার্থী আহত হয়েছেন।
খুলনা মেট্রোপলিটন পুলিশের কমিশনারের কার্যালয় সূত্রে জানা যায়, ২ আগস্ট ২০২৪ এ শিক্ষার্থীদের সঙ্গে পুলিশের দফায় দফায় সংঘর্ষে সুমন ঘরামি (৩৩) নামে এক পুলিশ সদস্য নিহত হন। তিনি খুলনা পুলিশ লাইন্সে কর্মরত ছিলেন। সংঘর্ষে কর্তব্যরত ২০-২৫ জন পুলিশ গুরুতর আহত হন। কনস্টেবল সুমন কুমার ঘরামি নিহত হন।
এ বিষয়ে বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলন খুলনা মহানগর শাখার আহ্বায়ক আল শাহরিয়ার বলেন, ‘জেলের দেয়াল কখনো কোনো আন্দোলন থামাতে পারেনি, পারবেও না। ইতিহাস সাক্ষী, কারাগারেই জন্ম নিয়েছে মুক্তির জয়গান।’
তিনি আন্দোলনে অংশগ্রহণকারী নারীদের ভূমিকার জন্য তাদের ধন্যবাদ জানান। পুলিশের গ্রেফতারের হাত থেকে কৌশলে ফিরে আসা শাম্মী ইসলামের নির্ভীক নেতৃত্বের প্রশংসা করেন। আফসারি হাসান অপরুপা, হাফসা, স্নিগ্ধা, মুন্নিসহ যেসব ছাত্রীরা পুলিশের হাতে গ্রেফতার হয়েছিলেন তাদের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানান।