বাসস
  ০১ আগস্ট ২০২৫, ১৬:১৯

নির্বাচন ব্যবস্থাকে ধ্বংস করে দেয়ায় আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে গণঅভ্যুত্থান অনিবার্য ছিল : মাহফুজ আলম

তথ্য ও সম্প্রচার উপদেষ্টা মাহফুজ আলম। ফাইল ছবি

\ জুবায়ের ইবনে কামাল \

ঢাকা, ১ আগস্ট , ২০২৫ (বাসস) : জুলাই অভ্যুত্থান চলাকালীন আন্দোলনকে বেগবান করতে সামনে থেকে সমন্বয়ের পাশাপাশি আড়ালে থেকে যারা নেতৃত্ব দিয়েছিলেন, মাহফুজ আলম তাদের একজন। আন্দোলন চলাকালে আওয়ামী সরকারের ব্যাপক হত্যাকাণ্ড ও গণ গ্রেফতারের মধ্যেও আন্দোলনটিকে সচল রাখার কাজ করেছিলেন তিনি।

জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের ৭৯তম অধিবেশনের ফাঁকে সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটনের 'ক্লিনটন গ্লোবাল ইনিশিয়েটিভ লিডার্স স্টেজ' অনুষ্ঠানে অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস তাকে চব্বিশের জুলাই অভ্যুত্থানে নেপথ্যের নায়ক হিসেবে পরিচয় করিয়ে দেন।

মাহফুজ আলম জন্মগ্রহণ করেন ১৯৯৮ সালে লক্ষ্মীপুরে। তিনি চাঁদপুরের একটি মাদ্রাসা থেকে দাখিল (এসএসসি), রাজধানীর তামিরুল মিল্লাত কামিল মাদ্রাসা থেকে আলিম (এইচএসসি) সম্পন্ন করেন। ২০১৫-১৬ সেশনে মাহফুজ আলম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগে ভর্তি হন।

বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নকালেই তিনি সিনেমা ও সাহিত্য নিয়ে একাধিক কাজ করেছেন। নিয়মিত পাঠচক্র করার পাশাপাশি অনিয়মিত ম্যাগাজিন প্রকাশের সঙ্গেও জড়িত থেকেছেন। জুলাই অভ্যুত্থানের সময় বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের লিঁয়াজো কমিটির একজন ছিলেন মাহফুজ আলম। ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের পর অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের বিশেষ সহকারী হিসেবে নিয়োগ পান তিনি। এ বছরের ফেব্রুয়ারিতে তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা হিসেবে শপথ নেন মাহফুজ আলম।

বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থা (বাসস)’কে দেওয়া এক বিশেষ সাক্ষাৎকারে জুলাই অভ্যুত্থানের প্রেক্ষাপট, ছাত্র-জনতার আকাঙ্ক্ষার সঙ্গে সাংস্কৃতিক সম্পর্ক ও আধুনিক রাষ্ট্র গঠন নিয়ে কথা বলেছেন মাহফুজ আলম। সাক্ষাৎকারটি নিয়েছেন বাসসের প্রতিবেদক জুবায়ের ইবনে কামাল।

বাসস: আপনার কাছে কোন কোন ঘটনাগুলো জুলাই অভ্যুত্থানকে অনিবার্য করে তুলেছিল?

মাহফুজ আলম : আওয়ামী লীগ মূলত শাপলা-শাহবাগের বাইনারির দ্বারা এমন একটা রাষ্ট্রীয় বিভাজন সামনে এনেছিল, যেখানে রাষ্ট্রকে হয় ইসলামিস্ট না হয় সেক্যুলার করার একটা দৃশ্য দেখানো হয়েছিল। এসব বিভাজনের আড়ালে মূলত ২০১৪ সালের নির্বাচনকে কুক্ষিগত করা হয়েছে। ২০১৫ সালে বিএনপির অসহযোগ আন্দোলন আর আওয়ামী সরকারের দমন নিপীড়নের মাধ্যমে ‘বিরোধী দলের অস্তিত্বহীন’ একটা স্টাইলে বাংলাদেশকে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। বিরোধীদল শুন্যতার প্রেক্ষাপটেই দেখতে হবে ভ্যাট আন্দোলন ও নিরাপদ সড়ক আন্দোলন। তারপর ডাকসু নির্বাচন। আমরা যদি ২০১৮ সাল পর্যন্ত এই তিনটা বিগ ইভেন্ট হিসেবে ধরি, তাহলে ১৮ সালের রাতের নির্বাচনের পর ধীরে সুস্থে একটা ঘটনা ঘটছিল। আর সেটা হলো, মুজিববাদী সংগঠনগুলোর বাইরে তরুণদের একটা ডেমোক্রেটিক প্রেসার গ্রুপের আবির্ভাব ঘটছিল। 

নিয়মতান্ত্রিক রাজনীতির বাইরে থাকলেও তারা কিন্তু আসলে একটা পলিটিক্যাল ফ্রন্টই ছিল, যা আমরা এখন দেখতে পাচ্ছি।

যেহেতু ১৮ সালের আন্দোলনে অংশ নেয়া কলেজে পড়ুয়া ছেলেমেয়েরাই চব্বিশের অভ্যুত্থানে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ছিল, তাই তাদের কাছে গত কয়েক বছরের আওয়ামী দুঃশাসনের চিত্রটা চোখের সামনে পরিষ্কার দৃশ্যমান ছিল। ফলে এই আন্দোলনে রাজনৈতিক সচেতনভাবে তাদের অংশ নেওয়াটা সহজ ছিল।

এর বাইরেও যেই আন্দোলনের কথা উল্লেখ না করলেই না, তা হলো সীমান্ত হত্যা বিরোধী আন্দোলন। 

ভারতের আগ্রাসনের কারণে যে সীমান্তে অহরহ হত্যাকাণ্ড হচ্ছে, হাসিনা যে একটা পুতুল সরকারে পরিণত হয়েছিল -এই আন্দোলনটা ভারতের এই ভয়ঙ্কর আগ্রাসনের বিষয়গুলো প্রথম পাবলিক ফেয়ারে এনে দিলো।

অন্যদিকে বিশ্বজিৎ দাস হত্যাকাণ্ডের মাধ্যমে ২০১৩ সাল থেকে ১৮ সাল পর্যন্ত ছিল শিবির সন্দেহে পিটিয়ে মেরে ফেলার একটি কালচার বজায় রাখা হয়েছিল। আবরার ফাহাদের শাহাদাতের পর এটা অনেকটা কমে আসে। আবরার ফাহাদের শহীদ হওয়ার ঘটনাটা আমাদের ভেতর বড় একটা সংবেদনশীলতা তৈরি করেছিল।

একদিকে আওয়ামী লীগের এমন দানব হয়ে ওঠা, আরেকদিকে ধীরে ধীরে আওয়ামী লীগ তৈরিকৃত বয়ানগুলোকে ধরে ধরে প্রতিরোধ গড়ে ওঠা, সব মিলিয়েই একটি ছাত্র-নাগরিক অভ্যুত্থান অনিবার্য হয়ে উঠেছিল।

বাসস: ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের বাইরে স্বৈরাচার পতনের বিকল্প কোন উপায় কি ছিল?

মাহফুজ আলম: সত্যি বলতে নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলন বা রাজনীতি করে স্বৈরাচারী আওয়ামী লীগকে নামানোর কোন উপায় ছিল না। কারণ গণতান্ত্রিকভাবে ক্ষমতা হস্তান্তরের প্রক্রিয়া নির্বাচন ব্যবস্থাকে আওয়ামী লীগ সম্পূর্ণরূপে নষ্ট করে দিয়েছিল, ১৮ সালে নির্বাচনে গিয়ে বিএনপি প্রতারিত হয়েছিল। তাছাড়া বিরোধী দলের অস্তিত্বকে বিলীন করে দেওয়ার মাধ্যমে আসলে আওয়ামী লীগ ক্ষমতা থেকে নামার সব পথ বন্ধ করে দিয়েছিল।

সেনাবাহিনী টেক ওভার করার একটা পদ্ধতি ছিল। বিডিআর ম্যাসাকার থেকে শুরু করে বিভিন্ন পলিটিক্যাল বিষয়ে জড়িয়ে নৈতিক শক্তি যেটাকে বলে, তা ভেঙে দেওয়া হয়েছিল। এছাড়াও ১/১১ সরকারের ব্যর্থতা সেনাবাহিনীর মাথায় ছিল। যেভাবে শেখ হাসিনা ও তার নিরাপত্তা উপদেষ্টা তারেক সিদ্দিকী দ্বারা যেভাবে সেনাবাহিনী ব্যবহার হয়েছিল, তাতে আসলে সেনাবাহিনীর মোরালিটি ভেঙে পড়েছিল। তাই আর্মির ক্ষমতা টেক ওভার করার প্রক্রিয়াও আসলে বাস্তবিক ছিল না।

তাই এই কাজ এমন একটা ফ্রন্টেরই করা দরকার ছিল, যারা অতোটা শত্রুভাবাপন্ন নয়। জনতা অপেক্ষা করছিল সত্যিকারের নেতৃত্ব। তাই ছাত্ররা সামনে এলেই শ্রমিক-জনতা নেমে গিয়েছিল। তাই বলা যায়, শেখ হাসিনা পতনের জন্য গণঅভ্যুত্থান অনিবার্য ছিল।

বাসস: এর আগের আন্দোলনগুলো সফল না হওয়ার পেছনে একটা বড় কারণ ছিল ‘মতানৈক্য’। কিন্তু জুলাই অভ্যুত্থানে কীভাবে একদমই ভিন্ন আদর্শের মানুষেরা এক হয়ে গিয়েছিল?

মাহফুজ আলম: সত্যি বলতে কি সব আন্দোলনেই কম্প্রোমাইজিং এলিমেন্ট থাকে। এই আন্দোলনে ছিল না তা না; বরং এই আন্দোলনেও কম্প্রোমাইজিং বিষয় ছিল। কিন্তু আমরা ৭-৮ বছর ধরে ক্যাম্পাসে এক্টিভিজম করার কারণে কম্প্রোমাইজিং বিষয়গুলো সম্পর্কে আমরা জানতাম। আর প্রত্যেকটা জায়গাতেই কিছু কম্প্রোমাইজিং চরিত্র থাকে, আমরা তাদের চিনতাম। তাই এবার শুরুতেই আমরা বিষয়টা নিয়ে কনসার্ন ছিলাম এবং যেসব জায়গায় মতানৈক্য থাকতে পারে তা আমরা আগেই ডিল করে ফেলেছিলাম।

কিছু মানুষ তো ছিলই যারা বিভাজন তৈরি করতে পারতো, তবে আমরা আর সেই সুযোগ রাখেনি। তাই স্বাভাবিকভাবেই গণঅভ্যুত্থানের দিকে আমরা ঐক্যবদ্ধভাবে এগিয়ে যেতে পেরেছিলাম।

বাসস: আমরা দেখতে পাই জুলাই অভ্যুত্থানের সামনের সারিতে থাকা বেশিরভাগ ছাত্রদেরই সাংস্কৃতিক একটা বোঝাপড়া ছিল। কেউ হয়তো নিয়মিত পাঠচক্র করতেন, কেউ বই নিয়ে রিভিউ করতেন, কেউবা হয়তো ম্যাগাজিন বের করতেন। সাংস্কৃতিক বোঝাপড়াটা এই অভ্যুত্থানে কেমন প্রভাব ফেলেছিল?

মাহফুজ আলম: এটা বেশ গুরুত্বপূর্ণ আলাপ। আমি কিন্তু কথাই শুরু করেছিলাম শাপলা-শাহবাগের বিভাজন নিয়ে। শাপলা-শাহবাগ কিন্তু মূলত সাংস্কৃতিক বিভাজনই।

সাংস্কৃতিক বিভাজন যে কত শক্তিশালী, তার প্রমাণ তো ১৩ সালে দেখতেই পাই। কালচারালি আপনি দেশটাকে দুই ভাগে ভাগ করে ফেলেছিলেন।

ফলে আমাদের এমন একটা গ্রুপের দরকার ছিল, যারা সরাসরি ইসলামিস্টও না, আবার যারা ইসলামোফোবিকও না। এরকম একটা রেয়ার ব্র্যান্ড দরকার ছিল, বা রেয়ার প্রজন্মও বলা যায়।

এরকম একটা গ্রুপের দরকার ছিল যারা ইসলামফোবিক না। যাদের কারণে দেখা যাবে আলেমরা তাদের প্রতি অস্বস্তি বোধ করে না কিংবা এটা বোধ করে না যে তাদের সাথে চললে প্রতারিত হবে। আবার অ্যাট দা সেম টাইম ইসলামিস্ট না, এর ফলে সেক্যুলাররা মনে করবে না যে এরা বোধহয় ইসলামি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার জন্য বা অন্য কোন ভিন্ন মোটিভে কাজ করছে। সেক্ষেত্রে একটা মধ্যপন্থার দরকার ছিল। আর এই মধ্যপন্থাটা আমরা খুঁজে পেয়েছিলাম মাদ্রাসার শিক্ষার্থীদের মাঝে, কলেজ-ভার্সিটির ছেলেমেয়েদের মাঝে, এমনকি গ্রাম ও শহুরে জীবন যাপন করা মানুষের মাঝে। আর এর মাধ্যমেই বৈচিত্রপূর্ণ মানুষের একটা ঐক্য ঘটেছিল।

যেহেতু মুজিববাদী রাজনীতির মূলমন্ত্রই ছিল বিভাজন, তাই বিএনপির মতো দলও অস্বস্তিতে থাকতো যে তাদের সাথে আলেমদের নেয়া উচিত কিনা। আলেমরাও ধীরে ধীরে বিরোধী দলগুলো থেকে প্রতারিত হচ্ছিল। তাই বিভাজনের যে রাজনীতি আওয়ামী লীগ করতো, তা আরও সফল হচ্ছিল।

তখন আমরা ভাবছিলাম, জিনিসটা কীভাবে করা যায়। কী এমন ম্যানিফেস্টো তৈরি করা যায়, যাতে একটা গ্রুপ নিয়ে আরেকটা গ্রুপের অস্বস্তি থাকবে না, আরেকটা গ্রুপ আদারিং ফিল করবে না, মুজিববাদী বিভাজনের রাজনীতির বাইরে বৈচিত্রপূর্ণ ভিন্ন ভিন্ন দলের মানুষের মত ও আদর্শকে কীভাবে একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক সাংস্কৃতিক বোঝাপড়ার ভেতর নিয়ে আসা যায়, তা নিয়ে আমরা বহুদিন ধরে কাজ করেছি। কিছু কাজ পেছনে হতো, কিছু এক্টিভিটি সামনে হতো। এজন্য একেক সময় একেকজন সামনে থাকতো।

কখনও আখতার (এনসিপির সদস্য সচিব) সামনে থাকতো, কখনও আকরাম (এনসিপির যুগ্ম সদস্য সচিব), অথবা কখনও সামনে থাকতো নাসির উদ্দিন পাটোয়ারি। এরা সবাই আসলে আমাদের একই সার্কেলের ছিল, প্রয়োজন অনুযায়ী একেক সময় একেকজন সামনে আসতো। যেমন নাহিদ ইসলাম পলিটিক্যাল সার্কেলে তেমন পরিচিত ছিল না।

আগে সে হয়তো ডাকসুতে সংস্কৃতি সম্পাদক হিসেবে দাঁড়িয়েছিল। তারপর সে অবলিভিয়নে চলে যায়।

নাহিদ আমাদের সাথে যুক্ত ছিল, নিয়মিত বইটই পড়তো কিন্তু সেসময় পলিটিক্যালি এতটা মুভ করেনি। 

আসিফ (স্থানীয় সরকার উপদেষ্টা) পলিটিক্যাল এক্টিভিজম করতো। অন্যদিকে আরেকজন শোয়েব আব্দুল্লাহ চলে গেল গবেষণায়। নাসির উদ্দিন পাটোয়ারী সেসময় এবি পার্টিতে জয়েনও করেছিল। এসব ব্যক্তি কিন্তু ভিন্ন জায়গায় ভিন্ন উপায়ে আসলে একই কাজ করছিল, একটা অন্তর্ভুক্তিমূলক মধ্যপন্থার উপায় খুঁজছিল।

বাসস: তাহলে আন্দোলনে নাহিদ ইসলাম কীভাবে সামনে এলেন?

মাহফুজ আলম: নাহিদ ইসলাম পলিটিক্যালি তখন ফ্রেশ একটা ক্যারেক্টার ছিল। যদি আখতার সামনে আসতো, তাহলে এটাকে আওয়ামী বিরোধী মুভ হিসেবে দেখানো হতে পারে বলে আমরা আখতারকে সামনে আনিনি। আমি যদি সামনে আসতাম, তাহলে আমিও চিহ্নিত হয়ে যাব আর পেছনের কাজগুলো করতে পারতাম না। আসিফ মাহমুদও প্রথমদিকে কিছু সঙ্গত কারণে সামনে আসতে চায়নি। আকরাম এক সময় ক্যাম্পাসে বেশ পরিচিত ছিল। কিন্তু, সে ২০২৩ সাল থেকে ব্যবসায়ে যুক্ত থেকে ক্যাম্পাস থেকে সরে গিয়েছিল। কিন্তু আমরা এদের সবাইকে রেখে নাহিদকে সামনে আনলাম।

এর একটা কারণ ছিল যে তাকে আগে খুব একটা দেখা যায়নি, অনেকটাই নতুন চরিত্রের মতো। অন্যদিকে সে যেহেতু শহুরে স্কুল-কলেজে পড়ুয়া একজন, তাই মধ্যবিত্ত সমাজের তরুণদের সাথে তার বোঝাপড়াটা অন্যদের তুলনায় সহজ হতে পারে। আর আমি তখন পেছনে থেকে সব ঘরানার বুদ্ধিজীবী ও কালচারাল গ্রুপের সাথে যোগাযোগের কাজ করছিলাম।

আমাদের কাজগুলোকে আপনি অনেকটা ডিভিশন অব লেবার বলতে পারেন। আমাদের স্বপ্নটা যেন বেঁচে থাকে, এটাই ছিল আমাদের মূল উদ্দেশ্য। কে সামনে গেল, কে পেছনে থাকলো সেটা একদমই ম্যাটার করতো না। এটাকে আপনি অনেকটা থিয়েটারের রোল প্লে করার মতো ব্যাখ্যা করতে পারেন। সবচেয়ে কম গুরুত্বপূর্ণ রোলটাও যদি কেউ ঠিকঠাক মতো করে দেখায়, সেটাই আপনার নজর কাড়বে। থিয়েটার স্কুল থেকে শেখা একটা জিনিস আমার মনে আছে, কেউ যদি মঞ্চের কোণায় দাঁড়িয়ে বাঁশি বাজানোর রোল পায়, আর সে চাইলে এটা ভালো করে করার মাধ্যমে থিয়েটারটাকে পূর্ণতা দিতে পারবে এবং দর্শকের তালিও পাবে।

বাসস: জুলাই গণহত্যার সঙ্গে জড়িতদের ব্যাপারে সরকারের পক্ষ থেকে ‘ট্রুথ অ্যান্ড রিকনসিলিয়েশন’ পদ্ধতির মাধ্যমে বিচার করার কথা শোনা যায়। এই প্রক্রিয়া কার্যকরী বলে কি আপনি মনে করেন?

মাহফুজ আলম: ট্রুথ আসলে সত্য অনুসন্ধান এবং স্বীকার করে নেয়ার বিষয়। ট্রুথ আসলে কী? যেমন কিছুদিন আগে স্বৈরাচারী আমলের নির্বাচন কমিশনার আদালতের কাছে বলেছেন যে আওয়ামী লীগের আমলে ভুয়া জাতীয় নির্বাচন হতো, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন সেগুলো ছিল না। নির্বাচন কমিশনের দায়িত্বে থাকা একজন এই কথা বলার মাধ্যমে সত্যকে সামনে এনেছেন। এই কথাগুলোর স্বীকৃতি আওয়ামী লীগ থেকে আসতে হবে। কারণ বিচারিক প্রক্রিয়া ভিন্ন জিনিস, আর কোশ্চেন অফ মোরালিটির জায়গা থেকে আওয়ামী লীগের এই হত্যাকাণ্ড স্বীকার করেই সামনে আসতে হবে।

আপনি অপরাধীকে বিচারিক প্রক্রিয়ায় শাস্তি দিতে পারবেন। কিন্তু যে পাপী, তাকে কি আপনি শাস্তির মাধ্যমে নিষ্পাপ করতে পারবেন? পারবেন না। তাকে একটা পাপের স্বীকারোক্তি ও ক্ষমা চাওয়ার প্রক্রিয়ার মাধ্যমেই সামনে আসতে হবে। ধরেন একজন শিক্ষক, তিনি গণহত্যায় অংশ নেননি। কিন্তু ওই শিক্ষক গণহত্যাকারী আওয়ামী লীগকে পূর্ণ সমর্থন দিয়েছেন। এই শিক্ষককে তো আপনি গণহত্যার শাস্তি দিতে পারবেন না। বরং তার পাপকে স্বীকার করে তাকে ক্ষমা চেয়ে সামনে এগোতে হবে। এখন ক্ষমা চাওয়ার দশ রকমের উপায় থাকতে হবে। কিন্তু তার জন্য ট্রুথ অ্যান্ড রিকনসিলিয়েশনের বাইরে কার্যকরী কোন প্রক্রিয়া নেই।

তবে ব্যক্তিগতভাবে আমি খুবই আশাবাদী। আমার ধারণা এই পদ্ধতির মাধ্যমেই আমরা রাষ্ট্র হিসেবে আরও শক্তিশালী হবো।

বাসস: কিন্তু জুলাই গণহত্যার বিচার নিয়ে তো জনমনে অনেক ধরনের প্রতিক্রিয়া আছে। এ ব্যাপারেও কি আপনি আশাবাদী?

মাহফুজ আলম: আমাদের একটা স্পিডি ট্রায়াল দরকার ছিল। যেখানে দ্রুত সময়ের মধ্যে বিচারিক প্রক্রিয়ায় খুন, গুম ও দুর্নীতির সাথে জড়িতদের সাজা দেয়া। কিন্তু সমস্যা হলো, বিচার ব্যবস্থাও স্বৈরাচারী শাসন আমলে ভেঙে দেয়া হয়েছে। যেসব বিষয়ের উপর বিচার ও তদন্ত দাঁড়িয়ে আছে, সেই প্রতিষ্ঠানগুলোকেও নষ্ট করা হয়েছে। তাই যখন বিচার শুরু হলো, তখন প্রত্যাশার চেয়েও ধীরগতির হয়েছে।

কিন্তু তবুও এসব সংকট পেরিয়ে কিছু সমাধান আনার চেষ্টা করা হয়েছে। যেমন দু’টো আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল গঠন করা হয়েছে। আমরা চেষ্টা করছি, শুধু সরকার না; আমার ধারণা নাগরিকরাও বিচার প্রক্রিয়া সহজ করতে হেল্প করছে। আশা করি দ্রুতই জুলাইয়ে শহীদ হওয়া পরিবার ও দেশবাসী দৃশ্যমান বিচার দেখতে পাবেন।

বাসস: সবশেষ জানতে চাই, গণঅভ্যুত্থানের এক দফা দাবি ঘোষণার সময় নতুন রাজনৈতিক বন্দোবস্তের যে আকাঙ্ক্ষার কথা বলা হয়েছিল, আমরা কি অভ্যুত্থান পরবর্তী সময়ে সেই আকাঙ্ক্ষার দিকে এগোতে পেরেছি? সংস্কারের মধ্য দিয়ে যেভাবে রাষ্ট্র যাচ্ছে, রাজনৈতিক সংস্কৃতিরও সংস্কার হচ্ছে কি?

মাহফুজ আলম: সত্যি বলতে নতুন রাজনৈতিক বন্দোবস্ত তখনই সম্ভব যখন বিদ্যমান রাজনৈতিক সংস্কৃতি ও চর্চার সংস্কার হবে। এখন আপনি আগের মতো নিয়মতান্ত্রিক রাজনীতি করে তো আর নতুন রাজনৈতিক বন্দোবস্ত আনতে পারবেন না।

এই বিষয়ে আপনাকে একটা গল্প বলি। ভারত রাষ্ট্র গঠনের পর নেহরু যখন ক্ষমতায় আসেন, তখন বিরোধী দল বলতে আসলে কিছুই ছিল না। নেহরুর সুযোগ ছিল ডিক্টেটর হয়ে ওঠার, যেহেতু বিরোধী বলতে কেউ নেই। কিন্তু নেহরু ক্ষমতায় এসেই জয়প্রকাশ নারায়ণকে ডাকলেন এবং বললেন তোমরা একটা শক্তিশালী বিরোধী দল তৈরি করো, আমরা সাহায্য করব। তিনি একটা গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের রাজনৈতিক সংস্কৃতিটা জারি রাখতে চেয়েছিলেন। অপরদিকে বাংলাদেশ রাষ্ট্র গঠনের পর শেখ মুজিবেরও একই অবস্থা ছিল, কিন্তু তিনি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র গঠনের সুযোগটা গ্রহণ করেননি। মুজিববাদী রাজনৈতিক দলগুলো একই পন্থায় দেশ চালাতে চাইছে।

এখন আপনি যদি বিরোধী দল বা পক্ষকে সম্মান না জানান, তাদেরকে একটা শক্ত অবস্থানে আসতে না দেন, তাহলে রাষ্ট্র কি সঠিকভাবে দাঁড়ায়? এটা তো রাজনীতির কোর একটা আইডিয়া। বিরোধী দলকে নিয়ে রাজনীতি করবে এরকম রাজনীতিবিদ বাংলাদেশে খুব কম, বললেই চলে। একজন ছিলেন, বেগম খালেদা জিয়া। তাকে হাসিনা ভয়াবহ রকমের আক্রমণ করেছে, কুরুচীপূর্ণ কথা বলেছে। কিন্তু ওই অর্থে বেগম খালেদা জিয়া প্রতিহিংসার রাজনীতি করেননি। সমস্যা হলো, এই কালচারটা বাংলাদেশের পলিটিক্সে তৈরি হয়নি।

এখনও দেখতে পাই, কোনো দলই প্রতিদ্বন্দ্বী রাজনৈতিক দলকে স্পেস দিতে চায় না। আপনি যদি এটা জারি রাখেন, তাহলে তো আর রাজনৈতিক সংস্কার হলো না।

গণঅভ্যুত্থানের আকাঙ্ক্ষা বাস্তবায়ন করতে হলে রাজনৈতিক দলগুলোকেও বিদ্যমান রাজনৈতিক চর্চার বাইরে নতুন সংস্কৃতি গড়ে তুলতে হবে বলে আমি মনে করি।

বাসস: আপনাকে ধন্যবাদ আমাদের সময় দেয়ার জন্য।

মাহফুজ আলম: আপনাকেও ধন্যবাদ।