বাসস
  ০১ আগস্ট ২০২৫, ১৪:৫৪

খুলনায় শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের প্রতিবাদী গান, গ্রাফিতি অঙ্কন, মানববন্ধন ও সমাবেশ 

ফাইল ছবি

মুহাম্মদ নুরুজ্জামান

খুলনা, ১ আগস্ট ২০২৫ (বাসস) : বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনকে কেন্দ্র করে বিশ্ববিদ্যালয়সহ জেলার বিভিন্ন স্থানে পুলিশের হামলা ও সহিংসতার ঘটনায় চব্বিশের ১ আগস্ট বিকেলে খুলনা বিশ্ববিদ্যালয় (খুবি)’র সাধারণ শিক্ষার্থীরা গল্লামারি বধ্যভূমিতে চোখে মুখে লাল কাপড় বেধে নীরব প্রতিবাদ জানায়। 

এদিন তারা খুবির সীমানা প্রাচীরে গ্রাফিতি অঙ্কন করে। এরপর সন্ধ্যায় কোটা আন্দোলনে শহীদদের স্মৃতিচারণে বিশ্ববিদ্যালয়ের খান জাহান আলী হল সংলগ্ন খাজা গেটে বিপ্লবী গানের অনুষ্ঠান আয়োজন করা হয়। সেখানে শিক্ষার্থীরা বিভিন্ন বিপ্লবী ও দেশাত্মবোধক গান পরিবেশন করে।

এদিকে, বিশেষ ক্ষমতা আইন, ১৯৭৪ এর ধারা ২৪ এর উপধারা (১) এর ক্ষমতাবলে তৎকালীন খুলনা জেলা ম্যাজিস্ট্রেট খন্দকার ইয়াসির আরেফীন দেশে কোটা আন্দোলনের ফলে উদ্ভূত চলমান সহিংস পরিস্থিতি থেকে জনগণের জানমালের নিরাপত্তা বিধান, সরকারি সম্পত্তি ও স্থাপনার নিরাপত্তা বিধান এবং শান্তি শৃঙ্খলা ও জনশৃঙ্খলা রক্ষার্থে খুলনা জেলার নয়টি উপজেলার অধিক্ষেত্রে কারফিউ (সান্ধ্য আইন) জারি করেন। এই কারফিউ ১ আগস্ট রাত ১০টা থেকে ২ আগস্ট সকাল ছয়টা পর্যন্ত বলবৎ রাখা হয়। ওই আদেশে ২ আগস্ট সকাল ছয়টা থেকে রাত ১০টা পর্যন্ত কারফিউ শিথিল এবং ২ আগস্ট রাত ১০টা থেকে পুনরাদেশ না দেয়া পর্যন্ত কারফিউ বলবৎ রাখা হয়।

শিক্ষার্থীদের বিরুদ্ধে দুই মামলা, কারাগারে ১১ 

এর আগে ৩১ জুলাই নগরীর সাত রাস্তা ও ময়লাপোতা মোড়ে পুলিশের সঙ্গে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনকারীদের সংঘর্ষের ঘটনায় দুইটি মামলা দায়ের করে পুলিশ। ৩১ জুলাই রাতে পুলিশ বাদী হয়ে খুলনা সদর ও সোনাডাঙ্গা থানায় মামলা দুটি দায়ের করে। পুলিশের দায়ের করা প্রতিটি মামলায় ২০০ থেকে ২৫০ জনকে আসামি করা হয়। এ ঘটনায় গ্রেপ্তার ১১ জনকে আদালতের মাধ্যমে কারাগারে পাঠানো হয়। 

নগরীর সদর থানার এস আই হাসানুর রহমান বাদি হয়ে একটি মামলা দায়ের করেন। মামলায়  ৬ জনের নাম উল্লেখসহ অজ্ঞাত পরিচয় ৩০০ জনকে আসামি করা হয়।

এই মামলায় আগের দিন আটক ৬ শিক্ষার্থীকে গ্রেপ্তার দেখিয়ে কারাগারে পাঠানো হয়। এছাড়া পুলিশের গাড়ি ভাংচুরের অভিযোগে নগরীর সোনাডাঙ্গা থানার এস আই সুমন মণ্ডল বাদি হয়ে ওই থানায় আরেকটি মামলা করেন। এই মামলায় অজ্ঞাত পরিচয় ২০০ জনকে আসামি করা হয়।

খুলনা মেট্রোপলিটন পুলিশের কার্যালয় সূত্রে জানা যায়, আটক শিক্ষার্থীদের রাতে ছেড়ে দেওয়া হয়। 

শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের মধ্যে ঢুকে অন্য যারা বিশৃঙ্খলা করেছে তাদের গ্রেপ্তার দেখানো হয়।

কুয়েটে শিক্ষকদের মানববন্ধন শিক্ষার্থীসহ নিরপরাধ জনসাধারণ হত্যা ও নিপীড়নের প্রতিবাদ এবং বিচারের দাবিতে খুলনা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে মানববন্ধন অনুষ্ঠিত হয়। ১ আগস্ট বেলা ১১ টায় বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাধীনতা  স্তম্ভ ‘দুর্বার বাংলা’র পাদদেশে সাধারণ শিক্ষকদের ব্যানারে এ মানববন্ধন অনুষ্ঠিত হয়। কুয়েটের মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের অধ্যাপক ড. মো. হেলাল এর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত এ মানববন্ধনে বক্তৃতা করেন সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের প্রফেসর ড. মো. শাহাজান আলী, ইলেকট্রনিক্স কমিউনিকেশন অ্যান্ড কমিউনিকেশন কৌশল বিভাগের অধ্যাপক শেখ শরীফুল আলম, সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের অ্যাসোসিয়েট প্রফেসর মীর আব্দুল কুদ্দুস ও মানবিক বিভাগের প্রফেসর রাজিয়া।

এ সময় অন্যান্যদের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন ইসি ডিপার্টমেন্টের প্রফেসর ড. শেখ মো. রবিউল ইসলাম, ম্যাথমেটিক্স বিভাগের প্রফেসর ড. বিএম ইকরামুল হক, মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের প্রফেসর ড. আশরাফুল ইসলাম, একই বিভাগের অধ্যাপক মহিউদ্দিন, অ্যাসিস্ট্যান্ট প্রফেসর ফাহিম ইসলাম অনিকসহ বিশ্ববিদ্যালয়ের সাধারণ শিক্ষকবৃন্দ।

মানববন্ধনে বক্তারা বলেন, আমাদের শিক্ষার্থীদের তুলে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। তাদের নির্যাতন করা হচ্ছে। 

এসবের প্রতিবাদে আজ আমরা কুয়েটের সাধারণ শিক্ষকদের পক্ষ থেকে আন্দোলনকারীদের পক্ষে দাঁড়িয়েছি। 

আমাদের সকলের হৃদয়ে রক্তক্ষরণ হচ্ছে। আমরা প্রত্যেকে আমাদের শিক্ষার্থীদের অভিভাবক। অনেকে আমরা ছাত্র-ছাত্রীদের বাবা। সেই জায়গা থেকে আমাদের নিরপরাধ শিক্ষার্থীদের যেভাবে বিভিন্ন মিডিয়ায় দেখছি গুলি করে হত্যা করা হয়েছে, রাজপথে হত্যা করা হয়েছে, আমরা তার তীব্র প্রতিবাদ জানাচ্ছি। 

শিক্ষকরা সেদিন আন্দোলনে সকল হত্যাকাণ্ডের বিচার এবং দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দাবি  করেন। তাঁরা বলেন, শিক্ষার্থীদের যেভাবে থানায় তুলে নেওয়া হচ্ছে, এটা কোনোভাবেই কল্যাণকর রাষ্ট্রের চরিত্র হতে পারে না। 

সরকারের কাছে আমাদের দাবি কোন শিক্ষার্থী এবং শিক্ষককে নিপীড়ন করা যাবে না। আমরা আর কোন নির্যাতন দেখতে চাই না। একটা ছাত্রকেও যেন আর হত্যা না করা হয়। আর একটাও নিরীহ জনগণ যাতে না মরে। প্রত্যেকটি ছাত্র হত্যার বিচার করতে হবে। তাদের পরিবারকে ক্ষতিপূরণ দিতে হবে। অন্যথায় শিক্ষকরা এই আন্দোলন থেকে সরবে না।

মানববন্ধন শেষে শিক্ষকবৃন্দ মৌন মিছিল সহকারে বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার প্রদক্ষিণ করে দুর্বার বাংলার পাদদেশে এসে কর্মসূচির সমাপ্তি ঘোষণা করেন।

খুবিতে শিক্ষকদের মৌন মিছিল

চলমান কোটা আন্দোলনকে কেন্দ্র করে খুলনা ও গোটা দেশে যে ন্যাক্কারজনক সহিংসতা চলছিল তার বিরুদ্ধে ১ আগস্ট বেলা সোয়া ১১টায় খুবি ক্যাম্পাসের হাদী চত্বরে শিক্ষকরা মানববন্ধন করেন। এর আগে শিক্ষকরা মুখে ও মাথায় লাল পট্টি ধারণ করে ক্যাম্পাস প্রদক্ষিণ করেন। শিক্ষকদের মানববন্ধন শেষে  সেখানে এক সংক্ষিপ্ত সমাবেশ আয়োজন করা হয়। 

সমাবেশে শিক্ষকরা বলেন, কোটা আন্দোলনকে কেন্দ্র করে চলমান সহিংসতা ও হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদে আজ খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের এই মানববন্ধন। তরুণ প্রজন্ম এবং দেশের ভবিষ্যৎ ছাত্র-ছাত্রীদের উপর যে নৃশংসতা সংঘটিত হচ্ছে তাতে আমরা বাকরুদ্ধ, মর্মাহত ও ব্যথিত। এমন নারকীয়তা স্বাধীনতার পরে আর কখনো দৃশ্যমান হয়নি। মুক্তিযুদ্ধ হয়েছিল বৈষম্যের বিরুদ্ধে আজকের এই ছাত্র আন্দোলনও বৈষম্যের বিরুদ্ধে। এজন্য এ আন্দোলনে যারা মৃত্যুবরণ করেছেন তাদের আমরা শহীদ বলে চিহ্নিত করছি। একই সাথে চলমান ছাত্র হয়রানি এবং এসব হত্যাকাণ্ডের সুষ্ঠু বিচারের দাবি জানাচ্ছি।

আর্কিটেকচার ডিসিপ্লিনের ড. অনির্বাণ মুস্তাফা বলেন, ‘এ প্রজন্মকে আমি স্যালুট জানাই। কারণ এই প্রজন্ম আমাকে শিখিয়েছে দাসত্বের শৃঙ্খল কীভাবে ভাঙতে হয়। এক্ষেত্রে আমার ছাত্ররাই আমার শিক্ষক । আমি এখানে বিচারের দাবি নিয়ে আসিনি। কারণ রাষ্ট্র যখন গুলি করে তখন বিচার পাওয়া যায় না।’

বক্তারা বলেন, আন্দোলনে যারা শহীদ হয়েছেন তাদের আত্মার শান্তি কামনা করছি এবং এই হত্যাকাণ্ডের সাথে যারা জড়িত তাদের বিচারের জোর দাবি জানাচ্ছি ।

পাকিস্তান আমলে লুঙ্গি খুলে ধর্ম যাচাই করা হতো, আর এখন মোবাইল দেখে রাজনৈতিক আদর্শ বিচার করা হচ্ছে। তাহলে পার্থক্য কোথায়? ছাত্রদের মেস ও বাসায় গিয়ে বিভিন্নভাবে হয়রানি করা হচ্ছে। ইঁদুরের মত ফাঁদ পেতে গ্রেপ্তার করা হচ্ছে। এসবের তীব্র প্রতিবাদ জানাচ্ছি।

এ সমাবেশে আগের দুই সপ্তাহে বিশ্ববিদ্যালয়সহ দেশের বিভিন্ন স্থানে ঘটে যাওয়া হামলা ও সহিংসতায় খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের মেধাবী ছাত্র মীর মাহফুজুর রহমান মুগ্ধসহ শহীদ সকল শিক্ষার্থী ও অন্যান্যদের প্রাণহানির ঘটনায় খুলনা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি গভীর শোক  এবং নিহতদের আত্মার শান্তি কামনা করে শোকসন্তপ্ত পরিবারের প্রতি সমবেদনা প্রকাশ করে।