শিরোনাম
ওমর ফারুক
রাজশাহী, ১ আগস্ট ২০২৫ (বাসস): ২০২৪ সালের পহেলা আগস্ট নানা ঘটনার মধ্য দিয়ে কাটে।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের কেন্দ্রঘোষিত নির্ধারিত কর্মসূচি ছিল গণমিছিল ও নিহতদের জন্য দোয়া।
রাজশাহীতে দোয়া কর্মসূচি না হলেও নানা ঘটনার জন্য দেশের অন্যতম বিদ্যাপীঠ রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ছিল আলোচনায়।
সেদিন বেলা ১১টার দিকে ‘ছাত্র-জনতার খুনিদের প্রতিহত করুন’ ব্যানারে মুখে লাল কাপড় বেঁধে মৌন মিছিল করে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক নেটওয়ার্ক। সারাদেশে ছাত্র হত্যার প্রতিবাদে মুখে লাল কাপড় বেঁধে এই কর্মসূচি পালন করেন তারা।
কর্মসূচিতে বিশ্ববিদ্যালয় ও নগরীর বিভিন্ন স্কুলকলেজের শিক্ষার্থীরা অংশগ্রহণ করেন। মিছিল চলাকালীন সাদা পোশাকধারী পুলিশ সদস্যরা শিক্ষার্থীদের জোর করে তুলে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেন। এ সময় শিক্ষকেরা ঢাল হয়ে দাঁড়িয়ে তাদের কাছ থেকে শিক্ষার্থীদের ছাড়িয়ে নিয়ে রক্ষা করেন।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, গত ১ আগস্ট বৃহস্পতিবার বেলা ১১টার দিকে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদ বুদ্ধিজীবী স্মৃতিফলকের সামনে থেকে বিভিন্ন কলেজের শিক্ষক ও শিক্ষার্থীরা মৌন মিছিল বের করেন।
পরে ক্যাম্পাসের বিভিন্ন জায়গা প্রদক্ষিণ করে পুনরায় সেই স্থানে গিয়ে কর্মসূচি শেষ করেন। তবে এই কর্মসূচি শেষ হওয়ার আগে থেকেই সাদা পোশাকে অবস্থান নেন পুলিশ সদস্যরা। কর্মসূচি শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে পুলিশ সদস্যরা শিক্ষার্থীদের টেনেহিঁচড়ে গাড়িতে তোলার জন্য নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছিলেন।
শিক্ষকেরা তা দেখামাত্রই দৌড়ে গিয়ে তাঁদের বাধা দেন। এ সময় বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের সঙ্গে পুলিশের ধস্তাধস্তি হয়।
ঘটনাস্থলের পাশেই অবস্থান করছিলেন তৎকালীন আরএমপি অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার (ক্রাইম এন্ড অপারেশন) মোহাম্মদ হেমায়েতুল ইসলাম। তিনি সেদিন জানিয়েছিলেন, এভাবে শিক্ষার্থীদের তুলে নেওয়ার কোনো নির্দেশনা ছিল না। কিছু অতি উৎসাহী পুলিশ সদস্য এ কাজ করেছে। আমরা নিরাপত্তা দিতে ও যে কোনো অপ্রীতিকর ঘটনা এড়াতে উপস্থিত ছিলাম। আমি ঘটনাটি দেখে শিক্ষার্থীদের ছেড়ে দেওয়ার জন্য নির্দেশনা দেই।
সেদিন শিক্ষকদের বাধায় ক্যাম্পাস থেকে কোনো শিক্ষার্থীকে তুলে নিয়ে যেতে পারেননি পুলিশ সদস্যরা।
শিক্ষকেরা ঢাল হয়ে শিক্ষার্থীদের কাজলা গেটে নিয়ে গিয়ে নিরাপদে বের করে দেন।
মৌন মিছিলেন অংশ নেওয়া নগরীর বারিন্দ মেডিকেল কলেজের শিক্ষার্থী লাবন্য বলেছিলেন, ‘আমরা শিক্ষকদের সঙ্গে শান্তিপূর্ণভাবে মৌন মিছিলে অংশ নিয়েছিলাম। কিন্তু হাসিনার সরকারের নির্দেশে সিভিল ড্রেসে থাকা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী আমাদের আঘাত করে।
সে সময় গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের অধ্যাপক আব্দুল্লাহ আল মামুন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর উদ্দেশ্য বলেন, ‘আপনাদের কাছে শিক্ষার্থীদের আটক করার কোনো নথিপত্র নেই। সন্দেহের বশে কাউকে আটক করা অন্যায়। আপনারা এমনটা কখনোই করতে পারেন না। এর পরে যদি কোনো ছাত্রের গায়ে হাত পড়ে এবং আমার সহকর্মীদের গায়ে আঘাত লাগে তাহলে কিন্তু আমরা মেনে নেব না।
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর অধ্যাপক আসাবুল হক বলেছিলেন, আমরা পুলিশ প্রশাসনকে ক্যাম্পাসের বাইরে অবস্থান করতে বলি। তারপরও তারা ক্যাম্পাসে প্রবেশ করেছিল। আমরা সবাইকে নিরাপদে বাড়ি যাওয়ার ব্যবস্থা করে দিয়েছি। ক্যাম্পাস বন্ধ থাকায় এখন এখানে কোনো শিক্ষার্থী থাকে না।
এদিকে, বৈষম্যবিরোধী ছাত্রদের আন্দোলনের কর্মসূচি চলার সময় রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ৬ শিক্ষার্থীকে গ্রেপ্তার করেছিল পুলিশ। মতিহার থানায় সাড়ে ৯ ঘণ্টা রাখার পর তিন শিক্ষার্থীকে মুক্ত করে আনেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকেরা। বাকিদের মুক্ত করতে চেয়েও ব্যর্থ হন তারা। রাত ১টার দিকে তিন শিক্ষার্থীকে মতিহার থানা থেকে মুক্ত করে ক্যাম্পাসে নিয়ে আসেন শিক্ষকেরা।
রাবির গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের অধ্যাপক আল মামুন, সহযোগী অধ্যাপক সেলিম রেজা নিউটন ও কাজী মামুন হায়দার, নাট্যকলা বিভাগের অধ্যাপক হাবিব জাকারিয়া ইংরেজি বিভাগের অধ্যাপক রোবাইদা আখতার, ইনস্টিটিউট অব ইংলিশ অ্যান্ড আদার ল্যাঙ্গুয়েজের পরিচালক অধ্যাপক আব্দুল্লাহ আল মামুন, ফোকলোর বিভাগের অধ্যাপক আমিরুল ইসলাম কনকসহ অন্তত ২০ জন শিক্ষক থানায় অবস্থান নিয়ে শিক্ষার্থীদের ছাড়িয়ে আনেন।
ওই দিন আরো শিক্ষার্থীদের ছাড়াতে ডিবি কার্যালয় ও রাজপাড়া থানায় যান শিক্ষকরা। তাদের ‘মার্চ ফর জাস্টিস’ কর্মসূচিতে যাওয়ার পথে আটক করা হয়। রাবি শিক্ষার্থী হয়রানি প্রতিরোধে সহায়তা সেল গঠন করেছিল বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। রাবির দুইজন সহকারী প্রক্টরের সমন্বয়ে এ সেল গঠন করা হয়।
অপরদিকে, বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী ও ছাত্র সংগঠন ইসলামী ছাত্রশিবিরকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করার কারণে পাল্টা প্রতিক্রিয়ার আশঙ্কায় থমথমে ছিল রাজশাহী মহানগর। নগরের বিভিন্ন মোড়ে মোড়ে অতিরিক্ত পুলিশ, র্যাব ও বিজিবির সদস্য মোতায়েন ছিল। যেকোনো ধরনের অপ্রীতিকরা ঘটনা এড়াতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পক্ষ থেকে নেওয়া হয় ব্যাপক নিরাপত্তা ব্যবস্থা। পাশাপাশি চেকপোস্ট বসিয়ে চালানো হয় ব্যাপক তল্লাশি। অনেককে আটকও করা হয়। মেসে মেসে চলতে থাকে চিরুনি অভিযান। যদিও ১ আগস্ট জামায়াত ইসলামি ও ইসলামী ছাত্রশিবিরকে রাজশাহী মহানগরীতে কোনো কর্মসূচি পালন করতে দেয়া হয়নি।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে সম্মুখ সারির যোাদ্ধা রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. মো. সালেহ হাসান নকীব বাসসকে বলেন, শিক্ষার্থীদের শান্তিপূর্ণ আন্দোলন আমাদের কাছে যৌক্তিক ছিল। আমরা সর্বোপরি আমাদের শিক্ষার্থীদের পাশে থাকার চেষ্টা করেছি। জুলাই গণঅভ্যুথান জাতিকে নতুনভাবে আশার আলো দেখিয়েছে। জুলাইয়ের চেতনায় জাতি ঐক্যবদ্ধ থাকলে আগামীর বাংলাদেশ হবে সুন্দর ও বৈষম্যমুক্ত।