শিরোনাম
\ রুদ্র আল মুত্তাকিন \
ঢাকা, ৩০ জুলাই, ২০২৫ (বাসস) : ছাত্র রাজনীতিতে আর যেন কোনো ছাত্রলীগ তৈরি না হয় সেদিকে শিক্ষার্থীদের সজাগ দৃষ্টি রাখতে হবে। দেশে ফ্যাসিবাদ কায়েম না হওয়ার বিষয়েও সচেতন থাকতে হবে সকলকে। না হলে গণঅভ্যুত্থানের আকাঙ্ক্ষা ধূলায় লুটাবে। কথাগুলো মেহেদী হাসান মুন্নার।
তিনি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়ক ছিলেন। একইসঙ্গে নাগরিক ছাত্র ঐক্যের বিশ্ববিদ্যালয় শাখা সভাপতিও ছিলেন মেহেদী হাসান মুন্না । রাকসু আন্দোলন মঞ্চের সাথে কাজ করতে গিয়ে রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়েন। শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে কথা বলায় নানা সময়ে ক্যাম্পাসে ছাত্রলীগ তার ওপর হামলা চালায়। নানা ধরনের নিপীড়নের শিকার হন তিনি।
তবু থেমে যাননি। মুন্না তার পুরো ছাত্র জীবনে ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে লড়াই চালিয়ে গেছেন। বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগের নানা কর্মকাণ্ড নিয়ে আওয়াজ তুলেছেন।
মেহেদী হাসান মুন্নার বেড়ে ওঠা মাদারীপুর জেলার রাজৈর উপজেলার নরারকান্দি গ্রামে। তাঁর বাবার নাম রফিকুল ইসলাম এবং মায়ের নাম মুক্তা বেগম।
সম্প্রতি তিনি জাতীয় বার্তা সংস্থা বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থাকে দেওয়া একান্ত সাক্ষাৎকারে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে তার সম্পৃক্ততা ও আন্দোলনের বিভিন্ন অভিজ্ঞতার নানা দিক নিয়ে কথা বলেন। সেসঙ্গে তিনি দেশ ও মানুষ ও ভবিষ্যত নিয়ে তার বিস্তারিত ভাবনার কথাও তুলে ধরেন।
বাসস: জুলাই গণঅভ্যুত্থানকে কীভাবে দেখেন?
মেহেদী হাসান মুন্না : ছাত্র জনতার গণঅভ্যুত্থানে পতন ঘটে ফ্যাসিস্ট রেজিমের শিরোমণি শেখ হাসিনার। শুধু পতনই ঘটেনি, তিনি পালিয়ে দিল্লি আশ্রয় নিয়েছেন। আমি যেহেতু দীর্ঘদিন যাবৎ ফ্যাসিবাদী সরকারের গুম-খুন, দুর্নীতি, বিচারহীনতার সংস্কৃতি নিয়ে প্রতিবাদ করেছি, রাজনৈতিক সামর্থ্যের সর্বোচ্চটুকু দিয়ে আন্দোলন, প্রতিবাদে শামিল হয়েছি আমার কাছে জুলাই গণঅভ্যুত্থানের উপলব্ধি বা অনুভূতি একটু ভিন্ন রকম। আমার কাছে এটা মহাবিপ্লবের শামিল। পৃথিবীতে এমন ঘটনা কমই ঘটেছে যা জুলাইতে ছাত্র-জনতা পুরো বিশ্বকে দেখিয়ে দিয়েছে।
বাসস: রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে এই আন্দোলন কীভাবে সফল করলেন?
মেহেদী হাসান মুন্না : রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে আন্দোলন একটু ভিন্ন ছিলো। ১৮ জুলাইয়ের পর আসলে শিক্ষার্থীরা অনেকটা বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। চারদিকে ধরপাকড়, বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের ফ্যাসিস্ট মনোভাব ও শিক্ষার্থীদের ওপর আওয়ামী লীগ, ছাত্রলীগ-যুবলীগের তাণ্ডব একইসাথে আন্দোলনে সমন্বয়হীনতাও একটা বিরাট বিষয় হয়ে দাঁড়ায়। এ সময়ে আন্দোলনটা একরকম স্থিমিত হলেও মনোবল কারোরই ভাঙেনি। এ অবস্থাতেই প্রকাশ হয় বৈষম্যবিরোধী ছাত্র অন্দোলনের রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ১৭ সদস্য বিশিষ্ট সমন্বয়ক কমিটি। আবারো প্রাণ ফিরে পায় আমাদের আন্দোলন। যারা আশাহত হয়েছিলেন তারাও পূর্ণমাত্রায় মাঠে নামার প্রস্তুতি নেন। প্রথম থেকে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রের সাথে অর্থাৎ বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সাথে কর্মসূচি পালন করেনি। আন্দোলনে সমন্বয়হীনতার ব্যাপার সামনে আসলে সে সময় আন্দোলনের নেতৃবৃন্দকে শিক্ষার্থীরা অবাঞ্ছিত ঘোষণা করে। যে কোন আন্দোলনেই সামষ্টিক স্বার্থ দেখতে হয়। ব্যক্তিগত স্বার্থ হাসিল করতে গেলে সেখানে সফলতা আসবে না। যেটা আসবে সেটাও খুবই ক্ষীণ।
সমন্বয়ক কমিটি প্রকাশ হওয়ার সাথে সাথেই আমরা অনলাইনে যুক্ত হই। নতুন করে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন-রাবি নামে ফেসবুক গ্রুপও খোলা হয়। আমি আন্দোলন চলাকালীন কখনোই মোবাইল ফোন বন্ধ করিনি। আন্দোলনটা গড়েই উঠেছে যোগাযোগকে কেন্দ্র করে। তাই অনেক সময় গ্রেফতার এড়াতে মোবাইল এক জায়গায় রেখে আমি অন্য জায়গায় থাকতাম। বিশেষ করে আমার বাসা ছিলো রাবি স্টেশন বাজারের পাশেই, সেখান থেকে আমি ও আমার স্ত্রী পদ্মা আবাসিক এলাকায় আমার স্ত্রীর বান্ধবীর বাসায় আশ্রয় নেই। নেট বন্ধ থাকায় বিকাশ ও ব্যাংক থেকে টাকাও তুলতে পারছিলাম না। ডিপার্টমেন্টের শিক্ষক সামিউল স্যারের বাসায় গিয়ে চলার জন্য ১৫০০ টাকা নেই। সে সময়ের পরিস্থিতি আসলে ভাষায় বর্ণনা করার মতো না।
২৮ জুলাই সমন্বয়ক পরিষদ গঠন হওয়ার পর রাবির আন্দোলন আবারো গতি পায়। ২৯ জুলাই কারফিউ ভেঙে যে মিছিল হয়েছিলো তা সারাদেশেই ভিন্ন মাত্রা বহন করে। নেট বন্ধ থাকার সময় আমরা সেলফোনে যোগাযোগ করতাম। শিক্ষকদের ভূমিকা না বললেই নয়। ২৯ জুলাই সকালে আমাদের বিক্ষোভ কর্মসূচি ছিলো। আমাদের আশা ছিলো শিক্ষকরা যোগ দিলে পুলিশ প্রশাসন হয়রানি করতে পারবে না। রাতেই ইফতেখার আলম মাসুদ স্যারের সাথে কথা বলি। আমি ঐদিন খুবই অসহায় হয়ে স্যারকে কাঁদো কাঁদো গলায় বললাম, স্যার কাল নামতে হবে। আমার ভাইয়েরা কাল নামবে। স্যার আমাকে বললো, আমি দেখছি মুন্না। ওইসময় কারফিউ চলছে তার মধ্যেই নকীব স্যারের (সালেহ্ হাসান নকীব) বাসায় গিয়ে কথা বললে, তিনি আমাকে বললেন, আমরা আসবো মুন্না। ‘আমরা আসবো মুন্না’ কথার মাঝে কি পরিমাণ মায়া মমতা জড়িয়ে আছে তা ভোলার নয়। আমিও আমাদের গ্রুপে স্ক্রিনশর্টসহ জানিয়ে দিলাম। কথা মতো স্যাররা আন্দোলনকারীদের আগেই মেইন গেটে চলে যান। স্যার ফোন দিয়ে বললেন, ‘তোমাদের ছেলেপেলে কোথায়?’ আমি অপরপ্রান্ত থেকে বললাম, ‘স্যার সবাই জড়ো হচ্ছে আপনারা মেইন গেটেই থাকেন।’ ওইদিনই কারফিউ ভেঙে সর্বপ্রথম ‘শেইম শেইম, ডিক্টেটর’ স্লোগান দেয় রাবির শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা। আন্দোলনটা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ব্যাপক প্রভাব ফেলে। এদিকে নতুন করে খোলা বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন-রাবি নামের ফেসবুক গ্রুপটি হয়ে ওঠে আন্দোলনের চালিকাশক্তি। সার্বক্ষণিক গ্রুপে নির্দেশনা ও প্রচার কাজ অব্যাহত রাখি আমরা। ২৮ জুলাই থেকে ৫ আগস্ট চোখের পাতায় কোন ঘুম ছিলো না। আমাদের একটা টেকনিক্যাল টিম ছিলো। এই টিমের কাজই ছিলো ফেসবুকে ফটোকার্ড, পোস্টার ব্যানার ডিজাইন করা। সাথে মেয়েদের নিয়ে প্রীতিলতা ব্রিগেড নামে আরেকটা ম্যাসেঞ্জার গ্রুপ খোলা হয়। রাজপথে ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে যেন সমানতালে আন্দোলনটা চলে। ক্যাম্পাস বন্ধ হওয়ার পরও আইন বিভাগের ভালো একটা গ্রুপ রাজশাহীতেই ছিলো। তারা একটা রিজার্ভ ফোর্স হিসেবে কাজ করেছে। যা আন্দোলনে নতুন মাত্রা যোগ করে। আমরা কখনোই কর্মসূচির সময় জানাতাম না। প্রোগ্রামের এক ঘন্টা আগে সময় জানাতাম। যাতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী পূর্বপ্রস্তুতি না নিতে পারে।
কেন্দ্রীয় কর্মসূচির ঘোষণা আসলেও অনলাইনে প্রচার করার জন্য জীবনের ঝুঁকি নিয়ে নিজ স্টুডিওতে বসে পোস্টার, ব্যানার তৈরি করে দিতেন ঢাকা থেকে সোহানুর রহমান সজল ভাই। তার করা পোস্টার ও আমাদের টেকনিকাল টিমের করা পোস্টার, ব্যানার, ফটোকার্ড ডিজাইনগুলো আন্দোলনে নেপথ্যের শক্তি হিসেবে কাজ করেছে।
এক পর্যায়ে আমরা আন্দোলনটাকে ক্যাম্পাসের বাইরে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করলাম। আমরা আন্দোলনটা রুয়েটগেট ও তালাইমারী নিয়ে গেলাম। আমাদের ধারণা ছিলো রাবি মেইনগেটে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী দ্রুতই ছত্রভঙ্গ করে তাদের আওতায় নিয়ে নিতে পারেন। এমন একটা স্পটে থাকতে হবে যেখান থেকে ছত্রভঙ্গ করলেও দ্রুত নিরাপদে সরে যাওয়া যাবে, আবার তাৎক্ষণিক জমায়েতও হওয়া যাবে। আরেকটা বড় কারণ ছিলো আন্দোলনে জনতাকে সম্পৃক্ত করা। রুয়েট, রাজশাহী কলেজসহ অন্যান্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, এলাকার মানুষ এবং বিভিন্ন রাজনৈতিক সংগঠনের নেতা কর্মীরাও যাতে খুব সহজে আন্দোলনে যুক্ত হতে পারে। আমরা কেন্দ্রের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী কর্মসূচি প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন করা শুরু করি। আন্দোলনের সময় বিভিন্ন রাজনৈতিক সংগঠনের নেতৃবৃন্দের সাথে সার্বক্ষণিক যোগাযোগ ছিলো। বিশেষ করে রাবির ক্রিয়াশীল ছাত্র সংগঠনের নেতৃবৃন্দ, জাতীয়তাবাদী ছাত্রদল, ইসলামী ছাত্রশিবির সরাসরি আন্দোলনে যুক্ত ছিলো। ছাত্রদলের মিঠু ভাইয়ের সাথে আমার সার্বক্ষণিক যোগাযোগ ছিলো। তিনিও যথেষ্ট আপডেট থাকতেন। বর্তমান ভিসি নকীব স্যার, আ-আল মামুন, কাজী মামুন হায়দার রানা, সেলিম রেজা নিউটন, আমিরুল ইসলাম কনক, হাবিব জাকারিয়া উল্লাস স্যারসহ অনেক শিক্ষক আমাদের আন্দোলনে সাহস ও শক্তি যুগিয়েছে। রাতে থানা থেকে আটক শিক্ষার্থীদের বের করে আনা থেকে শুরু করে রাজপথেও তাদের ভূমিকা ছিলো চমৎকার।
ক্যাম্পাস সাংবাদিকদের পাশাপাশি শহরের অন্য অনেক সাংবাদিকের সাথে আমাদের যোগাযোগ ছিলো। ঢাকা থেকে এক বড় ভাই জাতীয় পত্রিকা ও মিডিয়ার সাংবাদিকদের নম্বর দেয়। তাদের সাথেও সবসময় যোগাযোগ করা হয়েছে। এছাড়া বিদেশে থাকা সাংবাদিক মুনওয়ার আলম নির্ঝর ভাইকে সবসময় রাজশাহীর আন্দোলনের ছবি, ভিডিও প্রতিনিয়ত পাঠানো হতো। তিনি তার মতো সর্বত্র ছড়িয়ে দিতেন।
২৮ জুলাই থেকে আমরা যারা সমন্বয়কের দায়িত্ব পালন করেছি, এখানে যে ১৭ জন আছে, তারা সকলে এক প্রকার বুলেট সামনে রেখে নাম দিয়েছে। ওই পরিস্থিতিতে অনেককেই ফোন দেয়া হয় যারা অপরাগতা প্রকাশ করেন। এখানে কেউ অহংকার দেখানোর জন্য সমন্বয়ক হননি। সবাই একরকম জীবনবাজি রেখে ঐ পরিস্থিতিতে আন্দোলন পরিচালনা করেছেন। ১৭ জনের সমন্বয়টাও ছিলো দুর্দান্ত। তবে ৫ আগস্ট আমাদের রোড মার্চ টু ঢাকা কর্মসূচি ছিল। ঐ দিনই রাজশাহীতে দুজন সহযোদ্ধা আলুপট্টিতে পুলিশ, আওয়ামী লীগ ও যুবলীগের হামলায় গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যান। তাদের একজন শহীদ শাকিব আনজুম এবং অন্যজন আলী রায়হান। আলী রায়হান প্রথমে আহত হন। পরে ৮ আগস্ট মারা যান। ৫ আগস্ট সকালে হঠাৎ করে নেট বন্ধ করে দেয় তৎকালীন সরকার। তখন আমরা যোগাযোগহীন হয়ে পড়ি। দুপুরে নেট ফেরত আসতে আসতে আমাদের দুজন ভাই শহীদ হয়ে যান।
সর্বোপরি রাজশাহীতে অবস্থিত সকল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থী, অভিভাবক ও সর্বস্তরের নাগরিকদের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণে রাবিতে আন্দোলন সফল হয়।
বাসস: জুলাই গণঅভ্যুত্থানে কবে থেকে অংশ নেয়া শুরু করেন?
মেহেদী হাসান মুন্না: ১০ জুলাই থেকে আমি আন্দোলনে পুরোপুরি শরীক হই। রাবিতে আন্দোলনের সূচনালগ্নে আমি ক্যাম্পাসেই ছিলাম। প্রতিনিয়ত আন্দোলনের আপডেট নিতাম। আমার যোগাযোগ ও প্রতিনিয়ত আপডেট নেয়া ছাড়া তেমন কোনও উপায় ছিলো না। ক্যাম্পাসে ছাত্র রাজনীতির পরিচিত মুখ হওয়াতে সাধারণ শিক্ষার্থী ব্যানারে কোটা সংস্কার আন্দোলন রাবি নামে যে আন্দোলন হচ্ছিলো আমি গেলে রাজনৈতিক ট্যাগ লাগবে বা আমার মতো ক্যাম্পাসে যারা রাজনীতি করে তারা অংশ নিলে ছাত্রলীগ ও প্রশাসন আন্দোলনকে ভিন্ন খাতে প্রভাবিত করতে পারে, শিক্ষার্থীদের হয়রানি করতে পারে তাই আমাদের অংশ নেয়াটা বেশ জটিল করে দেখা হয়েছিল সে সময়। তারপরও ক্রিয়াশীল সংগঠনসমূহের অনেকেই তখন আন্দোলনে নেতৃত্ব না দিলেও যুক্ত ছিলেন। আন্দোলনের পালস না বুঝে সারাদেশ থেকে ভিন্ন ব্যানারে আন্দোলন করা এবং সবার সাথে কোন সমন্বয় না থাকা এমনসব কর্মকাণ্ডের কারণে রাবির আন্দোলনের সূচনা পর্বটা বিতর্কিত ভাবে শেষ হয়। ঠিক তারপর পরই আমিসহ অন্যান্য ক্রিয়াশীল সংগঠনের নেতৃবৃন্দ আন্দোলনটাকে বেগবান করার চেষ্টা করতে থাকি। এরই প্রেক্ষাপটে ১৫ জুলাই সন্ধ্যায় ক্রীয়াশীল ছাত্র সংগঠনের নেতৃবৃন্দের ওপর ছাত্রলীগ হামলা চালায়। আমরা তাৎক্ষণিক প্রতিবাদে মশাল মিছিল করি। ছাত্রলীগের শোডাউনও চলছিলো। ১৫ জুলাই ছিলো রাবির আন্দোলনের টার্নিং পয়েন্ট। সারাদেশের ক্যাম্পাসগুলোতে হামলা চলছিল। ১৫ জুলাই রাবিতে ছিল সুনসান নীরবতা। আমাদের নেতৃবৃন্দের ওপর হামলার পর মশাল মিছিলটি নীরব ক্যাম্পাসে শিক্ষার্থীদের মাঝে বেশ আশা জাগিয়েছিল। মিছিল শেষে আমাদের বক্তব্য ছিল খুবই ঝাঁঝালো।
বাসস: আপনি তো দীর্ঘদিন ধরেই ছাত্ররাজনীতির সাথে যুক্ত, জুলাই পরবর্তী সময়ে ছাত্র রাজনীতি নিয়ে কিছু বলবেন?
মেহেদী হাসান মুন্না: জুলাই পরবর্তী সময়ে ছাত্র রাজনীতির পুনর্জাগরণ ঘটেছে। তবে তা দেশের কল্যাণে কাজে লাগবে যখন ছাত্র রাজনীতিতে দলীয় লেজুড়বৃত্তি থাকবে না। তার বড় উদাহরণ জুলাই গণঅভ্যুত্থানে নেতৃত্বের গুরুত্বপূর্ণ অংশ গণতান্ত্রিক ছাত্রশক্তি। আমাদের দেশে দলীয় রাজনৈতিক ছাত্র সংগঠনগুলো তৈরিই হয় ক্যাম্পাসে আধিপত্য বিস্তার ও এক মায়ের সন্তানকে দিয়ে আরেক মায়ের সন্তানের রক্ত ঝরানো ও মায়ের বুক খালি করতে। গণঅভ্যুত্থানের পরও এই ধারা অব্যাহত আছে। ১৬ বছর আওয়ামী লীগের ছাত্র সংগঠন ছাত্রলীগ ক্যাম্পাসগুলোতে যে পরিমাণ সন্ত্রাস কায়েম করেছিল তার ফলাফল কিন্তু আমরা জুলাই-আগস্টে দেখেছি। তাদের ১৬ বছরের সাম্রাজ্য চোখের পলকে ভেঙে দিয়েছিলো ছাত্র-জনতা। তবে ১৬ বছরে ছাত্র রাজনীতিতে যে পরিমাণ বিরাজনীতিকরণ হয়েছে তাতে এতো দ্রুত আশানুরূপ ফল পাওয়া যাবে না। বিশ্ববিদ্যালয় গুলোতে ছাত্র সংসদ নির্বাচন না হওয়াটাও হতাশাজনক। আবার ছাত্র সংসদের গঠনতন্ত্রে পুরনো আমলের যেই জরাজীর্ণতা আছে তারও বড় ধরনের পরিবর্তন বা সংস্কার দরকার। তাহলেই জুলাই পরবর্তী ছাত্র রাজনীতির যে পুনর্জাগরণ ঘটেছে তা ধরে রাখা সম্ভব হবে। জাতির ক্রান্তিলগ্নে মুক্তির পথ দেখাবে।
বাসস: বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ছাত্রলীগ বিতাড়িত করার দিনটি কেমন ছিল?
মেহেদী হাসান মুন্না: ১৫ জুলাই রাতে আমরা মিটিং করছিলাম। একের পর এক মোবাইলে কথা বলছিলাম বিভিন্ন জনের সাথে। রাজনৈতিক, অরাজনৈতিক সংগঠন থেকে শুরু করে রাজশাহী মহানগরে যারা এক্টিভ আছে সবার সাথেই একের পর এক কথা হচ্ছিল। এমনকি আন্দোলন নিয়ে যাদের সাথে বিভক্তি ছিল সবার সাথেই কথা হয়। দুর্দান্ত একটা পরিকল্পনা করা হয়েছিল। আমাদের একটা ধারণা ছিলো ক্যাম্পাসে বড়জোড় একশোর মতো ছাত্রলীগ নেতা কর্মী অবস্থান করছে। কারণ কিবরিয়া-রুনুর পর নতুন কমিটি বেশ দুর্বল ছিল। ছাত্রলীগ কোন অপরাধ বা শিক্ষার্থী নির্যাতন করলে প্রতিবাদের মাধ্যমে আমরা বেশ চাপে রাখতাম। সাথে প্রশাসনও চাপে থাকত। এক্ষেত্রে নিউজের মাধ্যমে ক্যাম্পাস সাংবাদিকরা বড় ধরনের ভূমিকা রেখেছে। রাবি ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক আসাদুল্লাহ হিল গালিবকে জুনের ছয় তারিখেই ক্যাম্পাসে সাত সংগঠনের ছাত্রনেতারা অবাঞ্ছিত ঘোষণা করে। এর প্রভাবও পড়ে।
সারাদেশে ও ক্যাম্পাসগুলোতে ছাত্রলীগের হামলায় প্রত্যেক শিক্ষার্থী মর্মাহত। যারা কখনো কোন কিছুর প্রতিবাদ করেনি তারাও ফোন দিয়ে জানতে চাচ্ছে, কাল কখন নামব। শিক্ষার্থীরা বেশ আতঙ্কিত ছিল। এরই মধ্যে কয়েকটা ক্যাম্পাসে পুলিশ ও ছাত্রলীগ হামলা চালাচ্ছিল। রাতে আমাদের এক নারী শিক্ষার্থী কান্না জড়ানো কণ্ঠে ফোন দিয়ে বলছিল, ‘ভাই কাল কখন আন্দোলন হবে?’ আমার মনে হয় রাবিতে বিগত দিনগুলোতে এমন স্বতঃস্ফূর্ত আন্দোলন ও জাগরণ কখনো ঘটেনি। যেখানে প্রত্যেকেই এক একজন বিপ্লবী।
আমাদের মিটিং শেষ হতে হতে অনেক রাত হয়ে যায়। মিশু আর আমি আমার বাসাতেই ছিলাম এই রাতে।
আমি একটুও ঘুমাইনি। ও বারবার বলছিল, ঘুমা, সকালে উঠতে পারবি না। সকালে বের হলাম। আতাউল্লা পাইপ আর বাঁশের লাঠি আনতে বিনোদপুর যাবে। মিছিল প্রবেশ করলেই ও ঢুকবে। এদিকে প্রত্যেক হলে আগেই সতর্কবার্তা দেয়া হয় ছাত্রলীগ হলের গেটে তালা মারবে তাই বিক্ষোভ শুরু হওয়ার আগেই সবাই হল থেকে বাইরে অবস্থান করবে। মেহেদী মারুফ আগেই ৭ হাজার টাকার মতো পাইপ কিনে নিরাপদে রেখেছিল। রাতুল ওরা ওদের মতো ক্যাম্পাসে প্রবেশ করবে। সাংবাদিক ছোট ভাই এস আই সুমন থেকে আপডেট নিচ্ছি। সুমনকে বললাম চারুকলা দিয়ে রিক্সা নিয়ে ঢুকতেছি। ওরা বাইকে তিনজন ছিল। রিক্সায় আমি আর শাকিল ভাই ছিলাম। ওরা একরকম নিরাপদে বিশ্ববিদ্যালয়ের তুত বাগান পর্যন্ত আমাদের রিক্সা পৌঁছে দিয়ে হবিবুর হলের দিক গেল। রিক্সা নিয়ে সেকেন্ড সাইন্স বিল্ডিং-এর পুকুর পাড় দিয়ে আবুর ক্যান্টিনে নামলাম। কারণ ছাত্রলীগের বাইক-শোডাউন চলছিল। পরিবহনে কোনমতে এসে পৌঁছানোর সাথে সাথেই কে যেন বলল, ছাত্র উপদেষ্টা আপনার সাথে কথা বলবে। আমি সরাসরি বললাম পরিবহনে আসতে। এখানে সরাসরি কথা হবে। এরই মধ্যে দেখা গেল ছাত্র উপদেষ্টা এনামুল ভাইয়ের দোকানের কিছুটা পিছনে দাঁড়ানো।
কথা শুরু করার আগেই আমি ডিরেক্ট বললাম শিক্ষার্থীদের পক্ষে অবস্থান না নিলে পরিস্থিতি ভয়ানক হবে। নিরাপত্তা দেয়ার দায়িত্ব ছাত্র উপদেষ্টা হিসেবে আপনার তা বলে চলে আসলাম। ক্যাম্পাসে মিছিল নিয়ে মেইনগেট থেকে প্রবেশ করছে বিশাল এক জমায়েত, প্যারিস রোডে মিছিল আসতেই আমরাও যুক্ত হলাম। উদ্দেশ্য মেয়েদের হলের দিকে যাত্রা করা। শোনা যাচ্ছিলো মেয়েদেরকে হল গেইটে তালা দিয়ে আটকে রেখেছে প্রশাসন। আমরা রওনা হলাম। পথিমধ্যেই দেখতে পেলাম মেয়েদের একটা বিশাল মিছিল আসছে। সবাই যুক্ত হলো। বিক্ষোভ মিছিল ক্যাম্পাস প্রদক্ষিণ করতে লাগল। প্রত্যেক হলে গিয়ে শিক্ষার্থীদের আনা হচ্ছিলো। এরই মধ্যে আন্দোলনকারীদের ধাওয়া খেয়ে ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক গালিব বাইকে করে পালিয়ে যাচ্ছিলেন। এই ভিডিওটা করেন বর্তমান রাজশাহীর ডেইলি স্টার প্রতিনিধি ছোটভাই সোহানুর রহমান রাফি। তার থেকে ভিডিওটা নিয়েই মিশু ফেসবুকে পোস্ট করে। মুহূর্তের মধ্যেই ভাইরাল। এমন পলায়ন দৃশ্য পুরো বাংলাদেশে ছাত্রলীগের ভীত নড়বড়ে করে দিয়েছিলো। এদিকে শিক্ষার্থীরা বঙ্গবন্ধু হল অর্থাৎ বর্তমান বিজয় ২৪ হলে ছাত্রলীগের ১৬ বছরের সাম্রাজ্য ধ্বংস করে। ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের রুম থেকে দেশীয় অস্ত্রসহ পিস্তল উদ্ধার করে শিক্ষার্থীরা। হলে ছাত্রলীগের বাইকগুলোতে আগুন দেয়া হয়। আগুনের ধোঁয়া আকাশের দিকে উড়ছে আর আমরা কয়েকজন যারা দীর্ঘদিন ছাত্রলীগের সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করেছি, ক্যাফেটেরিয়ার সামনে থেকে দেখছি হাসিনার ফ্যাসিস্ট রেজিমের অন্যতম সন্ত্রাসী সংগঠন ছাত্রলীগের মসনদ পুড়ে ছাই হচ্ছে। এ দৃশ্য সত্যিই দেখার মতো ছিল।
বঙ্গবন্ধু হল (বর্তমান বিজয় ২৪) থেকে শিক্ষার্থীরা কেউ প্যারিস রোডের দিকে আবার কেউ অন্য হলের উদ্দেশ্যে যাত্রা করে। এরই মধ্যে খবর আসে বিক্ষোভরত শিক্ষার্থীদের ভয়ে ছাত্রলীগের সভাপতি ও বেশ কয়েকজন ছাত্রলীগের নেতাকর্মী হলের ছাদে অবস্থান করছে। শিক্ষার্থীরা পৌঁছাতে পৌঁছাতে পুলিশ ভয়ার্ত ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের নিরাপদে সরিয়ে নিয়ে যায়। তারা আর ক্যাম্পাসে ফিরতে পারেনি। এভাবেই ক্যাম্পাস ছাত্রলীগ মুক্ত হয়।
তবে এরপর থেকে নানা রকম ভয়ভীতি ও গুজব আসতে শুরু করে। এরইমধ্যে মিশুর ফেসবুক আইডি থেকে গালিবের পলায়নের ভিডিও ভাইরাল হওয়ায় হত্যার হুমকি আসতে থাকে। এসব তোয়াক্কা না করেই আমরা আন্দোলনকে বেগবাব করার উদ্দেশ্যে সামনের দিকে অগ্রসর হতে থাকি।
বাসস: আপনি তো কয়েকদফায় হামলার শিকার হয়েছেন, সে বিষয়ে কিছু বলেন।
মেহেদী হাসান মুন্না: ছাত্রলীগ আমার ওপর একাধিকবার হামলা করে। ২০২৩ সালের ২৯ অক্টোবর পল্টনে চায়ের গলিতে পল্টন থানা ছাত্রলীগ আমার ওপর অতর্কিত হামলা চালায়। ওই দিন হরতাল ছিলো। ঝটিকা মিছিল শেষে বিকালে গণতন্ত্র মঞ্চের সংবাদ সম্মেলন ছিল। আমরা কয়েকজন দারুস সালাম মার্কেটের নিচে দাঁড়িয়ে ছিলাম, হঠাৎ করেই শতাধিক ছাত্রলীগ নেতাকর্মী সবার হাতে দেশীয় অস্ত্র ছিল, আমাকে টার্গেট করে হামলা করে, মোবাইল কেড়ে নেয়। ফেসবুক ও গ্যালারি চেক করার পর ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা তেড়ে আসে। একজন স্ট্যাম্প দিয়ে নাভি বরাবর আঘাত করে। মারাত্মক ব্যথা পাই। মোবাইল আর ফেরত দেয়নি।
ক্যাম্পাসে ২০২২ সালের ১৯ অক্টোবর রাতে ভিসির বাসভবনের সামনে ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা আমার ওপর হামলা চালায়। এছাড়াও নানাভাবে আমাকে হয়রানির শিকার হতে হয়েছে। ক্যাম্পাসে রাজনীতি ও ফেসবুকে লেখালেখির কারণে বাসায়ও পুলিশ ফোন দিয়ে বাবা-মাকে সতর্ক করেছে। হুমকি-ধামকি এগুলো নিত্য নৈমিত্তিক ব্যাপার ছিলো।
বাসস: নতুন বাংলাদেশের সম্ভাবনা কেমন?
মেহেদী হাসান মুন্না: বিগত ১৬ বছরে হাসিনার ফ্যাসিস্ট রেজিম দেশটাকে একটা ধ্বংসযজ্ঞে পরিণত করেছে। বিশ্ববিদ্যালয় থেকে শুরু করে সকল প্রতিষ্ঠান দলীয়করণ করা হয়েছে এবং এসব অনিয়ম-দুর্নীতির আখড়ায় পরিণত হয়েছে। আসলে আমরা শুধু হাসিনাকেই সরাতে পেরেছি। কিন্তু হাসিনার ১৬ বছরে যারা তার পৃষ্ঠপোষক ছিলো তারা সেই জায়গাতেই বসে আছে। আওয়ামী মিডিয়া থেকে শুরু করে কালচারাল এস্টাবলিশমেন্ট ও অলিগার্করা এখনো বহাল তবিয়তে আছে। জুলাই গণ-অভ্যুত্থান মানুষের মনে নতুন বাংলাদেশের আশা জাগিয়েছে। মানুষের আশা আকাঙ্ক্ষার বাস্তবায়ন করতে হলে অভ্যুত্থানের অভিপ্রায় ফ্যাসিবাদবিরোধী সকল রাজনৈতিক দল ও বর্তমান ইন্টেরিম সরকারকে বুঝতে হবে। ৫৩ বছরে বাংলাদেশের রাজনীতিতে দেখা গেছে কেবল ‘রাজা আসে রাজা যায়’ কিন্তু মানুষের ভাগ্যের পরিবর্তন ঘটে না। এর থেকে শিক্ষা নিয়ে গণঅভ্যুত্থানে জনপ্রত্যাশার দিকে সকলকে নজর দেয়া উচিত। ক্ষমতার ভাগ-বাটোয়ারার রাজনীতি থেকে সকলকে বের হতে হবে। মহান মুক্তিযুদ্ধকে ব্যবহার ও জনগণকে বিভাজিত করে ১৬ বছর আওয়ামী সরকার যে রাজনীতি করে আসছে তা এখনো বহমান আছে। আওয়ামী লীগের তৈরি বাইনারি রাজনীতির যে বিষাক্ত ধোঁয়া এখনো সমাজ ও সংস্কৃতিতে মিশে আছে তার থেকে জনগণকে মুক্ত করতে হবে। বিভাজনের বাইনারি রাজনীতি থেকে বের হতে পারলেই নতুন বাংলাদেশের স্বপ্ন বাস্তবায়ন করা সম্ভব। যা একই সাথে গণঅভ্যুত্থানের আকাঙ্ক্ষাও বটে।
বাসস: ফ্যাসিবাদের সময় আমরা দেখেছি অনেক আন্দোলন সংগ্রাম হলেও সেগুলো এক পর্যায়ে গিয়ে আর এগুতে পারেনি, জনগণ সম্পৃক্ত হয়নি। ফলে আন্দোলনও সফলতার মুখ দেখেনি। কিন্তু এবার আন্দোলনে সম্পূর্ণ ভিন্ন চিত্র দেখা গেল। এর কি কারণ?
মেহেদী হাসান মুন্না: ফ্যাসিবাদের আমলে অনেক আন্দোলন সংগ্রাম হয়েছে। ১৬ বছরের যে মাফিয়াতন্ত্র কায়েম করেছিলো হাসিনা, তার বিরুদ্ধে পুঞ্জিভূত ক্ষোভ বিস্ফোরিত হয়েছে জুলাইতে। ফ্যাসিবাদের আমলে এমন কোন অপকর্ম নাই যা হাসিনা করেনি। গুম-খুন থেকে শুরু করে মানুষের বাকস্বাধীনতা কেড়ে নিয়েছিলো হাসিনা। যে কোন আন্দোলন সফল করতে হলে নাগরিক অধিকারগুলোকে এড্রেস করতে হয়। যা করতে আমাদের মূলধারার রাজনৈতিক দলগুলো ব্যর্থ হয়েছে।
জুলাই আন্দোলন গড়েই উঠেছে কোটাকে কেন্দ্র করে। এই কোটার কারণে যে পরিমাণ বৈষম্য হয় তার ভুক্তভোগী ছাত্র-নাগরিক থেকে শুরু করে সকলেই।
এছাড়া, হাসিনার সকল বাহিনী ছাত্র-জনতার ওপর যে অমানবিক নির্যাতন নিপীড়ন চালিয়েছে তা সমাজের সকল বর্গের মানুষের বিবেককে নাড়া দিয়েছে। ফলে সকলেই ঐক্যবদ্ধ হয়ে হাসিনাশাহীর পতন ঘটিয়েছে। তখন কোনো বিভাজন ছিল না। সকল পক্ষই হাসিনার জুলুমের বিরুদ্ধে রাস্তায় নেমে পড়ে, এটাই গণঅভ্যুত্থান।
বাসস: নতুন বাংলাদেশ বিনির্মাণে গণঅভ্যুত্থানের যে আকাঙ্ক্ষা ছিল তার বাস্তবায়ন হচ্ছে কী না? আপনি কী মনে করেন?
মেহেদী হাসান মুন্না: দীর্ঘ ১৬ বছরের কর্তৃত্বপরায়ণ শেখ হাসিনা সরকারের স্বৈরাচারী শাসনব্যবস্থার পতন হয় জুলাই গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে। হাসিনার পতন হওয়ার পর নতুন বাংলাদেশ বিনির্মাণে জনগণের মাঝে নতুন আশার সঞ্চার হয়েছিলো, যা অনেকাংশেই বাস্তবায়িত হচ্ছে না। রাজনৈতিক পট পরিবর্তন ঘটলেও এখনো পতিত সরকারের নিয়মেই দেশ চলছে। বর্তমান সরকার চেষ্টা করছে কীভাবে নতুন রাজনৈতিক পরিস্থিতি তৈরি করা যায়। আসলে জনগণ শুধু হাসিনার পতনের জন্য রাজপথে নামে নাই। তারা নতুন স্বপ্ন দেখা শুরু করেছিলো এই দেশ নিয়ে, তার বাস্তবায়ন করাই ইন্টেরিম বা যেকোন সরকারের প্রধান এজেন্ডা হওয়া উচিত। হাজারো শহীদ ও আহত মানুষের যে ত্যাগ তা ম্লান করে বেশি দূর এগুনো যাবে না।
অভ্যুত্থানের পর রাজননৈতিক ও আর্থ সামাজিক পরিবর্তনে অনেক বাধার সম্মুখীন হচ্ছেন বর্তমান সরকার। ফ্যাসিবাদী শক্তি নানা ধরণের অপতৎপরতা চালাচ্ছে। তাই সকল ফ্যাসিবাদবিরোধী শক্তির ঐক্যই পারে বাংলাদেশের স্বাধীনতা, সার্ভভৌমত্ব ও অখণ্ডতা রক্ষা করতে। তাহলেই নতুন বাংলাদেশের যে আকাঙ্ক্ষা তৈরি হয়েছে তার বাস্তবায়ন সম্ভব।
গণঅভ্যুত্থানের আকাঙ্ক্ষা বাস্তবায়ন করতে হলে বৈষম্য নিরসন, গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা, জবাবদিহিতা ও ফ্যাসিবাদবিরোধিতা জরুরি। আমাদের লক্ষ্য সেদিকে রাখা উচিত। কোনো শহীদের রক্তের সাথে বেইমানি করা যাবে না। শহীদদের আকাঙ্ক্ষা বাস্তবায়ন করতে হলে এসব প্রতিষ্ঠা করতে হবে।
বাসস: বর্তমান সরকারের কাছে আপনার প্রত্যাশা কী?
মেহেদী হাসান মুন্না: নতুন করে যেনো কেউ স্বৈরাচারী হয়ে উঠতে না পারে এর বন্দোবস্ত ইন্টেরিম সরকারকেই করতে হবে। জুলাইতে আওয়ামী লীগ যে গণহত্যা চালিয়েছে তার বিচার নিশ্চিত করতে হবে। একই সাথে ১৬ বছর যে অপশাসন-দুর্নীতি, গুম-খুন ও মানবাধিকার লঙ্ঘন করা হয়েছে তার বিচারও নিশ্চিত করতে হবে। জুলাই সনদ ও ঘোষণাপত্র দিতে হবে।
দেশের জনগণের জন্য সংস্কার শেষে বৈষম্যহীন একটি গণতান্ত্রিক ভবিষ্যৎ নির্ধারণ করে মানবিক কল্যাণরাষ্ট্র উপহার দিতে পারলেই জুলাই আকাঙ্ক্ষা বাস্তবায়িত হবে।
বাসস: নতুন বাস্তবতায় রাজনৈতিক দলগুলোর কাছে আপনার প্রত্যাশা কেমন?
মেহেদী হাসান মুন্না: বিগত সময়ে যে পেশিশক্তির রাজনীতি আমরা দেখেছি তা এখনো চলমান। তাই রাজনৈতিক দলগুলোর কাছে প্রত্যাশা জনগণের স্বার্থকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দেয়া এবং গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ প্রতিষ্ঠায় সহনশীল রাজনৈতিক সংস্কৃতি গড়ে তোলা। কোনোভাবে যাতে ফ্যাসিবাদী শক্তি মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে না পারে সেদিকে রাজনৈতিক দলগুলোকে মনোযোগ দিতে হবে। নিজেদের ভেতরে কোন্দল না করে নতুন রাজনৈতিক সংস্কৃতি গড়ে তুলতে হবে। যাতে ন্যায্যতা প্রতিষ্ঠা পায়।