শিরোনাম
দেলোয়ার হোসাইন আকাইদ
কুমিল্লা, ২৮ জুলাই, ২০২৫ (বাসস) : বৈষম্য ও অনিয়মের বিরুদ্ধে সারাদেশব্যাপী ছাত্র-জনতার যে অভ্যুত্থান গড়ে উঠেছিল তার একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় রচিত হয় কুমিল্লায়। টানা দমন-পীড়ন, নির্যাতন, ছাত্রাবাসে হামলা, গণগ্রেপ্তার ও আন্দোলনকারীদের উপর একের পর এক মামলা দায়ের করার পরেও কুমিল্লায় ছাত্ররা আবারও রাস্তায় নামার সাহস দেখায়।
এই দিনটি ছিল এক অর্থে পুনর্জাগরণের দিন। পাড়া-মহল্লা, শহরতলি ও বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে আন্দোলনের নতুন ঢেউ ছড়িয়ে পড়ে। অনেকের চোখে এটি ছিল ‘অন্ধকার থেকে আলোয় ফেরার দিন’।
২৮ জুলাই আন্দোলনকারী ছাত্ররা ছোট ছোট দলে ভাগ হয়ে গোপনে পরিকল্পনা করতে শুরু করে। কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়, পলিটেকনিক্যাল, ভিক্টোরিয়া সরকারি কলেজসহ জেলার বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে ছাত্ররা গোপনে যোগাযোগ শুরু করে ।
প্রশাসনের নজরদারি, ডিবি, পুলিশ, র্যাব ও ছাত্রলীগ-যুবলীগের টার্গেট হামলায় তারা প্রতিনিয়ত হুমকির মধ্যে ছিল। বিশেষ করে ছাত্রাবাস বন্ধ করে দিয়ে ছাত্রদের ছত্রভঙ্গ করার চেষ্টা করা হয়।
তবুও ২৮ জুলাই গভীর রাতে, শিক্ষার্থীরা সিদ্ধান্ত নেয় তারা ২৯ জুলাই একযোগে মাঠে নামবে। একটি সমন্বিত কর্মসূচি নির্ধারণ করে শান্তিপূর্ণ বিক্ষোভ ও প্রতিরোধ গড়ে তোলার ঘোষণা দেওয়া হয়।
২৯ জুলাই সকাল থেকে কুমিল্লা শহরের বিভিন্ন এলাকায় ছড়িয়ে পড়ে ছাত্রদের প্রতিবাদী স্লোগান, প্ল্যাকার্ড আর দেওয়াল লিখনের দৃশ্য। বিচ্ছিন্ন ও গোপন যোগাযোগের মধ্য দিয়েই তারা একটি ঐক্যবদ্ধ সুরে প্রতিবাদ জানাতে সক্ষম হয়।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের কেন্দ্রীয় নেতৃত্বকে ডিবি কার্যালয়ে তুলে নিয়ে চাপের মাধ্যমে তথ্য আদায় করার ঘটনায় কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয় (কুবি)এর শিক্ষার্থীরা ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে। এই অপমান ও অন্যায়ের প্রতিবাদে এবং বিভিন্ন স্থানে শিক্ষার্থীদের উপর হামলা এবং হত্যার বিচারের দাবিতে তারা রাজপথে অবস্থান নেওয়ার ঘোষণা দেন।
কুবি শাখা বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়ক হাসান অন্তর জুলাই আন্দোলনের স্মৃতিচারণ করে বলেন,‘দমন-পীড়ন আমাদের বিচ্ছিন্ন করেছিল, কিন্তু থামাতে পারেনি। ২৮ জুলাই রাতে আমরা আবার সংগঠিত হই, ২৯ জুলাই আমরা আবার রাস্তায়। হামলা, গ্রেপ্তার, মামলার ভয়কে আমরা পায়ে দলে দিয়েছি।’
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের কুমিল্লা জেলা শাখার আহ্বায়ক সাকিব হোসাইন বাসসকে বলেন,‘পুলিশ ও ছাত্রলীগ একসঙ্গে আমাদের কেন্দ্রীয় সমন্বয়কারীদের তুলে নিয়েছে। এরপরও আমরা থামিনি। কুমিল্লা থেকেই আমরা জানিয়ে দিয়েছি এর বিচার না হলে, জবাব না এলে আমরা বারবার ফিরে আসব।’
কুমিল্লা সম্পাদক পরিষদের সভাপতি নজরুল ইসলাম দুলাল বলেন, ‘এই আন্দোলন কেবল একটি সরকারের বিরুদ্ধে নয়, এটি দীর্ঘস্থায়ী বৈষম্য, অনিয়ম ও দুর্নীতির বিরুদ্ধে একটি প্রজন্মের প্রতিবাদ। আমরা ইতিহাসের এক ক্রান্তিলগ্নে বাস করছি। এই প্রজন্ম শুধু প্রশ্ন করে না, জবাবও দাবি করে।’
সাবেক ছাত্রনেতা ও আইনজীবী মো. অ্যাডভোকেট বদিউল আলম সুজন বলেন, ‘শহীদেরা আমাদের স্মৃতিতে থাকবেন। যদি আমরা এই আন্দোলনের চেতনা টিকিয়ে রাখতে পারি তাদের রক্ত বৃথা যাবে না। কুমিল্লার রাজপথে জুলাইয়ের যে পদচারণা হয়েছে, তা একদিন ইতিহাসের অংশ হবে।’
জুলাই গণঅভ্যুত্থান এখন আর শুধু একটি আন্দোলনের নাম নয়, এটি হয়ে উঠেছে প্রতিরোধ, জেগে ওঠা, সংহতি ও ভবিষ্যতের প্রতিশ্রুতির প্রতীক। কুমিল্লার ছাত্রসমাজ এই আন্দোলনের মাধ্যমে প্রমাণ করেছে দমন, পীড়ন, হামলা কিংবা তুলে নেওয়ার ভয় দেখিয়ে তাদের থামানো যাবে না।
এ আন্দোলনের চরিত্রে রয়েছে আত্মত্যাগ, সাহস এবং সততার দাবি। নিপীড়নের অন্ধকার থেকে বেরিয়ে শিক্ষার্থীরা আবারও দেখিয়েছেন, তারা কেবল প্রতিবাদীই নয়, বরং একটি নতুন সমাজ কল্পনার বাহক।
২৯ জুলাইয়ের বিক্ষোভ ছিল কেবল একটি কর্মসূচি নয়, ছিল আত্মার পুনর্জন্ম। বিচ্ছিন্ন ছাত্ররা পুনরায় একত্রিত হয়ে জাতিকে নতুন উদ্দীপনায় এগিয়ে যাওয়ার বার্তা দেয়।