বাসস
  ২৮ জুলাই ২০২৫, ১৩:০১

চব্বিশের ২৮ জুলাই: দমন ভেঙে গর্জে ওঠে কুমিল্লার শিক্ষার্থীরা

ছবি: বাসস

\ দেলোয়ার হোসাইন আকাইদ \

কুমিল্লা, ২৮ জুলাই, ২০২৫ (বাসস): বৈষম্য ও অনিয়মের বিরুদ্ধে ২০২৪ সালের জুলাই মাসে সারাদেশে ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থান গড়ে ওঠে। আর তার একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় রচিত হয়েছিল কুমিল্লাতে।

টানা দমন-পীড়ন, নির্যাতন, ছাত্রাবাসে হামলা, গণগ্রেফতার ও আন্দোলনকারীদের বিরুদ্ধে একের পর এক মামলা দায়েরের পরও কুমিল্লার শিক্ষার্থীরা ফের রাস্তায় নামার সাহস দেখায়। 

চব্বিশের ২৮ জুলাই ছিল সেই পুনর্জাগরণের দিন। পাড়া-মহল্লা, শহরতলি ও বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে আন্দোলনের নতুন ঢেউ ছড়িয়ে পড়ে। অনেকের কাছে দিনটি ছিল 'ছায়া থেকে আলোয় ফেরার দিন'।

২৮ জুলাই আন্দোলনকারী ছাত্ররা ছোট ছোট দলে ভাগ হয়ে গোপনে পরিকল্পনা শুরু করেন। কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়, পলিটেকনিক্যাল, ভিক্টোরিয়া সরকারি কলেজসহ জেলার বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা একে অপরের সঙ্গে যোগাযোগ বাড়ান। তারা জানত, প্রশাসনের কঠোর নজরদারি চলছে। ডিবি, পুলিশ, র‌্যাব ও ছাত্রলীগ-যুবলীগের টার্গেট হামলার ভয় ছিল প্রতিনিয়ত। ছাত্রাবাস বন্ধ করে দিয়ে আন্দোলন থামানোর চেষ্টা করা হয়েছিল।

তবুও ২৮ জুলাই রাতে শিক্ষার্থীরা সিদ্ধান্ত নেয়, তারা ২৯ জুলাই একযোগে মাঠে নামার। একটি সমন্বিত কর্মসূচি নেওয়া হয়, যাতে শান্তিপূর্ণ বিক্ষোভ ও প্রতিরোধ গড়ে তোলার ঘোষণা দেওয়া হয়।

২৯ জুলাই, সকাল

কুমিল্লা শহরের বিভিন্ন এলাকায় ছড়িয়ে পড়ে ছাত্রদের প্রতিবাদী স্লোগান, প্ল্যাকার্ড ও দেয়াল লিখনের কর্মসূচি। 

বিচ্ছিন্ন অবস্থায় থেকেও তারা ঐক্যবদ্ধ কণ্ঠে প্রতিবাদ জানাতে সক্ষম হয়।

কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের অভিযোগ, সেসময় তাদের কেন্দ্রীয় নেতৃত্বকে ডিবি কার্যালয়ে তুলে নেওয়া হয়। সেই অন্যায় সহ্য করা যায়নি বলে ছাত্ররা আরো ক্ষোভে ফেটে পড়ে। সহপাঠীদের ওপর হামলা ও নিহতদের বিচার না হওয়া পর্যন্ত তারা রাজপথ না ছাড়ার ঘোষণা দেন।

কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয় শাখা বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়ক হাসান অন্তর বলেন, দমন-পীড়ন আমাদের বিচ্ছিন্ন করেছিল, কিন্তু থামাতে পারেনি। ২৮ জুলাই রাতে আমরা আবার সংগঠিত হই, ২৯ জুলাই আমরা আবার রাস্তায়। হামলা, গ্রেফতার ও মামলার ভয়কে আমরা পদদলিত করেছি।

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের কুমিল্লা জেলা শাখার আহ্বায়ক সাকিব হোসাইন বলেন, পুলিশ ও ছাত্রলীগ একসঙ্গে আমাদের কেন্দ্রীয় সমন্বয়কারীদের তুলে নেয়। এরপরও আমরা থামিনি।

এই আন্দোলনের প্রতি সংহতি জানিয়ে কুমিল্লা সম্পাদক পরিষদের সভাপতি নজরুল ইসলাম দুলাল বলেন, এটি কেবল সরকারবিরোধী আন্দোলন ছিল না। এটি দীর্ঘস্থায়ী বৈষম্য, অনিয়ম ও দুর্নীতির বিরুদ্ধে একটি গোটা প্রজন্মের প্রতিবাদ। আমরা ইতিহাসের মধ্যে বাস করছি। দেখিয়ে দিয়েছি, এই প্রজন্ম শুধু প্রশ্নই করে না, জবাবও দাবি করে।

সাবেক ছাত্রনেতা ও আইনজীবী এডভোকেট বদিউল আলম সুজন বলেন, শহীদরা আমাদের স্মৃতিতে থাকবেন। তাদের রক্ত বৃথা যাবে না, যদি আন্দোলনের চেতনা টিকিয়ে রাখতে পারি। কুমিল্লার রাজপথে জুলাইয়ের যে পদচারণা হয়েছে, তা ইতিহাসের অংশ হয়ে থাকবে।

প্রতিরোধের নতুন প্রতীক

জুলাই অভ্যুত্থান এখন আর শুধু আন্দোলনের নাম নয়; এটি হয়ে উঠেছে প্রতিরোধ, সংহতি ও ভবিষ্যতের প্রতিশ্রুতির প্রতীক। কুমিল্লার ছাত্রসমাজ প্রমাণ করেছে, দমন-পীড়ন, হামলা কিংবা ভয়ের মাধ্যমে তাদের থামানো যাবে না।

২৯ জুলাইয়ের বিক্ষোভ ছিল আত্মার পুনর্জন্মের ঘটনা। বিচ্ছিন্ন ছাত্ররা পুনরায় একত্রিত হয়ে নতুন উদ্দীপনায় এগিয়ে যাওয়ার বার্তা দিয়েছে। সামগ্রিকভাবে কুমিল্লায় এ দিনটি আন্দোলনের ইতিহাসে এক গৌরবোজ্জ্বল অধ্যায় হিসেবে অমর হয়ে থাকবে।