বাসস
  ২৮ জুলাই ২০২৫, ১১:৪৯

রাতভর পুলিশি ধরপাকড়ের পর বিক্ষোভে ফেটে পড়ে ঝিনাইদহ

ছবি: বাসস

\ শাহজাহান নবীন \

ঝিনাইদহ, ২৮ জুলাই ২০২৫ (বাসস) : জুলাই গণঅভ্যুত্থানের লোমহর্ষক দিনগুলো আজও ভুলতে পারেনি ঝিনাইদহের ছাত্র-জনতা। শেখ হাসিনা সরকারের পুলিশবাহিনী ও আওয়ামী লীগ, যুবলীগ ও ছাত্রলীগের সশস্ত্র গ্রুপের আগ্রাসন ছিল ভয়ংকর। মিছিলে হামলা, মেসে মেসে তল্লাশি, রাতভর শহরের পাড়া মহল্লায় ছাত্রলীগের সশস্ত্র হানা ছিল নিয়মিত। সব বাধা উপেক্ষা করে গত বছরের ২৮ জুলাই ঝিনাইদহের রাজপথ ছিল ছাত্র-জনতার দখলে।

জুলাই আন্দোলনে অংশগ্রহণকারীদের সাথে কথা বলে জানা যায়, এক বছর আগে জুলাইয়ের ২৭ তারিখ কর্মসূচি শেষ করে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতাকর্মীরা নিজ নিজ বাসায় ফেরেন। কেউ কেউ মেস ও ছাত্রাবাসে বসবাস করতেন। ২৭ জুলাই কর্মসূচি শেষ করে নেতাকর্মীরা মেসে ও বাসায় ফেরার পর সন্ধ্যা থেকেই আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও ছাত্রলীগ-যুবলীগের পেটোয়া বাহিনী পাড়ায় মহল্লায় তল্লাশি শুরু করে।

মেস মালিকদের ডেকে নিয়ে হুমকি দেয় ছাত্রলীগের তৎকালীন নেতাকর্মীরা। শিক্ষার্থীদের নেতৃত্ব শূন্য করতে চলে নেতাদের মেসে মেসে রাতভর তল্লাশি। গ্রেফতার এড়াতে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতারা জায়গা বদল করে রাত পার করেন। ওই আন্দোলনের নেপথ্য কারিগর বা স্থানীয় পৃষ্ঠপোষক পেশাজীবীরাও ছিল গ্রেফতার আতঙ্কে। সেই সঙ্গে মাথার ওপর ছিল নানা ধরনের হুমকি। তারপরও সমন্বয়করা ছাত্র-জনতার সঙ্গে বিভিন্ন কৌশলে যোগাযোগ রাখতেন। দিতেন পরের দিনের কর্মসূচি বাস্তবায়নের নির্দেশনা।

চব্বিশের ২৮ জুলাই ভিন্ন কৌশলে মাঠে নামে স্বৈরাচার বিরোধী ছাত্র-জনতা। পুলিশ ও ছাত্রলীগের বাহিনী সকাল থেকেই শহরের গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্টে নজরদারি বৃদ্ধি করে।

কিন্তু ছাত্র-জনতার কৌশলের কাছে তারা হেরে যায়। দুপুর ১২টার দিকে আকস্মিকভাবে শহরের পায়রা চত্বর, হাটের রাস্তা, শিল্পকলা একাডেমি ও পাড়া মহল্লার অলিগলি থেকে বেরিয়ে আসতে থাকে ছাত্র-জনতার ঝাঁক। একসঙ্গে বিপুলসংখ্যক ছাত্র-জনতার আকস্মিক উপস্থিতি দেখে কর্মসূচিতে বাধা দেয়ার পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করতে পারে না আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। তারপরও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও গোয়েন্দারা আন্দোলনকারী নেতাকর্মীদের কর্মসূচি সংক্ষিপ্ত করতে সময় বেঁধে দেয়।

ঝিনাইদহে জুলাই আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়ক আব্দুল্লাহ আল মামুন বলেন, পুলিশ, ছাত্রলীগ ও যুবলীগের রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে প্রায় তিন হাজার ছাত্র-জনতা ঝিনাইদহ শহরে বিক্ষোভ করে। কালো ব্যাজ ধারণ করা হয়। মিছিলে মিছিলে ফেটে পড়ে গোটা শহর। 

তিনি বলেন, গতবছর ২৮ জুলাই আমরা কর্মসূচি বাস্তবায়ন করি এক আতঙ্কের মধ্য দিয়ে। কারণ ২৮ তারিখের কর্মসূচি ঠেকাতে আগের রাত থেকেই আমাদের ওপর নানা ধরনের হুমকি ও পুলিশি হয়রানি শুরু হয়। জেলার বিভিন্ন জায়গা থেকে আমাদের বেশ কয়েকজন কর্মীকে আটক করে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। তারপরও আমরা দমে যাইনি।

জুলাই বিপ্লবে ঝিনাইদহের অন্যতম নেপথ্য নায়ক সাকিব মোহাম্মদ আল হাসান বলেন, আমরা আন্দোলনে রাজপথে অংশ নেয়া থেকে বিরত ছিলাম। এটা  ছিল আমাদের কৌশল। আমরা ছাত্র-জনতাকে নানা রকম তথ্য দিয়ে সহায়তা করতাম। পরের দিনের কর্মসূচি বাস্তবায়নের রূপরেখা তাদের জানিয়ে দিতাম। ২৮ তারিখ ছিল আমাদের কাছে এক চ্যালেঞ্জ। ঢাকা, চট্টগ্রাম, ফেনী, রাজশাহী, রংপুর ও খুলনায় তখন আমাদের ভাইদের রক্ত ঝরছিল। শহিদদের করুণ পরিণতির ভিডিও ও ছবি আমাদের বারবার সাহস জুগিয়েছে।

তিনি বলেন, ২৪ এর জুলাই ছিল এক অভূতপূর্ব মাস। ১৮ জুলাই থেকেই দেশ উত্তাল। তবে ইন্টারনেট বন্ধ হওয়া ও পরবর্তীতে ইন্টারনেট সচল হওয়ার পরে আন্দোলন নতুন রূপ পায়। আমরাও আমাদের কৌশল বারবার পরিবর্তন করতাম। কখনো কখনো বিচ্ছিন্নভাবে জেলা শহরের ভিন্ন ভিন্ন পয়েন্টে কর্মসূচি পালন করা হতো। জেলার অন্যান্য উপজেলা শহরেও একই কৌশলে আন্দোলন সচল রাখা হয়েছিল।

ঝিনাইদহ প্রেসক্লাবের সভাপতি আসিফ ইকবাল কাজল ২৪ এর ২৮ জুলাইয়ের স্মৃতিচারণ করে বলেন, 
আমাদের ভয় ছিল ছাত্র-জনতার আন্দোলনের নেতৃবৃন্দদের নিয়ে। কারণ আমাদের কাছে তথ্য ছিল, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী আন্দোলনে নেতৃত্বদানকারীদের টার্গেট করেছে। তারা ঝিনাইদহের আন্দোলন দমাতে ছাত্র নেতাদের গুম ও গুলি করে হত্যার মতো অমানবিক সিদ্ধান্ত নিয়েছিল বলেও আমরা জানতে পেরেছিলাম। এসব তথ্য আমরা ছাত্রদের জানিয়ে তাদের নিরাপদে কর্মসূচি বাস্তবায়নে সহযোগিতা করি। 

এছাড়া কর্মসূচির মিডিয়া কভারেজের জন্য তাদের একেক দিন একেক পয়েন্টে সমবেত হওয়ার পরামর্শ দিয়েছিলাম। ২৮ তারিখ ছাত্র-জনতার আন্দোলনে ঝিনাইদহ শহর সাধারণ মানুষের দখলে চলে আসে।