বাসস
  ২৭ জুলাই ২০২৫, ১১:৩০

পাড়ায় পাড়ায় প্রতিরোধ কমিটি গঠন, ছাত্র-জনতার ওপর সশস্ত্র হামলা

কুমিল্লা মহানগর আওয়ামী লীগ ও তাদের অঙ্গসংগঠনের নেতারা ‘প্রতিরোধ কমিটি’ নামে একটি তৎপর সন্ত্রাসী কমিটি দিয়ে প্রতিটি ওয়ার্ড ও ইউনিয়নে ছাত্র-জনতার ওপর সশস্ত্র হামলা করে। ছবি: বাসস

।। দেলোয়ার হোসাইন আকাইদ ।।

কুমিল্লা, ২৭ জুলাই, ২০২৫ (বাসস) : ২৭ জুলাই ২০২৪। শনিবার। জুলাই মাসের শেষ দিকে এসে কুমিল্লা শহর ও সদরে আন্দোলন দমনের নতুন কৌশল নেয় ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক শক্তি। কুমিল্লা মহানগর আওয়ামী লীগ ও তাদের অঙ্গসংগঠনের নেতারা ‘প্রতিরোধ কমিটি’ নামে একটি তৎপর সন্ত্রাসী কমিটি গঠন করে। এই কমিটি দিয়েই প্রতিটি ওয়ার্ড ও ইউনিয়নে ছাত্র-জনতার ওপর সশস্ত্র হামলা করে ।

কুমিল্লা সদর আসনের সাবেক সংসদ সদস্য ও মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতি আ ক ম বাহাউদ্দিন বাহার এবং তার কন্যা, সাবেক সিটি মেয়র ও নগর আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক তাহসিন বাহার সূচনা এ কমিটি গঠনে নেতৃত্ব দেন। তাদের নির্দেশে কুমিল্লা সিটির ২৭টি ওয়ার্ড এবং সদরের সব ইউনিয়নে প্রতিরোধ কমিটি গঠন করা হয়। এই কমিটির সদস্যরা ছিল অস্ত্রধারী ও মোটরসাইকেল আরোহী যুবক। তারা শহরের প্রতিটি পাড়া-মহল্লায় শোডাউন চালিয়ে সাধারণ মানুষ ও শিক্ষার্থীদের মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়ে দেয়।

জুলাই গণঅভ্যুত্থানের স্মৃতিচারণ করে প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, ঐদিন সকাল থেকেই আওয়ামী লীগ ও সহযোগী সংগঠনের নেতাকর্মীরা বাড়ি বাড়ি গিয়ে অভিভাবকদের সতর্ক করেন। তাদের সন্তানদের বাসা থেকে বাইরে যেতে নিষেধ করেন। আন্দোলনে নেতৃত্বদানকারী ছাত্রদের বাড়িতে হামলা ও ভাঙচুর চলে। স্থানীয়ভাবে গাড়ি থামিয়ে তল্লাশি এবং ছাত্র  মেস ও বাসাবাড়িতে ঢুকে মারধরের ঘটনাও ঘটে।

কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র সায়েম হোসেন জুলাই অভ্যুত্থানের স্মৃতি স্মরণ করে বাসসকে বলেন, ‘আমরা তখন চারজন একটি মেসে ছিলাম। হঠাৎ কয়েকজন লোক এসে দরজা ভেঙে ঢুকে আমাদের লাঠি দিয়ে পেটায়, মোবাইল কেড়ে নেয় এবং বাসা ছেড়ে দিতে বলে।’

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন কুমিল্লা জেলা শাখার আহ্বায়ক সাকিব হোসাইন বলেন, ‘প্রতিরোধ কমিটির নামে তারা প্রতিটি ছাত্রাবাস ও মেসে তল্লাশি চালায়। ছাত্রদের পিটিয়ে বের করে দেয়। অনেককে হোস্টেল থেকে বের করে দেওয়া হয়। বাধ্য হয়ে আমরা পাহাড়ে ও নির্জন স্থানে আশ্রয় নিই।’

তিনি বলেন, ‘সিটি কর্পোরেশনের সেসময়কার মেয়র তাহসিন বাহার সূচনা প্রশাসনের মাধ্যমে সব ছাত্রাবাস বন্ধ করে দেন এবং আমাদের বাসা ভাড়া  না দেয়ার জন্য বাড়িওয়ালাদের নির্দেশ দেন। এভাবে আমাদের নিঃস্ব করে দিয়ে তারা ভেবেছিল আমরা দমে যাবো। কিন্তু এর বিপরীতে আমরা আরও সংগঠিত ও কঠোর প্রতিক্রিয়া দেখাতে প্রস্তুত ছিলাম।’

এদিন বিকেলের দিকে কুমিল্লা নগরীর ছিন্নমূল ও শ্রমজীবী পরিবারগুলোতেও আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। নগরীর বিভিন্ন এলাকায় থমথমে পরিস্থিতি তৈরি হয়। 

মানবাধিকার কর্মী ও স্থানীয় সামাজিক ব্যক্তিত্ব আই আর আহম্মেদ আশিক বলেন, ‘এমন রাষ্ট্রীয় ও দলীয় সন্ত্রাস কুমিল্লার ইতিহাসে বিরল। যারা প্রতিরোধ কমিটির নামে জনগণের ঘরে ঢুকে নির্যাতন চালায়, তারা গণতন্ত্রের শত্রু।’

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে এই দিন কোনো নিহতের ঘটনা না ঘটলেও ২৭ জুলাই কুমিল্লায় আরও ১১ জনকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। এর আগের কয়েক দিনের ধারাবাহিক অভিযানে মোট গ্রেপ্তারের সংখ্যা দাঁড়ায় ১৮৩ জনে। এ আন্দোলনকে ঘিরে  মোট আটটি মামলা দায়ের করা হয়। এসব মামলায় আসামি করা হয় প্রায় ৮ হাজার নেতাকর্মী ও সাধারণ মানুষকে।

দিনে ছাত্র-জনতার ওপর আওয়ামী লীগ ও যুবলীগের নেতাকর্মীরা হামলা চালায়। আর রাতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ঘরে ঘরে গিয়ে চালিয়েছিলো গণগ্রেপ্তার। ফলে আন্দোলনকারীদের মধ্যে চরম আতঙ্ক ও ক্ষোভ দানা বাঁধে।