বাসস
  ২৬ জুলাই ২০২৫, ১৩:৪৩
আমার শহরে জুলাই অভ্যুত্থান

নগরীতে চলে গণগ্রেপ্তার, থমথমে ছিল কুমিল্লা

ছবি : সংগৃহীত

দেলোয়ার হোসাইন আকাইদ

কুমিল্লা, ২৬ জুলাই ২০২৫ (বাসস) : জুলাইয়ের প্রথম সপ্তাহ থেকে শুরু হওয়া বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন তখন গণঅভ্যুত্থানে রূপ নিয়েছে। সারাদেশের জুলাই গণঅভ্যুত্থান-এর ঢেউ প্রবলভাবে আছড়ে পড়ে কুমিল্লায়ও। 

২৬ জুলাই সকাল থেকেই নগরীর বিভিন্ন এলাকায় ছড়িয়ে পড়ে উত্তেজনা। আন্দোলনকারীদের দমনে সারাদেশে প্রশাসনের জারি করা কারফিউ আংশিকভাবে শিথিল করা হয়। সেই সুযোগে কুমিল্লা শহরের দেয়ালে দেয়ালে লেখা হয় আন্দোলনের প্রতীকচিহ্ন ও প্রতিবাদী স্লোগান।

এদিন নগরজুড়ে ছিল চরম আতঙ্ক, চাপা উত্তেজনা ও এক অজানা শঙ্কা। সাধারণ মানুষ জরুরি প্রয়োজনে ঘর থেকে বের হলেও পুলিশের চেকপোস্ট ও জিজ্ঞাসাবাদের মুখে পড়তে হয় অনেককেই।

কোটা সংস্কার ও শিক্ষাব্যবস্থায় সমতার দাবিতে শিক্ষার্থী ও সাধারণ নাগরিকদের বিক্ষোভ কুমিল্লা জেলায় তীব্র আকার ধারণ করে। পুলিশের গাড়ি ভাঙচুর, ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে অবরোধ ও শহরের কেন্দ্রস্থলে টানা কর্মসূচিতে প্রশাসন চরম চাপের মুখে পড়ে । 

২৬ জুলাই রাত থেকেই আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী নগরীতে চিরুনি অভিযান চালাতে শুরু করে। পরদিন ২৭ জুলাই ভোর পর্যন্ত চলে এ অভিযান। পুলিশ ও গোয়েন্দা সংস্থার যৌথ অভিযানে এদিন অন্তত ১৫৫ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়।

জেলা পুলিশ সূত্রে জানা যায়, কুমিল্লার বিভিন্ন থানায় এদিন মোট আটটি মামলা দায়ের করা হয়। এর মধ্যে কোতোয়ালি মডেল থানায় দুটি, সদর দক্ষিণে তিনটি, দাউদকান্দিতে দুটি এবং বুড়িচং থানায় একটি মামলা হয়। মামলা আটটির মধ্যে ছয়টিতেই বাদী পুলিশ নিজে। এসব মামলায় প্রায় আট হাজার অজ্ঞাতনামা ব্যক্তিকে আসামি করা হয়।

গণগ্রেপ্তার ও দমন-পীড়নের আশঙ্কায় কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজ, কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা ছাত্রাবাস ছেড়ে শহরের পার্শ্ববর্তী গ্রাম, আত্মীয়ের বাসা কিংবা খোলা আকাশের নিচে আশ্রয় নেয়। নগরীর বিভিন্ন মেস, হোস্টেল ও বাড়িতে চলে রাতভর তল্লাশি।

২৬ জুলাই সকাল ৯টার দিকে কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজ, কুমিল্লা সিটি কলেজ এবং কয়েকটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা পৃথক পৃথকভাবে বিক্ষোভ  করে। টাউন হলের সামনে অবস্থান নিয়ে একাধিক সাংস্কৃতিক ও মানবাধিকার সংগঠন কালো পতাকা প্রদর্শন করে ছাত্রদের ওপর হামলার প্রতিবাদ জানায় এবং ছাত্র হত্যার বিচারের দাবিতে সংহতি সমাবেশ করে।

বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ অধ্যাপক মোহাম্মদ আবু জাফর জুলাই আন্দোলনের স্মৃতিচারণ করে বাসসকে বলেন, ‘আমাদের শিক্ষার্থীরা শুধু নিজেদের অধিকার আদায়ের জন্য নয়, বরং পুরো জাতির ন্যায়বিচারের দাবিতে রাজপথে নেমেছিলো। এদিনটি কুমিল্লার ইতিহাসে গৌরবময় এক বীরত্বগাথা।’

কুমিল্লার সাংস্কৃতিক সংগঠক মনজুরুল আলম বলেন, ‘এই শহরের প্রতিটি মোড়, প্রতিটি দেয়াল আজ প্রতিবাদের ইতিহাস বহন করছে। তরুণদের এই আত্মত্যাগ জাতির জন্য এক মহামূল্যবান বার্তা।’

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের কুমিল্লা মহানগরের আহ্বায়ক আবু রায়হান বাসসকে বলেন, ‘আমরা শান্তিপূর্ণভাবে আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছিলাম। কিন্তু আওয়ামী সন্ত্রাসীরা আমাদের কর্মসূচিতে হামলা চালায় । ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে আমাদের অবরোধ কর্মসূচি ও শহরের কেন্দ্রস্থলে টানা আন্দোলনে সরকার দিশেহারা হয়ে পড়ে। ফলস্বরূপ, ২৬ জুলাই আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী চিরুনি অভিযান চালায়। প্রতিটি ছাত্রাবাসে তল্লাশি চালিয়ে গণগ্রেপ্তার করে। আমরা বহু শিক্ষার্থী রাতের পর রাত কাটিয়েছি খোলা আকাশের নিচে। এমন নিপীড়ন কেবল ফ্যাসিবাদী সরকারের পক্ষেই সম্ভব।’

জুলাইয়ের এই দিনটি কুমিল্লার মানুষ এখনো গভীর আবেগে স্মরণ করে। এই দিনটি কেবল ছাত্রদের নয়, বরং পুরো নগরবাসীর প্রতিবাদের দিন হিসেবে ইতিহাসে অমর হয়ে রয়েছে।