বাসস
  ১৫ জুলাই ২০২৫, ১৫:৫০
আপডেট : ১৫ জুলাই ২০২৫, ১৭:০৯

জাবি’র আন্দোলনের ধারা বদলে যায় মালিহার ফেসবুক লাইভে

মালিহা নামলাহ। ফাইল ছবি

\ ওসমান গণি রাসেল \

ঢাকা, ১৫ জুলাই, ২০২৫ (বাসস) : অন্যায়ের বিরুদ্ধে সারাদেশ নীরব থাকলেও সরব থাকে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়। প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকেই দেশের যে কোন অন্যায়ের ঘটনায় বরাবরই প্রতিবাদমুখর এ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা।

এর ব্যতিক্রম হয়নি কোটা সংস্কার আন্দোলনেও। অযৌক্তিক কোটা পদ্ধতির সংস্কারের দাবিতে ও পরবর্তীকালে স্বৈরাচার পতনের আন্দোলনে জীবন বাজি রেখে লড়াই করেছেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা।

এ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের প্রায় অর্ধেকই নারী। ফলে সকল আন্দোলন সংগ্রামে নারী শিক্ষার্থীরা সব সময়ই সরব। স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনেও নিজেদের সবটুকু দিয়ে লড়াই করেছেন তারা।

শিক্ষার্থীদের জোটবদ্ধ রেখে আন্দোলন পরিচালনায় যে ক’জন নারী শিক্ষার্থী সম্মুখ সারিতে অবস্থান করতেন তাদের মধ্যে সাংবাদিকতা ও গণমাধ্যম অধ্যায়ন বিভাগের ৫০ ব্যাচের ছাত্রী মালিহা নামলাহ-এর নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।

মো. মোসলেহ উদ্দিন ও রুহীনা তাসনীম দম্পতির কন্যা মালিহার বেড়ে ওঠা ঢাকার মোহাম্মদপুর এলাকায়। তিনি জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ফজিলাতুন্নেছা হলের আবাসিক শিক্ষার্থী।

মালিহা সর্বশেষ বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলন, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় শাখার মুখপাত্রের দায়িত্ব পালন করেছে।

১৫ জুলাই দিবাগত রাতে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ভবনের ভেতর কোটা সংস্কার আন্দোলনকারীদের ওপর ছাত্রলীগ নৃশংস হামলা শুরু করলে মালিহা তার ফেসবুক লাইভের মাধ্যমে বিষয়টি সরাসরি উপস্থাপন করেন। তার এ সাহসী ভূমিকার কারণে সেদিন রাতে ছাত্রলীগ নেতাকর্মীদের নৃশংস হামলা দেশবাসীকে নাড়া দিয়েছিলো। ভিডিও দেখে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের হাজার হাজার শিক্ষার্থী মধ্যরাতে ছাত্রলীগের বিরুদ্ধে মিছিল নিয়ে ছুটে এসেছিলো উপাচার্য ভবনে। পাল্টে গিয়েছিলো দৃশ্যপট। পালাতে বাধ্য হয়েছিল ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা।

সেদিন ও পরবর্তী সময়েও স্বৈরাচার পতনের আন্দোলনে সম্মুখ সারিতে অবস্থান নিয়ে আন্দোলনকে বেগবান করেছিলেন মালিহা।

সম্প্রতি বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থার (বাসস) সাথে সাক্ষাৎকারে তিনি জুলাই গণঅভ্যুত্থান চলাকালীন সময়ের স্মৃতিচারণ করে তুলে ধরেছেন তার সাহসী অভিজ্ঞতার কথা। সাক্ষাৎকারটি গ্রহণ করেছেন ওসমান গণি রাসেল।

বাসস: একজন নারী শিক্ষার্থী হিসেবে এই আন্দোলনে আপনি কীভাবে সম্পৃক্ত হয়েছিলেন?

মালিহা: বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার পর থেকে ক্যাম্পাসের যে কোন অন্যায়ের বিরুদ্ধে সংঘটিত আন্দোলনে আমি সরব থাকতাম। ব্যক্তিগতভাবে কলেজ জীবন থেকেই আমি বিভিন্ন আন্দোলনে যুক্ত ছিলাম। ২৪ এর কোটা সংস্কার আন্দোলনেও আমি শুরু থেকেই সম্পৃক্ত ছিলাম। তবে শারীরিক অসুস্থতার জন্য কিছুদিন বাড়িতে অবস্থান করেছিলাম। ১৪ জুলাই জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের ওপর ছাত্রলীগ হামলা শুরু করলে আমি পুনরায় ক্যাম্পাসে আসি। এসে আন্দোলনে যোগ দিই।

বাসস: কোটা সংস্কার আন্দোলন যে স্বৈরাচার পতনের আন্দোলনে রূপ নেবে এটা কি আপনারা জানতেন?

মালিহা: বাহ্যিক দৃষ্টিতে কোটা সংস্কার আন্দোলন হিসেবেই এর শুরু। তবে আমি জানতে পেরেছিলাম কেন্দ্রীয় সমন্বয়কদের পরিকল্পনা ছিলো এই আন্দোলনকে কাজে লাগিয়ে মানুষকে স্বৈরাচারের কবল থেকে মুক্ত করা। স্বৈরাচার পতনের আন্দোলন শুরু করা। আমি ব্যক্তিগতভাবে অনুধাবন করেছিলাম যে এই আন্দোলন সফল হলে পরবর্তী সময়ে স্বৈরাচার পতন আন্দোলন শুরু হবে।

বাসস: জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে কোটা সংস্কার আন্দোলনের সূত্রপাত কীভাবে হয়েছিলো?

মালিহা: জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে ২০১৮ সালেও কোটা সংস্কার আন্দোলন হয়েছিলো। তখন আমরা ক্যাম্পাসে ভর্তি হইনি। ২০২৪ এর ৫ জুন যখন ২০১৮ সালের কোটা বাতিলের প্রজ্ঞাপন হাইকোর্ট কর্তৃক নাকচ ঘোষণা করা হলো তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ কয়েকটি জায়গায় শিক্ষার্থীরা প্রতিবাদ শুরু করে।

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়েও ৬ জুন কেন্দ্রীয় লাইব্রেরিতে শিক্ষার্থীদের নিয়ে সিয়াম ভাইসহ কয়েকজন মিটিং করে। লাইব্রেরিতে বেশিরভাগই চাকুরীপ্রার্থী শিক্ষার্থীরা পড়াশোনা করেন। তারা সাথে সাথে আলোচনার মাধ্যমে কোটার যৌক্তিক সংস্কারের দাবিতে আন্দোলন শুরু করেন। প্রথমে কিছু সময়ের জন্য ঢাকা-আরিচা মহাসড়ক অবরোধ করে রাখা হয়। এভাবে ২০২৪ এর কোটা সংস্কার আন্দোলনের যাত্রা শুরু হয় জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে।

বাসস: ক্যাম্পাসে শুরুতে এ আন্দোলন অহিংস থাকলেও কিভাবে সহিংসতায় রূপ নিলো?

মালিহা: আমরা প্রথমে নিয়মতান্ত্রিকভাবে আন্দোলন চালিয়ে যেতে থাকি। বিক্ষোভ মিছিল, মানববন্ধন, প্রতিদিন অল্প সময় ঢাকা-আরিচা মহাসড়ক অবরোধ এবং আরো কিছু কর্মসূচি পালন করি। এতদিন কারোর সাথে কোন সহিংসতা হয়নি। তবে ১৪ জুলাই স্বৈরাচার শেখ হাসিনা আন্দোলনকারীদের রাজাকার সম্বোধন করলে শিক্ষার্থীরা সে ন্যারেটিভ ভাঙ্গতে ‘তুমি কে আমি কে, রাজাকার, রাজাকার’ স্লোগান দেয়। এরই প্রেক্ষিতে সেদিন সন্ধ্যায় জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর হলের এক আন্দোলনকারীর ওপর ছাত্রলীগ নেতাকর্মীরা হামলা চালায়। তখন থেকেই মূলত ছাত্রলীগ আগ্রাসী হয়ে ওঠে। ধীরে ধীরে আন্দোলন সহিংসতায় রূপ নেয়।

বাসস: শুরু থেকে ৫ আগস্ট পর্যন্ত ক্যাম্পাসে আন্দোলন কীভাবে ধারাবাহিক রূপ নেয়?

মালিহা: ক্যাম্পাসে আন্দোলন শুরু হয়েছিলো ৬ জুন। ২০১৮ সালের ৫ জুন কোটা বাতিলের প্রজ্ঞাপন হাইকোর্ট নাকচ ঘোষণা করলে আবারো কোটা সংস্কার আন্দোলনের সূত্রপাত ঘটে।

পরবর্তী সময়ে ঈদের ছুটি শুরু হওয়ায় ক্যাম্পাস বন্ধ হয়ে যায়। তখন আন্দোলন স্তিমিত হয়ে পড়ে। তবে ঈদের ছুটি শেষ হওয়ার পর শিক্ষার্থীরা ক্যাম্পাসে ফিরলে আন্দোলন নতুন করে শুরু হয়। কয়েকদিন আন্দোলনে অংশগ্রহণ করে আমি শারীরিকভাবে অসুস্থ হয়ে পড়ি। পরে বাড়ি চলে যাই।

এর মধ্যে আন্দোলনে কোন সহিংসতা হয়নি। নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলন ক্যাম্পাসে চলতে থাকে। ১৪ জুলাই হঠাৎ করে জাহাঙ্গীরনগরের আন্দোলন সহিংস রূপ নেয়। সেদিন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আন্দোলনকারীদের রাজাকার বলে ঘোষণা দিলে শিক্ষার্থীরা ‘আমি কে, তুমি কে, রাজাকার, রাজাকার’ বলে স্লোগান দেয়।

সেদিন সন্ধ্যায় জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে এক আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীকে ছাত্রলীগ নেতাকর্মীরা আটকে রেখে মারধর করে। তাকে ছাড়াতে অন্য আন্দোলনকারীরা বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর হলে যায়। সেখানে ছাত্রলীগ সহিংসতা প্রদর্শন করে। লাবিব ভাইসহ অনেক শিক্ষার্থী আহত হয়। সিসিটিভি ফুটেজ না দেখানোয় হলের প্রভোস্টকে পদত্যাগে বাধ্য করা হয়।

এসব দৃশ্য সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রচারিত হলে আমি আর নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারিনি। আন্দোলনে যোগ দিতে ১৫ তারিখ আমি পুনরায় ক্যাম্পাসে ফিরে আসি।

ছাত্রলীগ নেতাকর্মীরা ১৫ জুলাই সন্ধ্যায় আবারো আন্দোলনকারীদের ওপর হামলা করে। সেদিন বঙ্গবন্ধু হলের সামনে তারা সরাসরি লাঠিসোটা ও দেশীয় অস্ত্র নিয়ে মিছিল আটকিয়ে হামলা চালায়। এতে অনেক শিক্ষার্থী গুরুতর আহত হয়। এমনকি ফাইজা আপুসহ অনেক নারী শিক্ষার্থীর ওপরও তারা নৃশংস হামলা করে। জাহিদ ভাইয়ের মাথা ফেটে বীভৎস অবস্থা হয়।

সেদিন সন্ধ্যায় বিশ্ববিদ্যালয় মেডিকেল সেন্টারে গিয়ে দেখি আহত শিক্ষার্থীদের আর্তনাদ। অনেক আহতদের উন্নত চিকিৎসার জন্য সাভারের এনাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠানো হয়। ক্যাম্পাস তখন আমাদের জন্য পুরোপুরি অনিরাপদ। তাই আমরা এই হামলার বিচার ও নিরাপত্তা চেয়ে উপাচার্যের বাসভবনের সামনে অবস্থান নিই।

কিন্তু উপাচার্য ও তার প্রশাসন আমাদের কোন আশ্রয় কিংবা বিচারের আশ্বাস দিতে পারেনি। কিছুক্ষণ পর উপাচার্য বের হয়ে ১৫ মিনিটের সময় নেয়, কিন্তু এতেও কোন ফলাফল আসেনি। শুরুর দিকে সেখানে আমরা ২০০-২৫০ জন আন্দোলনকারী ছিলাম। পরে ধীরে ধীরে কমে ৭০-৮০ জন আন্দোলনকারী অবস্থান করছিলাম।

এক সময় আমরা জানতে পারি ছাত্রলীগ আবারো বহিরাগত সন্ত্রাসী ক্যাম্পাসে প্রবেশ করাচ্ছে আমাদের ওপর হামলা করার জন্য। তারা বিভিন্ন ধরনের দেশীয় অস্ত্র ও আগ্নেয়াস্ত্রসহ মহড়া দিতে থাকে। এ অবস্থায় আমরা আতংকিত হয়ে উপাচার্য ভবনের মেইন গেইট টপকিয়ে ভেতরের উঠোনে প্রবেশ করি। উপাচার্যের কাছে আশ্রয় চাই। কিন্তু তিনি তার বাসার মূল দরজা খোলেননি। আমরা দরজার সামনে অবস্থান নিই।

মধ্যরাতে ছাত্রলীগ নেতাকর্মীরা মিছিলসহ এসে বাইরে থেকে আমাদের ওপর হামলা চালাতে শুরু করে। তারা ইট ও পেট্রোল বোমা ছোড়ে অনেকক্ষণ। আমরা কোন রকম ভেতরে নিজদের একসাথে আঘাত থেকে রক্ষা করি। সেই সময়ই প্রথম আমি ফেসবুক লাইভে এসে ছাত্রলীগের এই নৃশংসতা প্রচার শুরু করি।

এর মধ্যে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের কিছু শিক্ষক আমাদের প্রস্তাব দেয় তারা নিরাপদে নারী শিক্ষার্থীদের হলে পৌঁছে দিবে। কিন্তু আমরা বুঝছিলাম এটা আমরা মেনে নিলে ভেতরে থাকা ছেলেদের তারা ছাত্রলীগের হাতে তুলে দেবে। তাই আমরা এ প্রস্তাব মেনে নেইনি। কিছুক্ষণ পর পুলিশ বাহিনী আসে। আমরা তখন নিরাপদ মনে করি নিজেদের। কিন্ত তারাও ছিলো নীরব দর্শক।

এক পর্যায়ে ছাত্রলীগ উপাচার্য ভবনের মেইনগেইট খুলে ভেতরে ঢুকে সরাসরি আমাদের ওপর হামলা শুরু করে। বলতে গেলে একরকম নারকীয় তাণ্ডব চালায় আমাদের ওপর। তারা চেয়েছিলো প্রাথমিক হামলায় আমাদেরকে ভিসির বাসার বাইরে নিয়ে যাবে, তারপর সেখানে আমাদের ওপর সরাসরি হামলা করে সবাইকে শেষ করে দেবে। অবরুদ্ধ অবস্থায় আমরা ভিসির বাসায় ছাত্রলীগের অমানবিক হামলার শিকার হই।

তখন আমি পুনরায় ফেসবুক লাইভে আসি। সাহায্য চাইতে থাকি। আমাদের বিভাগসহ বিভিন্ন গ্রুপে সাহায্য চেয়ে ম্যাসেজ দিই। সেই লাইভ মাত্র এক মিনিটের ছিল। ভিডিওটি তীব্র গতিতে ছড়িয়ে পড়ে। প্রায় ৪.৬ মিলিয়ন ভিউ হয়। ক্যাম্পাসের সবাই ভিডিওটি দেখে আমাদের সাহায্য করতে এগিয়ে আসে।

এক পর্যায়ে হামলার খবর সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বিশ্ববিদ্যালয়সহ সারাদেশে ছড়িয়ে পড়লে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা বিক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে। সেদিন মধ্যরাতে হলে অবস্থান করা হাজার হাজার সাধারণ শিক্ষার্থী ছাত্রলীগের বিরুদ্ধে রাস্তায় নামে। মিছিল সহকারে তারা ভিসি ভবনে আটকে পড়া শিক্ষার্থীদের উদ্ধার করতে যায়। সেখানে থাকা ছাত্রলীগ নেতাকর্মীরা পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়। আন্দোলনকারীদের উদ্ধার করে নিয়ে আসা হয়। মূলত সেদিনই জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে ছাত্রলীগের সলিল সমাধি রচিত হয়। সারাদেশের ক্যাম্পাসগুলোর মধ্যে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ই সর্বপ্রথম ছাত্রলীগ মুক্ত ঘোষণা করা হয়।

১৫ জুলাই রাতের ঘটনার পর আন্দোলন আরো বেগবান হয়। ১৬ জুলাই জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের আশেপাশের বিভিন্ন স্কুল, কলেজ, মাদ্রাসা, বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী এবং স্থানীয় সাধারণ মানুষও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের সাথে আন্দোলনে সম্পৃক্ত হয়।

এ অবস্থায় বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ ঘোষণা করে হল ভ্যাকেন্ট করার নির্দেশ দেয়। আন্দোলন দমাতে প্রশাসনের কারসাজি বুঝতে পেরে শিক্ষার্থীরা এ সিদ্ধান্ত অমান্য করে হলে অবস্থানের ঘোষণা দেয়। পরবর্তী সময়ে ১৭ জুলাই ক্যাম্পাসে শতশত পুলিশ প্রবেশ করানো হয়। তারা শিক্ষার্থীদের ওপর নৃশংস হামলা শুরু করে। সংঘর্ষে বহু শিক্ষার্থী গুরুতর আহত হয়। এরপরও শিক্ষার্থীরা পিছপা হয়নি।

১৮ জুলাই আমরা পুনরায় মিছিল বের করি। তবে সংখ্যায় কম হওয়ায় আমরা পুলিশের সাথে লড়াই করতে পারছিলাম না। এক পর্যায়ে ক্যাম্পাস সংলগ্ন গেরুয়া এলাকা থেকে স্থানীয় লোকজন এসে আমাদের সাথে জড়ো হলে পুলিশ পিছু হটতে শুরু করে। তারা ক্যাম্পাসের বাইরে চলে যায়। আমরা ক্যাম্পাসের সকল গেটে তালা লাগিয়ে দিই। ঐদিনই আমরা হলের তালা ভেঙে সেখানে অবস্থান করি।

এরই মধ্যে আমার এলাকায় আমাকে নিয়ে তোলপাড় শুরু হয়। প্রতিদিন বাসার আশেপাশে গোয়েন্দা সংস্থার লোকজন যেতে থাকে। আমার মা বাবা খুবই চিন্তিত হয়ে ওঠেন আমাকে নিয়ে। তারা আমাকে বাসায় চলে যেতে বলে। কিন্তু আমি আন্দোলন চালিয়ে যেতে থাকি।

সর্বশেষ ২৪ জুলাই আমি বাসায় গিয়ে মা-বাবার সাথে দেখা করি। দুদিন বাসায় অবস্থান করি। এরই মধ্যে ২৮ তারিখ আমাদের ক্যাম্পাসের প্রধান সমন্বয়ক আরিফ সোহেল ভাইকে ডিবি পুলিশ গুম করে। তিনি তিনদিন গুম ছিলেন। আমার বাসায়ও ডিবি পুলিশ আসে। তখন বাসা অনিরাপদ হওয়ায় আমার চাচাতো বোনেরা ২৮ জুলাই আমাকে অন্য একটি অজ্ঞাত জায়গায় নিয়ে যায়। সেখানে একটি ফ্ল্যাটে আমাকে রেখে আসে। একরকম অবরুদ্ধ ছিলাম আমি। এদিকে পুলিশ আমাকে খুঁজতে থাকে।

চারদিন সেখানে থাকার পর ১ আগস্ট আমাকে নিয়ে আসা হয়। ৩ তারিখ আমি আবারো আন্দোলনে যোগ দিতে শাহবাগে যাই। এদিনই শেখ হাসিনার পতনের এক দফা ঘোষণা করা হয়। ৪ আগস্ট আমি পুনরায় ক্যাম্পাসে ফিরে যাই। সেখানে আন্দোলনে সম্পৃক্ত হই। সেদিন রাতে আমরা আমাদের বিভাগের এক শিক্ষকের বাসায় অবস্থান করি।

৫ আগস্ট সেই মাহেন্দ্রক্ষণ চলে আসে। আমরা ক্যাম্পাস থেকে রওনা দিই লং মার্চ টু ঢাকা প্রোগ্রামে অংশ নিতে। শুরুতে আমরা সংখ্যায় কম ছিলাম। তবে সাভারের স্থানীয় লোকজন ও বিভিন্ন স্কুল কলেজের শিক্ষার্থীরা মিছিলে যোগ দিলে হাজার হাজার মানুষের মিছিল শুরু হয়। আমরা সাভার পৌঁছালে সেখানে পুলিশ আমাদের ওপর হামলা শুরু করে।

আমার আশেপাশে অনেকেই গুলিবিদ্ধ হয়ে ঘটনাস্থলেই শহীদ হয়। অসংখ্য মানুষ আহত হয়। সেদিন মৃত্যুকে খুব কাছ থেকে দেখেছিলাম আমি। অনেকক্ষণ হামলা ও সংঘর্ষের পর খবর আসে শেখ হাসিনা পদত্যাগ করে পালিয়ে গেছেন। কিন্তু তখনও সাভারে পুলিশের হামলা চলতে থাকে। গণভবনমুখী বিজয় মিছিলে পুলিশ গুলি চালিয়ে অনেক ছাত্র-জনতাকে শহীদ করে। এক পর্যায়ে পরিস্থিতি আমাদের নিয়ন্ত্রণে আসলে আমরা গণভবনে গিয়ে পৌঁছাই। উড়াই বিজয়ের পতাকা।

বাসস: নারী শিক্ষার্থী হিসেবে আন্দোলনে অংশগ্রহণ করতে আপনাকে কি কি প্রতিবন্ধকতার সম্মুখীন হতে হয়েছিলো?

মালিহা: জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় বরাবরই নারী শিক্ষার্থীবান্ধব ক্যাম্পাস। তাই এখানে নারী হিসেবে কোন প্রতিবন্ধকতার সম্মুখীন আমাকে হতে হয়নি।

বাসস:  ক্যাম্পাসে আন্দোলনে নারী শিক্ষার্থীদের অংশগ্রহণ কেমন হতো এবং তাদেরকে কীভাবে সংঘবদ্ধ করতেন?

মালিহা: শুরুর দিকে কোটা সংস্কার আন্দোলনে নারী শিক্ষার্থীদের অংশগ্রহণ আগের চেয়ে কম ছিলো। তবে যখনই আন্দোলন সহিংসতায় রূপ নেয়, ছাত্রলীগ আন্দোলনকারীদের ওপর হামলা শুরু করে তখন নারী শিক্ষার্থীরা দলে দলে আন্দোলনে যোগ দেয়।

আমরা সকল নারী শিক্ষার্থীকে নিয়ে প্রতি হলে হলে ম্যাসেঞ্জার ও হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপ খুলেছিলাম। সেখানে আমরা নিয়মিত তথ্য আদান-প্রদান করতাম। আন্দোলনের সময়সূচি জানাতাম। এভাবে সবাইকে সংঘবদ্ধ রেখেছিলাম।

বাসস: আন্দোলনে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের ভূমিকা কেমন ছিলো?

মালিহা: স্বৈরাচার বিরোধী শিক্ষকরা ছিলেন আমাদের আন্দোলনের অন্যতম অংশ। তারা আমাদের নানাভাবে সহায়তা করতেন। যখন হল বন্ধ করে দেয়া হয়, তখন আমরা তাদের বাসায় আশ্রয় নিয়েছিলাম। তারা আমাদের খাবার দেয়াসহ নানাভাবে আর্থিক সহযোগিতাও করতেন আন্দোলন পরিচালনার জন্যে।

এমনকি মাঠ পর্যায়েও তারা আমাদের সাথে আন্দোলন করতেন। মুখে লালা কাপড় বেঁধে তারা কর্মসূচি পালন করেছেন আমাদের পক্ষে। সর্বশেষ ৫ আগস্ট কর্মসূচিতে মিছিলের সামনের সারিতে তারা আমাদের জন্য ঢাল হয়ে দাঁড়িয়েছিলেন নিজেদের জীবনের ঝুঁকি নিয়ে। সাভারে পুলিশ গুলি শুরু করলে তারাই সবার আগে সামনে এগিয়ে গিয়েছিলেন। ১৫ জুলাই রাতে আমাদের বাঁচাতে গিয়ে অধ্যাপক লুৎফুল ইলাহি স্যার পুলিশের গুলিতে মারাত্মকভাবে আহত হয়েছিলেন।

তবে এর পুরোপুরি বিপরীতে ছিলেন আওয়ামীপন্থী বেশিরভাগ শিক্ষক। তারা দলীয় লেজুড়বৃত্তিতে লিপ্ত ছিলেন। এমনকি ১৫ জুলাই রাতে আমাদের ওপর হামলা ও ১৭ জুলাই পুলিশ এনে হামলা করানো সবই তাদের মদদেই হয়েছিলো।

বাসস: ক্যাম্পাসের ভেতরে পুলিশ প্রশাসনের ভূমিকা কেমন ছিলো?

মালিহা: পুলিশ প্রশাসন আওয়ামী লীগের রক্ষী বাহিনী হিসেবেই কাজ করেছিলো। তারা নির্বিচারে আমাদের ওপর হামলা চালিয়েছিলো। তাদের গুলিতে বহু শিক্ষার্থী গুরুতর আহত হয়েছিলো।

বাসস: বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন আপনাদের নিরাপত্তা দিতে পেরেছিলো কিনা?

মালিহা: না, তারা আমাদের নিরাপত্তা দেয়ার বদলে দলীয় কার্যক্রম বাস্তবায়নেই বেশি ব্যস্ত ছিলো। তাদের সরাসরি মদদেই আমাদের ওপর হামলা হয়েছিলো।

বাসস: ঢাকা আরিচা মহাসড়ক অবরোধ কর্মসূচি কীভাবে সফল করতেন? এতে সৃষ্ট জনভোগান্তি কীভাবে সামাল দিতেন?

মালিহা: শুরুতে আমরা প্রতিদিন ১-২ ঘন্টা ঢাকা আরিচা মহাসড়ক অবরোধ করতাম। কিন্তু পরে আরো বেশি সময় নিয়ে অবরোধ চালাতাম। এটা না করলে আন্দোলনের প্রভাব সরকারের ওপর পড়তো না। তাই কিছুটা ভোগান্তি হলেও আমাদের এই কর্মসূচি চালাতে হতো। তবে আমরা জরুরি যানবাহন চলাচলে ইমার্জেন্সি লেন চালু করতাম ও ক্যাম্পাসের ভেতর দিয়ে চলাচলের সুযোগ করে দিতাম। জনগণও স্বৈরাচারের কবল থেকে মুক্তির স্বপ্ন দেখতো, তাই তারাও সাময়িক ভোগান্তি মেনে নিতো।

বাসস: আন্দোলনে শহীদদের পরিবার ও আহতদের জন্য আপনারা কি কি পদক্ষেপ নিয়েছেন?

মালিহা: আন্দোলন পরবর্তী আমাদের সংগঠনের উদ্যোগে বিভিন্ন টিম গঠন করা হয়। প্রতিটি টিমের আলাদা আলাদা দায়িত্ব ছিলো। আমি জাহাঙ্গীরনগর মেডিকেল টিমের দায়িত্ব পেয়েছিলাম। তখন আমরা সাভারে বিভিন্ন হাসপাতালে আহতদের খোঁজ খবর নিয়ে লিস্ট করি। সে অনুযায়ী তাদের চিকিৎসায় আর্থিক সহায়তা প্রদান করতে ফান্ড চালু করি। অনেক শিক্ষক আমাদের ফান্ডে আর্থিক অনুদান প্রদান করেন।

এভাবে আমরা যতটা সম্ভব আহতদের চিকিৎসা সেবায় সহায়তা দিয়েছিলাম। পরে বড় পরিসরে সাভার মেডিকেল টিম গঠন করে আমি সেটার দায়িত্ব নিই। তখন পুরো সাভারের আহতদের চিকিৎসায় আমরা যতটা পারি সহায়তা করি।

সর্বশেষ ‘জুলাই শহীদ স্মৃতি ফাউন্ডেশন’ এর মাধ্যমে শহীদ পরিবারকে আর্থিক সম্মাননা ও আহতদের চিকিৎসায় আর্থিক সহযোগিতা প্রদান করা হয়।

বাসস: গণঅভ্যুত্থান পরবর্তী নতুন বাংলাদেশে আপনার প্রত্যাশা কি?

মালিহা: জুলাই পরবর্তী এই দেশ নিয়ে যেসব প্রত্যাশা ছিলো সেটা এখন আর নেই। এখন এটুকু চাই, আন্দোলনে যেহেতু বিএনপি, জামায়াতসহ সকল দলেরই অংশগ্রহণ ছিলো, তারা যেনো ভুলে না যায় এই স্বৈরাচার পতনের জন্য হাজারো মানুষ রক্ত দিয়েছেন। তাদের আত্মত্যাগ যেনো সকল রাজনৈতিক দল মনে রাখে। আর কেউ যেন এদেশে স্বৈরাচার হয়ে না ওঠে।