বাসস
  ১৪ জুলাই ২০২৫, ১৫:৩০

আন্দোলনকে নারীরাই সফল বিপ্লবে পরিণত করে: উমামা ফাতেমা

উমামা ফাতেমা। ছবি: সংগৃহীত

\\ মোহাম্মদ আফজাল হোসেন তানভীর \\

ঢাকা, ১৪ জুলাই, ২০২৫ (বাসস) : ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কোটা সংস্কারের দাবিতে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের ‘রাজাকারের সন্তান’ আখ্যা দিলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় অগ্নিগর্ভ হয়ে ওঠে। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা ক্ষোভে ফেটে পড়ে। 

সেদিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম মিছিল থেকে শুরু করে রাত পর্যন্ত ছাত্রলীগ নেতাদের ক্যাম্পাস ও হল থেকে তাড়িয়ে দেয়া এবং শ্বাসরুদ্ধকর কাঁদানে গ্যাস ও সরকারী বাহিনীর হুমকি ধামকিকে পাশ কাটিয়ে একদল নারী শিক্ষার্থী আন্দোলনে অনড় থাকে। তারা পিছু হটতে অস্বীকৃতি জানায়। 

কোটা সংস্কার আন্দোলন কীভাবে দেশব্যাপী সরকার বিরোধী বিক্ষোভে রূপ নিয়েছিল এবং কেন সরকার এই সাহসী শিক্ষার্থীদের এতো বেশি ভয় পেয়েছিল সেই বিষয়গুলো নিয়ে কথা বলেছেন বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়ক উমামা ফাতেমা। চব্বিশের গণঅভ্যুত্থানে যার ভূমিকা ছিল অপরিসীম।  

চট্টগ্রামে জন্ম নেয়া উমামা ফাতেমা ইস্পাহানি পাবলিক স্কুল অ্যান্ড কলেজ থেকে এইচএসসি পাশ করেন। পরে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন এবং বর্তমানে কবি সুফিয়া কামাল হলের আবাসিক ছাত্রী হিসেবে জৈব রসায়ন এবং আণবিক জীববিজ্ঞানে বিভাগে পড়াশোনা করছেন।

বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়কারী উমামা জুলাই বিপ্লবকালে নারীদের সংগঠিত করেছেন। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখার বাংলাদেশ ছাত্র ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্বও পালন করেন।

তিনি মনে করেন, বিক্ষোভে সামনের সারিতে থাকা বিদ্রোহী নারীরাই আন্দোলনকে একটি সফল বিপ্লবে পরিণত করেছিল।

সম্প্রতি বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থার সাথে এক সাক্ষাৎকারে তিনি আন্দোলনে তার অভিজ্ঞতা নিয়ে কথা বলেন। বিশেষ করে নারী শিক্ষার্থীরা কিভাবে সরকার, পুলিশ ও আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর বাধা উপেক্ষা ও প্রতিহত করেছিল সেসব বিস্তারিত তুলে ধরেন।

বাসস: আপনি কীভাবে আন্দোলনে যুক্ত হলেন? শুরু থেকে বলবেন?

উমামা: আন্দোলন শুরু হয়েছিল ৫ জুন থেকে, হাইকোর্টের একটা রায়কে কেন্দ্র করে। সেই রায়কে প্রত্যাখ্যান করে সেদিন বিকেলেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাধারণ ছাত্ররা সেন্ট্রাল লাইব্রেরির সামনে থেকে একটি প্রতিবাদী মিছিল বের করে।

আমার এই আন্দোলনে যুক্ত হওয়া মূলত ছাত্র সংগঠনের জায়গা থেকে। যেহেতু আমি বাংলাদেশ ছাত্র ফেডারেশন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সদস্য সচিব ছিলাম, তো সদস্য সচিবের জায়গা থেকে আমি দায়িত্বটা অনুভব করেছি যে আমাকে সংগঠনকে রিপ্রেজেন্ট করতে হবে। আমাদের সংগঠনের যে সদস্যগণ ছিলেন সবাইকে নিয়ে আমরা এই মুভমেন্টের সাথে সর্বাত্মকভাবে যুক্ত ছিলাম।

সময়ের সাথে সাথে আন্দোলনে ছাত্রদের সম্পৃক্ততা বাড়তে থাকে। এর ধারাবাহিকতায় ৯ জুন রাজু ভাস্কর্যে একটি প্রোগ্রাম ছিল। সেদিন মিছিলে প্রচুর  শিক্ষার্থী জমায়েত হয়েছিল।

মিছিলে নারীদের অংশগ্রহণ ছিল উল্লেখযোগ্য পরিমাণে।  সেদিন আমরা যারা ওই মিছিলে ছিলাম তারা একসাথে  হয়ে সিদ্ধান্ত নিলাম যে আমরা মেয়েদেরকে অর্গানাইজ করার চেষ্টা করব। তো পরবর্তীকালে যখন পহেলা জুলাই থেকে নতুন করে আবার আন্দোলনটা গতি পায় তখন আমরা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন হলের মেয়েদের সাথে সমন্বয় শুরু করি।

প্রাথমিকভাবে আমি এই আন্দোলনে ছাত্র সংগঠনের একজন প্রতিনিধি হিসেবে যুক্ত হলেও পরে সে পরিচয়ে আর আবদ্ধ থাকিনি। আমি তখন বিভিন্ন ফোরামের লোকজনকে একসাথে যুক্ত করে কোটা সংস্কারের দাবিতে তাদেরকে মাঠে নামানোর দায়িত্বটা পালন করেছি। যেখানে আমার পরিচয় মুখ্য ছিল না।

বাসস: প্রতিটি হলেই ছাত্রলীগের কমিটি ছিল। এই আন্দোলনের বিরুদ্ধে ছিল তারা। হলগুলোতে ছাত্রলীগের আধিপত্যও ছিল। আন্দোলন সংগঠিত করার সময় আপনি আসলে কী ধরনের বাধার সম্মুখীন হয়েছিলেন?

উমামা: যদি আমার সুফিয়া কামাল হলের কথাই বলি তাহলে পেছন দিকে তাকাতে হবে। ২০১৮ সালে যখন প্রথম কোটা সংস্কার আন্দোলনটি হয়, তখন আমাদের সুফিয়া কামাল হলের ছাত্রলীগের প্রেসিডেন্ট ছিলেন ইশরাত জাহান এশা। সে তখন হলের মেয়েদের নানান ভাবে অপদস্থ করতে থাকে যাতে মেয়েরা আন্দোলনে যুক্ত না হয়। কিন্তু পরবর্তী সময়ে মেয়েরা তাকে জুতার মালা পরিয়ে হল থেকে বের করে দেয়।

এসব ঘটনার কারণে সুফিয়া কামাল হলে ছাত্রলীগ কখনই শক্তিশালী হয়ে দাঁড়াতে পারেনি। তবে ছেলেদের হলগুলোতে ছাত্রলীগের শক্ত অবস্থান ছিল। দ্বিতীয়বারের মতো যখন এই কোটা সংস্কার আন্দোলন শুরু হয়, তখন ছাত্রলীগ ছেলেদের হলগুলোর গেট আটকে দেয় যাতে তারা আন্দোলনে অংশগ্রহণ করতে না পারে। তখন আমরা মেয়েদের হল থেকে মিছিল নিয়ে গিয়ে হলপাড়ার ছেলেদেরকে বের করে নিয়ে আসতাম। তখন আমাদের দিকে ছাত্রলীগের লোকজন পাথর, লাঠি ও জুতা ছুড়ে মারত।

বাসস: জুলাইয়ের ১৫ তারিখ থেকে আন্দোলন সহিংস হতে শুরু করে। ঐ সময়টাতে মেয়েদের প্রতিক্রিয়া কেমন ছিল?

উমামা: জুলাইয়ের ১৪ তারিখের আগ পর্যন্ত মেয়েরা আন্দোলনে স্বতঃস্ফূর্তভাবে অংশগ্রহণ করেছিল। মিছিলগুলোতে প্রায় অর্ধেকের বেশি থাকতো নারী। তারা শহরের বিভিন্ন জায়গা ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে আসতো । ব্লকেড কর্মসূচির  ক্ষেত্রেও একইভাবে মেয়েরা  অংশগ্রহণ করেছিল। মেয়েদের একটা বিরাট অংশ পুরো শাহবাগ চত্বরটা দখল করে থাকতো। আবার আমাদের সুফিয়া কামাল হলের মেয়েরা হল থেকে গুলিস্তানের জিরো পয়েন্টে গিয়ে ব্লকেড কর্মসূচি পালন করত। একই অভিজ্ঞতা আমাদের চাঁনখারপুল মোড়েও হয়েছে। যেহেতু আমি সায়েন্স ফ্যাকাল্টির স্টুডেন্ট তাই ওই সাইডে যেমন চানখারপুল মোড়ে বদরুন্নেসা কলেজ এবং শহীদুল্লাহ হলের স্টুডেন্টরা একসাথে স্বতঃস্ফূর্তভাবে ব্লকেড কর্মসূচি পালন করেছিল।

পরবর্তী সময়ে মেয়েদের অংশগ্রহণ আরো জোরালো হয়ে ওঠে। মূলত ১৪ জুলাই, বঙ্গভবনে স্মারকলিপি দিয়ে আসার পরে বিকেলবেলা ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আমাদের রাজাকারের নাতিপুতি আখ্যা দিলে মেয়েরাই সর্বপ্রথম ক্ষোভে ফেটে পড়ে এবং রাতের বেলা মিছিল নিয়ে বের হয়ে আসে।

আন্দোলনকারীদের ব্যাপারে শেখ হাসিনার এমন মন্তব্য শোনার পর আমরা খুবই হতাশ হয়েছিলাম। সত্যি বলতে ব্যক্তিগতভাবে আমি খুবই হতাশ হয়েছি। অনেক অপমানিত বোধ হচ্ছিল। কারণ আমরা খুবই যৌক্তিক একটি অধিকার নিয়ে মাঠে নেমেছিলাম। ইতোপূর্বে এই সরকারই কোটা ব্যবস্থা প্রত্যাহার করেছিল। এরপর আবার হাইকোর্টের মাধ্যমে কোটা ব্যবস্থা পুনর্বহাল করানো হলো।

এ বিষয়গুলো ছাত্ররা স্বাভাবিকভাবে নিতে পারছিল না। ফল হিসেবে রাতের বেলা মেয়েদের হলগুলো থেকে প্রতিবাদী মিছিল বের হতে শুরু করে এবং একটি পর্যায়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিটি হল থেকেই মিছিল বের হয়।  আর এই মিছিলে শেখ হাসিনার বক্তব্যের প্রতিবাদে ছাত্ররা স্লোগান দিতে থাকে ‘তুমি কে? আমি কে? রাজাকার, রাজাকার।’

রাতের বেলা তৎক্ষণাৎ মিছিলের পর পরদিন অর্থাৎ ১৫ জুলাই দুপুরে রাজু ভাস্কর্যে একটি সমাবেশ ডাকা হয়। একই সময়ে ছাত্রলীগও রাজু ভাস্কর্যে প্রোগ্রাম ডাকে। সেদিন আমাদের একটি গ্রুপ যখন হলপাড়ায় মিছিল নিয়ে যায় তখন হল থেকে ছাত্রলীগের সন্ত্রাসীরা আমাদের ওপর চড়াও হয়। এরপর যারা রাজুতে অবস্থান করছিল তারাও হল পাড়ার দিকে আসে। দুপুর একটার দিকে হলপাড়ায় ছাত্রলীগের সাথে সাধারণ ছাত্রদের ধাওয়া পালটা ধাওয়া হয়। একপর্যায়ে ক্যাম্পাসের বিভিন্ন প্রবেশপথ দিয়ে ছাত্রলীগের ভাড়াটে গুণ্ডারা ভেতরে প্রবেশ করে নারী-পুরুষ নির্বিচারে যাকে যেভাবে পারে মারতে থেকে। সেদিন মূলত মেয়েদেরকে টার্গেট করে মারা হয় আন্দোলনকারীদের মনোবল ভেঙে দেয়ার জন্য।

সেদিন অনেক মেয়েই ছাত্রলীগের হামলায় আহত হয়।  বিশেষ করে একটি ছবি ব্যাপকভাবে প্রচারিত হয়, যেখানে দেখা যায় ছাত্রলীগের কয়েকজন গুণ্ডা একজন মেয়েকে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে মারছে। তখন ছবিটি ছাত্রলীগের বর্বতার প্রতীক হিসেবে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে।  কিছু মেয়ে আন্দোলনের পর সলিমুল্লাহ মুসলিম হলেও আটকা পড়ে। পরে তাদেরকে সেখান থেকে নিরাপদে সরিয়ে আনা হয়।

সেদিন যে সকল রিক্সায় করে মেয়েদের হাসপাতালে নেয়া হচ্ছিল ছাত্রলীগ সেগুলোতেও হামলা চালায়।

বাসস: ১৬ ও ১৭ জুলাই আপনি কোন কোন ঘটনা প্রত্যক্ষ করেছেন?

উমামা: ১৫ জুলাইয়ের ঘটনার পরে আমরা মেয়েরা একটা সিদ্ধান্তে এসে পৌঁছাই যে যাই হোক না কেন আমরা হল ছেড়ে যাব না। ১৪ তারিখের পর থেকে আস্তে আস্তে ছেলেদের হলগুলো খালি হতে শুরু করে, কিছু কিছু ছেলে ব্যাগ নিয়ে চলে যাচ্ছিল। কিন্তু মেয়েদের হলে বিশেষ করে আমাদের কবি সুফিয়া কামাল হলে ১৭ তারিখ দুপুর পর্যন্ত আমরা গুণে দেখেছিলাম যে প্রায় দেড়শ’ এর মত ছাত্রী রয়ে গেছে এবং তারা সবাই হল না ছাড়ার বিষয়ে ও আন্দোলন করার জন্য দৃঢ় প্রতিজ্ঞ। অন্যান্য হলেও একই বিষয়গুলো  ঘটে।

এর ফলাফল আমরা দেখতে পাই ১৭ তারিখে সবাইকে হলছাড়া করা। তখন মেয়েরা সবার শেষে হল ছাড়ে। বেশিরভাগ মেয়েই সেদিন রাত আটটা নয়টার পরে হল থেকে  বের হয়েছিল। কারণ, মেয়েরা চিন্তাই করতে পারছিল না যে তারা হল ছেড়ে যাবে।

ব্যক্তিগতভাবে আমিও ভেবেছিলাম যে আমি হল ছাড়বো না। কিন্তু যখন আমার হাউজ টিউটরকে উপর থেকে মানে সরকার থেকে কল দিয়ে বলা হচ্ছিল যে আপনারা মেয়েদেরকে বের করে দেন। ফলে আমরা হাউজ টিউটরের চাপে পড়ে হল ত্যাগে বাধ্য হই।

বাসস:  ১৬ তারিখ রাতের কোন ঘটনা আপনি বিশেষভাবে মনে করতে পারেন?

উমামা: ১৬ তারিখ সারাদিন সাধারণ ছাত্র ও আন্দোলনকারীরা শহীদ মিনারে অবস্থান করছিল, আর ছাত্রলীগ অবস্থান করছিল রাজু ভাস্কর্যে। সেদিন পুরো দিনই ছাত্রলীগের সাথে আন্দোলনকারীদের ধাওয়া চলতে থাকে। রাতের বেলা রোকেয়া হলের ছাত্রীরা ছাত্রলীগের সভাপতি আতিকা বিনতে হোসাইনকে হল থেকে বের করে দেয়। বিষয়টি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়লে অন্যান্য হলেও সাধারণ ছাত্র ও আন্দোলনকারীরা ছাত্রলীগ নেতাদেরকে হলছাড়া করে। এক্ষেত্রে প্রথম মেয়েদের পাঁচটি হলই ছাত্রলীগ মুক্ত হয়। এরপর সকাল ১০টা নাগাদ ছেলেদের হলগুলোও ছাত্রলীগ মুক্ত হয়ে যায়। এরই মধ্যে আবু সাঈদসহ সারা দেশের বিভিন্ন জায়গায় পুলিশের হামলায় বেশ কয়েকজন আন্দোলনকারী শহীদ হন। এর প্রতিবাদে ১৭ তারিখ বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলন রাজু ভাস্কর্যে শহীদদের গায়েবানা জানাজা আয়োজনের কর্মসূচি ঘোষণা করে। ১৬ তারিখ রাত থেকেই পুরো ক্যাম্পাস আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর রক্ষাকারীদের নিয়ন্ত্রণে ছিল।  সেদিন দুপুরবেলা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী গায়েবানা জানাজায় বাধা দেয়। পরে সেই কর্মসূচি ভিসি চত্বরে পালন করা হয়। জানাজার নামাজের পর  প্রতিটি কফিন নিয়ে ছাত্ররা মিছিল বের করে। পুলিশ সেই মিছিলে লাঠিচার্জ এবং সাউন্ড গ্রেনেড ও টিয়ার গ্যাস ব্যবহার করে।

এর মধ্যে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন জরুরী মিটিং ডেকে অনির্দিষ্টকালের জন্য বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ ঘোষণা এবং সন্ধ্যা ছয়টার মধ্যেই হল ত্যাগ করার আদেশ জারি করে। পুলিশ লাঠিচার্জ করতে করতে হল পাড়ায় ঢুকে গেলে ছাত্ররা দিগ্বিদিক ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে। মূলত সেদিনই প্রথম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ছাত্রদের ওপর আক্রমণ করে।

বাসস: ইন্টারনেট বন্ধের সময় আপনি কীভাবে যোগাযোগ বজায় রেখেছিলেন?

উমামা: আমার সাথে অনেক সাংবাদিকের যোগাযোগ হতো। আমার সবসময় সব থেকে বড় চেষ্টা থাকতো যে সাংবাদিকদেরকে এই জিনিসটা বলা, আমরা আছি এবং আমরা আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছি। আমরা তখন এই কথাগুলো বারবার পত্রিকা মাধ্যমে বলেছি। তখন ইন্টারনেট বন্ধ থাকার কারণে সাধারণ মানুষ পত্রিকা পড়তো। হকারদের পত্রিকাগুলো সকাল বেলাই শেষ হয়ে যেতো। তখন তথ্য পাওয়ার একমাত্র সোর্স ছিল পত্রিকা।

আমরা জানি যে ২০ তারিখে প্রথম যখন আব্দুল কাদের নয় দফা ঘোষণা করে সেটা কিছু পত্রিকায় ছাপা হয়। তারপর আমরা ৫২ জন সমন্বয়কের নামে একটা বিবৃতি দিয়েছিলাম। কিন্তু এটা কোনো নিউজ মিডিয়াতে তখন প্রচার করতে পারিনি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সাংবাদিক সমিতির কয়েকজন ভাইও আমাদের অনেক সহযোগিতা করেছিল। এই বিবৃতি এবং কথা বলার মাধ্যমে আমরা একটা জিনিস বুঝাতে চেয়েছিলাম যে আমরা আন্দোলন চালিয়ে যাব এবং আমরা কোনোভাবেই সরকারের সাথে আলোচনার টেবিলে বসবো না।

ইন্টারনেট শাটডাউনের পুরো সময়টা এভাবেই চলেছে। কারণ সবাই যোগাযোগবিচ্ছিন্ন আর শাটডাউনের সময় নাহিদ ভাইকে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়। তখন আমাদের মাঝে একটা আতঙ্ক তৈরি হয় । অনেককে ফোনেও পাওয়া যাচ্ছিল না।

যেহেতু নিরাপত্তার বিষয়গুলো চিন্তা করে অনেক সমন্বয়ক তাদের মোবাইল নম্বর বন্ধ রাখতেন, তখন আমি আমার মোবাইল নম্বরটি খোলা রাখতাম, যাতে কেউ চাইলে আন্দোলনের বিষয়ে অন্তত আমার সাথে কথা বলতে পারে। কেন্দ্রীয় প্রোগ্রাম সম্পর্কে জানাতে পারি। একই সময় আমি আমার ব্যক্তিগত সোর্স ব্যবহার করে বিভিন্ন এলাকায় এবং উপজেলায় মানুষদেরকে  উদ্বুদ্ধ করার চেষ্টা করতাম। বিভিন্ন এলাকার ছাত্র সমন্বয়ক একটা দোকানে আমার সাথে যোগাযোগ করত।

বাসস: আন্দোলনের সময় কি আপনি আপনার পরিবারের পক্ষ থেকে কোনও চাপের সম্মুখীন হয়েছিলেন?

উমামা: ওই সময়ে আসলে পরিবার অনেক বড় একটা ফ্যাক্টর হয়ে যায়। আমি বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় থাকতে চেয়েছিলাম। কিন্তু আমার ফ্যামিলি এসে আমাকে হল থেকে ক্যান্টনমেন্টে নিয়ে যায়, সেখানে আমার ভাইয়ের বাসা ছিল। সেখানে তারা আমাকে বিভিন্নভাবে বুঝানোর চেষ্টা করে যাতে আমি এই আন্দোলনে আর অংশগ্রহণ না করি।  এর জন্য তারা আমাকে বিভিন্নভাবে ইমোশনাল ব্ল্যাকমেইল করে।

তবে আমি যেহেতু ছাত্র ফেডারেশন করেছি বা ক্যাম্পাসে দীর্ঘদিন ধরে হাসিনা বিরোধী আন্দোলন করেছিলাম তখন আমার মনে হয়েছে যে আমি তো এটাই চাই এতদিন তো আমি এটাই চেয়েছিলাম আমার তো এটাই করার কথা এবং করে যেতে হবে। আমাকে এখানে থামলে চলবে না।

তখন সবচাইতে বেশি সমস্যাটা হচ্ছিল আমি অন্য কারো সাথে খুব একটা যোগাযোগ করতে পারছিলাম না। আর একই সাথে ফ্যামিলির সাথেও ফাইট করতে হচ্ছিল। আমার মধ্যে একটা আতঙ্ক কাজ করছিল। এর মধ্যে একদিন নিভা আপু আমাকে ২০ তারিখ সকালে ফোন করে বলে যে নাহিদকে তো তুলে নিয়ে গেছে। এটা একটা অনেক বড় শক ছিল। এরপর থেকে আর কোন রাতে আমি ঠিকঠাক মতো ঘুমাতে পারিনি।

বাসস: আন্দোলনে জড়িত থাকার কারণে আপনি বা আপনার পরিবার কি কোনও ধরনের রাজনৈতিক চাপ, হুমকি বা এই জাতীয় কিছুর সম্মুখীন হয়েছিলো?

উমামা: হ্যাঁ, এটা অনেক বেশি হয়েছে। তখন আমার ফোন নম্বরটাতে তো একেবারেই ইন্টারনেট সিগন্যাল পাওয়া যাচ্ছিল না। আর আমার গ্রামে আমি কাউকে ঠিকঠাক মত ফোন দিয়েও পাচ্ছিলাম না। মেসেজ দিতে পারছিলাম না। আমার ফোন নম্বরটি গোয়েন্দা সংস্থার কাছে একেবারেই উন্মুক্ত ছিল। একদিন শেখ হাসিনার এক এমপি কল দিয়ে  আমাকে বুঝানোর চেষ্টা করেছে, যাতে আমি আন্দোলন না করি। এনএসআই থেকে, ডিবি থেকে কল দিয়ে বলে যে আপনার বাড়ি কই, আপনি কোথায় পড়েন? এসব ফোন ছিল আমার জন্য মেন্টাল প্রেশার।

এগুলোকে আমি খুব বড় একটা সমস্যা হিসেবে দেখিনি। খুব চিন্তা হতো যখন শুনেছি যে আমাদের বাড়ির আশেপাশে পুলিশের পিকআপ ভ্যানে করে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অনেকে ঘুরঘুর করছে।

আমাকে বিভিন্ন মহল থেকে কল দিয়ে আলোচনার টেবিলে বসার অফার দিতো। এই অফারকারীদের মধ্যে ছিল গোয়েন্দা সংস্থার মানুষজন ও সাংবাদিক। তারা বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন তথ্য দিয়ে আমাকে বিভ্রান্ত করার চেষ্টা করেছে। প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে আমাকে আমার পরিবারকে হুমকি দিয়েছে।

বাসস: কোটা সংস্কার আন্দোলন কীভাবে সরকার বিরোধী বিক্ষোভে রূপ নিল?

উমামা: ২৫ জুলাই যখন ইন্টারনেট ফেরত আসে তখন কিছুটা সাহস ফিরে পাই। সে সময় আমার সাথে বেশ কিছু প্রবাসী মানুষের যোগাযোগ হতো। তারা আমাদেরকে সরকার পতনের ডাকের জন্য বলত। তারা বারবার জিজ্ঞাসা করত আপনারা কেন সরকার পতনের কথা বলছেন না, তখন আমি তাদেরকে বিভিন্নভাবে বুঝানোর চেষ্টা করতাম। আসলে ওই সময়টাতে সরকার পতনের ডাক দেওয়া এতটা সহজ ছিল না। সে সময় পরিবার ও নিজের জীবন নিয়ে ভয় একদিকে সরিয়ে আন্দোলনটাকে কীভাবে ঢেলে সাজানো যায় সেদিকে মন দেই । মূলত ২৮-৩০ তারিখের পরে মুভমেন্ট আবার ঘনীভূত হয়। তখনই জনগণের ভেতর থেকেই বিষয়টি উঠে আসছিল। এটি আসলে কোন একক বিষয় নয়। মূলত জনগণের যে আকাঙ্ক্ষা সেই আকাঙ্ক্ষারই প্রতিফলন ছিল এই সরকার পতন।  আমি মনে করি সরকার পতনের এই আহ্বান ছিল একেবারেই অর্গানিক।

সে সময় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোতে সবাই বলছিল যে আর নয় দফা নয়, এখন দাবি এক দফা। এর অর্থ হল সরকার পতনের এই এক দফা মূলত জনগণেরই দাবি ছিল।

নয় দফা এক দফায় পরিণত হওয়ার প্রক্রিয়ায় আমি মনে করি প্রবাসী বাংলাদেশিদের একটা বিশাল অবদান ছিল। এত এত মানুষ খুন করার পর তখন বিষয়টি একটি বাইনারিতে গিয়ে দাঁড়ায়, হয় শেখ হাসিনা থাকবে অথবা আমরা থাকব। এইসব কারণেই মূলত এই কোটা আন্দোলন সর্বশেষ সরকার পতনের আন্দোলনে রূপ নেয়।

বাসস: ৪ ও ৫ আগস্টে আপনার অভিজ্ঞতা কি, জানাবেন?

উমামা: আগস্টের ৪ তারিখ আমার সাথে অনেক কিছু ঘটেছিল। সেদিন আমি রাস্তায় লাশ পড়ে থাকতে দেখি। এদের মধ্যে শাহরিয়ার নাফিসেরও লাশ ছিল।  হাত পা ঝুলন্ত অবস্থায় রিকশায় করে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। তার মাথা থেকে রক্ত ঝরছিল। আমার আশেপাশের এলাকা থেকে অনেকগুলি শব্দ শোনা যাচ্ছিল। আমার পাশের একজন গুলি খেয়ে মারা যায়।  এর মধ্যে আমি শুনতে পাই ছাত্র ফেডারেশনের শাকিলের মাথায় গুলি লেগেছে। আমি বারবার  আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করছিলাম। আর ভাবছিলাম ইন্টারনেট বন্ধ হয়ে গেলে কী হবে?

এরপর দিন ৫ আগস্ট সকাল থেকেই শুনতে পাচ্ছিলাম রাস্তায় কেউ নেই। পুলিশের বাধা দেওয়ার কারণে লোকজন রাস্তায় বের হতে পারছিল না।

সেদিন সকালে, আমি আমাদের ডিওএইচএসের বাড়িতে ছিলাম এবং রাস্তার পরিস্থিতি সম্পর্কে জানতে ফোন স্ক্রোল করছিলাম। দুপুরে টিভির পর্দায় শিরোনাম দেখতে পেলাম যে সেনাপ্রধান জাতির উদ্দেশ্যে ভাষণ দেবেন। তখন আমি বুঝতে পারলাম যে কিছু একটা ঘটেছে এবং রাস্তায় নেমে পড়লাম। ততক্ষণে রাস্তায় মানুষের ঢল।

আমি রাস্তা দিয়ে যাচ্ছিলাম এবং সেই মুহূর্তে আমি বুঝতে পারলাম যে মানুষ আমাকে চেনে, কারণ মানুষ আমার দিকে হাত নাড়িয়ে আমাকে ধন্যবাদ জানাচ্ছিল। এটি এমন এক মুহূর্ত যা ছিল স্বপ্নের মতো। 

বাসস: আন্দোলনের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য ঘটনা কী ছিল বলে আপনি মনে করেন?

উমামা: ২রা আগস্ট জুমার নামাজের পর একটি স্বতঃস্ফূর্ত মিছিল হয়েছিল। এই মিছিলের মাধ্যমে আন্দোলনের প্রতি মানুষের আকাঙ্ক্ষা এবং মনোভাব প্রকাশ পায়। আন্দোলন ছাত্রদের নেতৃত্বকে ছাড়িয়ে গণঅভ্যুত্থানে পরিণত হয়।

এছাড়াও দ্রোহযাত্রা ছিল একটি গুরুত্বপূর্ণ কর্মসূচি। সাংস্কৃতিক কর্মী ও অভিনেতাদের কর্মসূচিও সরকার পতনকে জোরদার ও ঘনীভূত করেছিল।

বাসস: পুরো আন্দোলনে নারীদের ভূমিকা সম্পর্কে কিছু বলুন।

উমামা: তারা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল। আন্দোলনের গতিপথ বন্ধ করার জন্য প্রথম দিন থেকেই নারীদের লক্ষ্যবস্তু করা হয়েছিল। ১৫ জুলাই, ছাত্রলীগ ইচ্ছাকৃতভাবে ঢাবি ক্যাম্পাসে বিক্ষোভকারীদের মনস্তত্ত্বকে কাজে লাগানোর জন্য নারীদের মারধর করে। রক্তাক্ত মুখের মেয়েটির ছবি দেশব্যাপী আইকনিক হয়ে ওঠে, যা আরও বেশি মানুষের অংশগ্রহণকে টেনে আনে। এরপর, আমরা দেখলাম, পুলিশকে তার সঙ্গীদের ধরে নিয়ে যেতে বাধা দেওয়ার জন্য নারী একা দাঁড়িয়ে গেছেন। এটি এমন এক চিত্র যা আমাদের নারীদের সাহসিকতার পরিচয় দেয়। আন্দোলনের সময় আমরা দেখি বোনেরা রাস্তায় ভাইয়ের কফিন বহন করছে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নারী শিক্ষকরা আন্দোলনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেন। তারা আমাদের সহযোগিতা করেছেন এবং তৎকালীন সরকারের বিভিন্ন কর্মকাণ্ডের বৈধতা নিয়ে সরাসরি প্রশ্ন তুলেছিলেন।

এই আন্দোলনে নারীরাই সবার আগে ছাত্রলীগ নেতাদের হল থেকে বের করেছিল। মেয়েরাই হলপাড়ায় মিছিল করে তাদের আটকে পড়া ভাইদের রাস্তায় নামিয়ে আনে। এখানে আমি নারীদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাচ্ছি না বা পুরুষদের সাথে তুলনা করছি না, বরং আমি কেবল বলছি আমরা কী করেছি এবং আমাদের অবদান কী ছিল। বিক্ষোভে সামনের সারিতে থাকা বিদ্রোহী নারীরাই আন্দোলনকে একটি সফল বিপ্লবে পরিণত করেছিল।

এই আন্দোলনে নারীরা পিছিয়ে ছিল না বরং সম্মুখসারিতে থেকেই লড়াই করেছিল।