শিরোনাম
তাওসিফুল ইসলাম
ঢাকা, ৪ জুলাই, ২০২৫(বাসস): চাকরিতে যৌক্তিক কোটা সংস্কার আন্দোলনে অংশগ্রহণকারী শিক্ষার্থীদের নিয়ে ১৪ জুলাই-২০২৪ তৎকালীন স্বৈরাচারী শেখ হাসিনার বক্তব্য আন্দোলনে নতুন মাত্রা যোগ করে। হাজার হাজার শিক্ষার্থী নিষিদ্ধ সন্ত্রাসী ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের বাধা উপেক্ষা করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজু ভাস্কর্যের পাদদেশে প্রতিবাদ সমাবেশে সমবেত হয়। পরের দিন শিক্ষার্থীদের প্রতিবাদ সমাবেশে দেশীয় অস্ত্র নিয়ে হামলা চালায় হাসিনার অনুগত পেটুয়াবাহিনী ছাত্রলীগ। আহত হয় শতাধিক শিক্ষার্থী। তার মধ্যে ছিলেন মহিউদ্দিন রনি। রনির পায়ে আঘাতের ফলে হাঁটতে তার অসুবিধা ছিল। তারপরেও এম্বুলেন্স করেই চষে বেড়িয়েছেন ঢাকা শহর।
বরিশাল সদর উপজেলায় বাবা মোঃ সেলিম হাওলাদার এবং মা রেনু বেগমের ঘরে জন্ম মহিউদ্দিন রনির।
রনি জুলাই অভ্যুত্থানে ছাত্রজনতাকে সংগঠিত করেছেন রাজধানীর নানান জায়গায়। আন্দোলনের গতিপথ ও স্মৃতিচারণ নিয়ে বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থার (বাসস) মুখোমুখি হয়েছেন তিনি।
বাসস: ২০২৪ সালের জুলাই গণঅভ্যুত্থানের এক বছর হতে চললো। সে আন্দোলনে আপনি সামনের সারিতে ছিলেন। জুলাইয়ের প্রতিটি মুহূর্ত স্মরণীয়, কিন্তু তার মধ্যে কোন বিশেষ ঘটনাটি আপনার সবচেয়ে বেশি স্মরণীয়?
মহিউদ্দিন রনি: ২০২৪ সালের জুলাইয়ের গণঅভ্যুত্থান আমাদের জীবনের একটা অবিচ্ছেদ্য অংশ। চাইলেও আমাদের মস্তিষ্ক থেকে এই স্মৃতি সরানো সম্ভব না। পুরো সময়টাই মনে পড়ে। ভুলে থাকতে চাইলেও পারি না, কারণ এটা আমাদের মস্তিষ্কে এত বেশি শক করে আছে, এখনো ট্রমাটাইজড হয়ে আছি। এখনো প্রতিরাতে এমন হয় যে ঘুম থেকে লাফ দিয়ে উঠছি। হঠাৎ করে এমন স্বপ্ন দেখি, যেটা জুলাইয়ের সাথে সংশ্লিষ্ট। এসব ঘটনা আসলে ভুলে থাকা সম্ভব না।
অভ্যুত্থান পরবর্তী সময়ে মানসিকভাবে অনেকটাই ট্রমাটাইজড হয়ে গিয়েছিলাম। ডাক্তার আমাকে স্ট্রেস না নিতে বলেছেন, স্মৃতিগুলো কম মনে করতে বলেছেন। তারপরও এগুলো সরিয়ে রাখা যায় না, প্রতিনিয়ত মনে পড়ে।
আমার সবচেয়ে বেশি মনে পড়ে শুরুটা। অভ্যুত্থানের প্লটটা শুরু হয় যখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ১৫ জুলাই ছাত্রলীগ (নিষিদ্ধ) আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের উপর অতর্কিত হামলা চালায়। আমাদের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের এমনভাবে রক্তাক্ত করা হলো—সেটা ভুলে যাওয়া যায় না। আমিও সেদিন আহত হই। তারা সবাইকেই ধরে ধরে মারছিল। ওই সময় আমি চোখের সামনে এসব ঘটতে দেখেছিলাম। সেদিন আমি কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে গিয়েছিলাম। মাথা কাজ করছিল না—হলোটা কী? আমি কী দেখলাম? ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নারী শিক্ষার্থীদের উপর তাদেরই পরিচিত ভাই, বন্ধু, ক্লাসমেট হামলা চালিয়েছে—যারা ছাত্রলীগ। বন্ধু হিসেবে মনে করতে ঘৃণা লাগে। কিন্তু আমাদের অনেক বন্ধু ছিল, যারা ছাত্রলীগ করতো। একসময় তাদের সাথে চলাফেরা করেছি, উঠাবসা করেছি, ক্লাসে গিয়েছি। এই মানুষগুলো যে এরকম নৃশংস হয়ে উঠবে, হায়েনার মতো আচরণ করবে—সেটা কোনোভাবেই মেনে নিতে পারিনি।
ওইদিন ভাবনা-চিন্তায় নির্ধারণ হয়ে গিয়েছিল, এটা আর কোনোভাবে সম্ভব না। এটার সর্বোচ্চ শাস্তি দরকার ছিল। হাসিনার সর্বোচ্চ শাস্তি দরকার ছিল। ওইদিনই প্লট রচনা হয়ে গিয়েছিল। আর চূড়ান্ত প্লট হয় এর পরের দিন। সেদিন প্রত্যেকটা হল থেকে ছাত্রলীগকে ধরে ধরে বের করে দেওয়া হয়। শিক্ষার্থীরা হল নিয়ন্ত্রণে নেয়। ওইদিনই অভ্যুত্থানের চূড়ান্ত রূপরেখা শিক্ষার্থীরা রচনা করে।
বাসস : আপনি ছাত্রলীগের এই হামলায় এতটা অবাক হলেন কেন? কারণ এর আগেও তো ছাত্রলীগ ২০১৮ সালের নিরাপদ সড়ক আন্দোলনে শিক্ষার্থীদের উপর হামলা করেছে। পরবর্তীতে কোটা সংস্কার আন্দোলন এবং মোদী বিরোধী আন্দোলনেও হামলা করেছে। এমনকি নারী শিক্ষার্থীদের উপরও হামলার অভিযোগ রয়েছে।
মহিউদ্দিন রনি : আমি তখন অবাক হইনি। ২০১৮ সালের কোটা সংস্কার আন্দোলনে যখন ছাত্রলীগ হামলা করেছিল, তখন সেটা আমার চোখের সামনেই দেখেছি। নিরাপদ সড়ক আন্দোলনও চোখের সামনে দেখেছি। অন্যান্য হামলাও দেখেছি, সারাদেশে খুন আর ধর্ষণের ঘটনাও দেখেছি। এসব দেখতে দেখতে একটা রেজিস্টেন্স, একটা মানসিক প্রস্তুতি তৈরি হয়ে গিয়েছিল। ভাবতাম, এটাই বুঝি সিস্টেম।
কিন্তু ২০২৪ সালের জুলাই আন্দোলনে ভিন্ন এক মাত্রা ছিল। কারণ আন্দোলনটা ছিল পুরোপুরি যৌক্তিক। শিক্ষার্থীদের সঙ্গে সরাসরি প্রহসন করে ২০১৮ সালের মীমাংসিত একটা বিষয় টেনে আনা হয়েছিল। সরকার চাইলে এই সমস্যা খুব সহজভাবে সমাধান করতে পারত, খুব সুন্দরভাবে বৈষম্য দূর করতে পারত।
২০১৮ সালেও ছাত্রলীগের হামলা দেখেছি, কিন্তু এই একটা আন্দোলনকে এত নৃশংসভাবে দমন করা হয়েছে—সেটা অভূতপূর্ব। আগেও হামলা হয়েছে, কিন্তু এত গণহারে, এত নির্মমভাবে মারতে দেখিনি। আমরা সাধারণ শিক্ষার্থী। আমাদের হাতে তো লাঠি-সোটা পর্যন্ত ছিল না। এটা কোনো একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ছাত্রদের আন্দোলন ছিল না, এটা ছিল সারাদেশের শিক্ষার্থীদের আন্দোলন।
১৫ জুলাই এক/দুইজন নয়—আমরা প্রায় সবাই কোনো না কোনোভাবে আহত হয়েছিলাম। শতাধিক শিক্ষার্থী আহত হয়েছিল। কিন্তু আমরা এতটাই নিরুপায় ছিলাম যে সেদিন প্রতিরোধ গড়ে তুলতেও পারিনি।
যখন ছাত্রলীগ দেখল যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নিজেদের ক্যাডারদের দিয়ে আর সম্ভব হচ্ছে না, তখন তারা বাইরে থেকে টোকাই, চিহ্নিত সন্ত্রাসী ভাড়া করে নিয়ে আসে।
বিভিন্ন জায়গা থেকে ভাড়া করা লোক এনে শিক্ষার্থীদের উপর হামলা চালায়। আমাদের তো তখন মনে হচ্ছিল, এরা কেউই শিক্ষার্থী নয়। পুরো ব্যাপারটা ভয়ঙ্কর ছিল।
ওইদিনই মাথায় এসেছিল—এটাই হয়তো চূড়ান্ত পতনের শুরু। এখন থেকে আর আন্দোলন থাকবে না, থাকবে গণঅভ্যুত্থান। আমরা যারা তখন মাঠে ছিলাম, সিদ্ধান্ত নিলাম—যদি এভাবে সহ্য করি, তাহলে জেলে মরতে হবে। আর যদি রুখে দাঁড়াই, তাহলে বিজয় আসবে। বৈষম্যের শিকড়টা উপড়ে ফেলা তখন জরুরি হয়ে দাঁড়ায়।
বাসস : কোটা সংস্কার আন্দোলনটা কয়েকটা ধাপে এগিয়েছে। আপনি আন্দোলনের কোন সময়টাতে সবচেয়ে বেশি সক্রিয় ছিলেন?
মহিউদ্দিন রনি : কোটা পুনর্বহাল করে হাইকোর্ট যেদিন রায় দেয়, সেদিন থেকেই আমি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সক্রিয় হই। তবে এরপর ঈদে বাড়ি চলে যাই। বাড়ি থেকে ফিরে আসার পরই আসলে আন্দোলনটা গতি পায়। জুলাইয়ের শুরু থেকেই আমি মাঠে সরাসরি সংযুক্ত হই।
বাসস : জুলাইয়ে আন্দোলন ভিন্ন মাত্রা পায়। শাহবাগে দফায় দফায় ব্লকেড দেওয়া হয়। তখন কি মানুষ আপনাদের আন্দোলনকে সমর্থন করেছিল?
মহিউদ্দিন রনি : প্রথমত, দাবিটা ছিল পুরোপুরি যৌক্তিক। সারা দেশের মানুষ দেখেছে, জাতির সাথে কীভাবে প্রহসন করা হয়েছে। ঢাকা শহরে যারা থাকে, তারা সবাই এই আন্দোলনের ব্যাপারে সচেতন ছিল। তারা জানতো, একটা ফ্যাসিস্ট সরকার জাতির সাথে প্রতিনিয়ত প্রতারণা করে যাচ্ছে। মানুষ সেই সরকারের উপর বিরক্ত ছিল।
যখন তারা দেখলো শিক্ষার্থীরা যৌক্তিক দাবিতে রাজপথে নেমেছে, তখন শিক্ষার্থীদের সঙ্গে তাদের বাবা-মাও রাজপথে নেমেছেন। জনগণ আমাদের আন্দোলনের অংশ হয়ে উঠেছিল।
পাবলিক বুঝে গিয়েছিল—সরকার বাটপারি করছে। আর এই বাটপারির বিরুদ্ধে ভয়েস রেইজ করা জরুরি।
শাহবাগে যেসব ব্লকেড হয়েছিল, সেখানে শুধু শিক্ষার্থীরা ছিল না—সাধারণ মানুষও যুক্ত হয়েছিল।
বাসস : সে সময় আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী গণহারে গ্রেপ্তার করছিল। অনেকেই তাদের গুলিতে শহীদ হয়েছেন। আপনার মনে কি ভয় ছিল? আপনার পরিবার আপনার অংশগ্রহণ কীভাবে নিয়েছিল?
মহিউদ্দিন রনি : রেলওয়ে সংস্কার আন্দোলনের সময় থেকেই আমার একটা অভিজ্ঞতা হয়ে গেছে। আমার একটা স্পষ্ট ধারণা ছিল—পুলিশ কী করতে পারে, তাদের সক্ষমতা কতটুকু। আমাদের বীর আবু সাঈদ বুক পেতে দিয়েছিল। কিন্তু আমি চাইনি, আমার অন্য কোনো ভাইবোন বুক পেতে দিয়ে মারা যাক। কারণ হাসিনার পেটুয়া বাহিনীর কোনো মায়া-মমতা নেই। তারা আসে-ই মারার জন্য।
তাই আমার মনে হয়েছিল, বুক পেতে দিয়ে লাভ নেই। আমি যদি বুক পেতে দিই, তাহলে আরও ১০ জন দেবে। দিনশেষে ১০টা মায়ের বুক খালি হবে। এই চিন্তা থেকেই আমার মনে হয়েছে—আমার বন্ধু, সিনিয়র, জুনিয়র যারা আছে, তাদেরকে নিরাপদে রাখা আমার প্রথম দায়িত্ব। যদি আমরা সবাই বেঁচে থাকতে পারি, তাহলে আন্দোলন চালিয়ে নিয়ে যাওয়া সম্ভব।
আমাদের হাতে তো কোনো অস্ত্র ছিল না—আমরা নিরস্ত্র। আমাদের শক্তি ছিল আমাদের বন্ধুরা, সহপাঠীরা, শিক্ষার্থীরা আর জনগণ। কিন্তু যদি আমরা নিজেরাই নিজেদের রিসোর্স নষ্ট করে ফেলতাম, তাহলে আমাদের লাভ হতো না—শত্রুর লাভ হতো। তাই আমরা সংগঠিতভাবে ঢাকার ভেতরে এবং বাইরে বিভিন্ন জায়গায় গেছি, যারা আন্দোলন মনিটর করছিল, তাদেরকে পরামর্শ দিয়েছি—যেন ক্ষয়ক্ষতি এড়িয়ে আন্দোলন চালিয়ে যাওয়া যায়।
সবচেয়ে ক্রুশিয়াল অংশ ছিল—১৫ তারিখ আহত হওয়ার পর আমি ঠিকভাবে হাঁটতেও পারতাম না। পায়ে প্রচণ্ড আঘাত পেয়েছিলাম। দৌঁড়াতে পারতাম না—দৌঁড় দিলে প্রচণ্ড ব্যথা হতো। এম্বুলেন্সে করে চলাফেরা করতে হচ্ছিল। সেই কারণে কিছুটা সুবিধা হয়েছিল।
১৫ জুলাই আহত হওয়ার পর প্রথম আশ্রয় নিই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মেডিকেল সেন্টারে। সেখানেও ছাত্রলীগের মূল টার্গেট ছিলাম আমি। সম্ভবত তারা ভেবেছিল, আমি এই আন্দোলনকে মোবিলাইজ করছি। তারা আমাকে খুঁজতে খুঁজতে মেডিকেল সেন্টারে চলে আসে। সেখানে স্টাফরা আমাকে আগে থেকেই চিনত। আগেও একবার মেডিকেল সংস্কার নিয়ে আন্দোলন করেছিলাম। সেজন্য তাদের সঙ্গে ভালো সম্পর্ক তৈরি হয়েছিল। মাহিন সরকারও তখন সেখানে ছিল, সেও আহত ছিল। তার খোঁজ নেওয়ার কথা মাথায় কাজ করছিল না।
ছাত্রলীগ সেখানে গিয়ে যাকে পাচ্ছিল, তাকেই মারছিল। তখন স্টাফরা আমাকে একজন ডাক্তারের রুমে নিয়ে গিয়ে টেবিলের নিচে লুকিয়ে রাখে। ভেতরে রেখে বাইরে থেকে তালা দিয়ে দেয়। এরপর আমাকে বের করে একটি এম্বুলেন্সে তোলে। কিন্তু তখনকার পরিস্থিতিতে এম্বুলেন্সও চেক করা হচ্ছিল। তখন আমাকে এম্বুলেন্সের ফ্লোরে শুইয়ে রাখা হয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের নারী শিক্ষার্থীরা আমাকে আগলে রাখে, তাদের ব্যাগ আমার উপর দিয়ে ঢেকে দেয় যেন বোঝা না যায় আমি সেখানে আছি।
সেখান থেকে আমাকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে শিফট করা হয়। সেখানে ছাত্রলীগের কিছু আহত সদস্যও ছিল, যারা ট্রিটমেন্ট নিচ্ছিল। আমি তাদের চিনতাম না—ভাবছিলাম, হয়তো আমাদের কারো সাথেই এসেছে। পরে তাদের কথাবার্তা শুনে বুঝি—তারা আমাকে চিনে ফেলেছে। নিজেদের মধ্যে বলাবলি করছিল, ‘এটা তো রনি।’ তখন তারা ফোনে আরও লোক ডেকে আনছিল আমাকে মারার জন্য।
মেডিকেলের কিছু স্টাফ আমাকে চিনত, আগের আন্দোলনের সূত্রে। ছাত্রলীগ তখন বিভিন্নভাবে হাসপাতালে ঢোকার চেষ্টা করছিল আমাকে মারার জন্য। তখন আউটসোর্সিংয়ের কিছু কর্মচারী আমাকে একটি বড় কার্টনে ঢুকিয়ে তাদের সিক্রেট গুদামে নিয়ে যায়। তারা আমাকে বলে, ‘ভাই, নড়াচড়া কইরেন না। ওরা খুঁজতেছে। আপনাকে পেলে মেরে ফেলবে।’
একপর্যায়ে শুনলাম, ছাত্রলীগ হাসপাতালে ঢুকে আহত শিক্ষার্থীদেরও মারছে। তখন আমরা ফোনে ফোনে যোগাযোগ রাখছিলাম—বন্ধুদের সঙ্গে যোগাযোগ করার চেষ্টা করছিলাম। রাতের দিকে যখন ছাত্রলীগ কিছুটা থেমে যায়, তখন বিশ্ববিদ্যালয়ের ছোট ভাইদের জানাই আমি কোথায় আছি। তারা আসে, কিন্তু প্রথমে আমাকে খুঁজে পাচ্ছিল না। পরে সুজন এসে আমাকে পেছনের রাস্তা দিয়ে বের করে। আমি সিএনজি করে চলে যাই আকিবদের বাসায়।
আকিবের বাবা-মা অ্যাডভোকেট, আমার মনে হয়েছিল—যদি পুলিশ বা গোয়েন্দা বাহিনী খুঁজতেও আসে, অন্তত উনারা লিগ্যালি ডিল করতে পারবেন। তখন আমি হাঁটতেও পারছিলাম না। সেখানেই থেকে প্রাথমিক চিকিৎসা নিই। পরদিন থেকেই আবার আন্দোলনে অংশ নিই।
বাসস : দীর্ঘ সময় কারফিউ জারি করেছিল সরকার। ইন্টারনেট ছিল ব্ল্যাকআউট। আন্দোলনের প্রথম সারির অনেক সমন্বয়কারীকে গুম করা হয়েছিল। আপনি সে সময় কোথায় ছিলেন? আন্দোলনের সাথে কীভাবে সম্পৃক্ত ছিলেন?
মহিউদ্দিন রনি : আমরা শুরু থেকেই সচেতন ছিলাম। সবাইকে বলছিলাম—সংস্থার ফাঁদে পা দেওয়া যাবে না। ধরুন, যদি নাহিদ ভাইকে সত্যিই খুন করে ফেলত, আমরা তাকে কোথায় পেতাম? তাই সবাইকে বলছিলাম—কোনোভাবেই ধরা দেওয়া যাবে না। দুর্ভাগ্যক্রমে, শেষ পর্যন্ত তাদের কয়েকজনকে ধরেই ফেলেছে।
আমি নিজে তখন পায়ে হাঁটতে পারতাম না, তবু অ্যাম্বুলেন্স ভাড়া করে চলাফেরা করতাম। এম্বুলেন্সে করে বিভিন্ন জায়গায় যেতাম। অন্য সব গাড়ি চেক করলেও, এম্বুলেন্স সাধারণত চেক করত না। দেখে ছেড়ে দিত। ক্যাম্পাসের ছোট ভাইদের বাসায় গিয়ে একেক দিন থাকতাম। অনেক সময় হাসপাতালেই থাকতাম—হাসপাতালের পার্কিংয়ে এম্বুলেন্স দাঁড় করিয়ে, সেখানেই রাত কাটত।
বাসস : আপনি পুরোটা সময় ঢাকায় ছিলেন?
মহিউদ্দিন রনি : না, শুধু ঢাকায় থাকিনি। আমি মাদারীপুরেও গিয়েছিলাম। আশপাশের কয়েকটি জেলাতেও গিয়েছি—সবই এম্বুলেন্সে করে। কারণ নাহিদ ভাইয়েরা তো ভেতরে—তাদের অনুপস্থিতিতে আমাদের আন্দোলনটা চালিয়ে নিতে হতো, যেভাবেই হোক।
রিফাত রশিদরা তখন বাইরে ছিল। তারা আন্দোলনের নীতিনির্ধারণ করত এবং বিভিন্ন গ্রুপে তা জানিয়ে দিত। আমরা সেগুলো সার্কুলেট করতাম, যতদূর সম্ভব নানা মাধ্যমে পাঠানোর চেষ্টা করতাম, যেন সেগুলো সাধারণ মানুষের কাছে পৌঁছায়।
ইন্টারনেট ব্ল্যাকআউট চলাকালীন সময়ে আমরা প্রবাসীদের সাথেও কানেক্ট থাকার চেষ্টা করতাম। প্রবাসীরা আমাদের বার্তাগুলো নানা জায়গায় ছড়িয়ে দিত।
তারা ফেসবুকে সক্রিয় ছিল। পিনাকী ভট্টাচার্য, ইলিয়াস ভাই, কনক ভাই—তারা চমৎকার একটা অ্যাক্টিভিজম চালিয়ে গেছেন। প্রবাসীদের তারা সংযুক্ত করেছেন, সংগঠিত করেছেন।
আমরা তাদের বলতাম—যদি সম্ভব হয়, নিজেদের এলাকায়, নিজেদের বাড়িতে সবাইকে জানাতে, স্থানীয় মসজিদের মাইকে ঘোষণা দিতে যেন কোথায় কী ঘটছে, তা মানুষ জানে। তারা সেটা সত্যিই করেছে।
বাসস : আপনি বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের কমিটিতে ছিলেন না। এর কোনো বিশেষ কারণ আছে?
মহিউদ্দিন রনি : আমার কাছে মনে হয়েছে, আমি যদি কমিটিতে না থেকেও তাদের পাশে থাকি, সেটা হয়তো আরও বেশি শক্তি জোগাবে। কমিটির বাইরেও একটা অবস্থান থাকে—যেটা অনেক সময় আরও কার্যকর হয়।
বাসস : ৫ আগস্টের পরেও আপনি কোনো রাজনৈতিক দলের সঙ্গে যুক্ত হননি।
মহিউদ্দিন রনি : আমি বহুদিন ধরেই বিভিন্ন স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের সঙ্গে কাজ করছি। মোটামুটি বুঝি—নেতা কীভাবে তৈরি হয়। আমরা যদি কেউ পদ না ছাড়ি, একে অপরকে এগিয়ে না দিই, তাহলে সব কিছু এককেন্দ্রিক হয়ে যায়—সব জায়গায় শুধু ‘আমি’।
তাই আমার সবসময় চেষ্টা ছিল, যেন আমার কেন্দ্রিক কিছু না হয়। মানুষ যেন বুঝতে পারে—আমি গণমানুষের সাথে আছি, এমন মনে না হয় যে নিজেকে নেতা বানাতে চাচ্ছি।
আমার কখনোই ইচ্ছা ছিল না কাউকে ঘিরে ‘কাল্ট ফিগার’ বানানোর, কারণ আমরা সবসময় দেখেছি—বঙ্গবন্ধু, শহীদ জিয়া—তাদেরকে রাজনৈতিকভাবে কাল্ট ফিগার বানানো হয়েছে।
আজকাল কেউ এক্টিভিজমে যুক্ত হলে ধীরে ধীরে ক্ষমতার স্বাদ নিতে চায়।
এই জন্যই আমি কখনো রাজনীতিতে যুক্ত হওয়ার কথা ভাবিনি। আমি ক্ষমতায় যাব—এই চিন্তা কখনোই করিনি। আমি কোনো পদে না থাকলে সেই পদে নতুন কেউ আসবে, নতুন একজন নেতা তৈরি হবে। আমি চাইনি, আমার উপস্থিতি অন্য কারও বিকাশে বাধা হয়ে দাঁড়াক।
বাসস : আন্দোলন চলাকালীন একটি ভিডিও ভাইরাল হয়েছিল—সেখানে আপনাকে স্লোগান দিতে দেখা যায়। একপর্যায়ে পুলিশ আপনাকে ধরতে এলে আইনজীবী মানজুর আল মাতিন আপনার সামনে চলে আসেন। এটি কোন দিনের, কোথায় ঘটেছিল?
মহিউদ্দিন রনি : আন্দোলনের সময়, পুলিশের পাশাপাশি আর্মির অনেকের সঙ্গেও পরিচয় হয়েছিল। তারা আমাকে মাঝে মাঝে তথ্য দিত—কী হচ্ছে, না হচ্ছে, কিংবা কোনো বিপদের সতর্কবার্তা।
তখন পুলিশের একটা নির্দেশ ছিল—যেকোনো মূল্যে আমাকে গ্রেপ্তার করতে হবে। এরকম একটা সরাসরি ওয়ার্নিং ছিল। মুক্তিযুদ্ধ মঞ্চ তখন একটি মামলা করেছিল, যেখানে আমি ছিলাম এক নম্বর আসামি। এই মামলা ঘিরেই পুলিশ আমাকে খুঁজে বেড়াচ্ছিল। পেলেই নিয়ে যাবে—এমন অবস্থা। তাদের হাতে পড়লে হয়তো মেরে ফেলত না, কিন্তু পঙ্গু করে দিত। আমাকে ধরে ফেললে, অন্যদেরও ধরত—একসময় পুরো আন্দোলন স্তিমিত হয়ে যেত। তাই আমার মাথায় সবসময় কাজ করত, কাউকে না কাউকে আন্দোলনটা চালিয়ে যেতেই হবে। জনগণকে জানাতে হবে—আমরা এরপর কী করছি। আমার বাবা-মাকেও সরিয়ে ফেলেছিলাম। ভিন্ন ভিন্ন জায়গায় রেখেছি। এক জায়গায় এক-দুই দিনের বেশি থাকতে দিইনি—যেন তাদেরও না পাওয়া যায়। হতে পারে তাদেরকে গুম করে ব্লাকমেইল করতো।
আর আপনি যেটা বলছেন সে ঘটনাটা ঘটেছিল ৩১ জুলাই, ‘মার্চ ফর জাস্টিস’-এর দিন। আমরা হাইকোর্টের সামনে স্লোগান দিচ্ছিলাম। পুলিশের ব্যারিকেড যেভাবেই হোক ভাঙব—এই ছিল সংকল্প। সে সময় শাহবাগ থানার ওসি আরশাদ আসে। তিনি হুমকি দিয়ে বলেন, যেভাবেই হোক আমাকে ধরে নিয়ে যাবে।
পুলিশ টিয়ারশেল, রাবার বুলেট ছুঁড়ে পুরো এলাকা ফাঁকা করে ফেলে। আমিসহ দুয়েকজন ছেলে ছিলাম, বাকি সবাই মেয়ে। আমাদের ছোট বোনরা আটকে পড়েছিল। আমি যদি ওদের রেখে ওই জায়গা ত্যাগ করতাম, তাহলে সবার কাছে ছোট হয়ে যেতাম। ভাবছিলাম, মরলেও ওদের রেখে যাওয়া যাবে না। এর মধ্যে আশপাশ থেকে আরও অনেকে জড়ো হতে শুরু করে। আমরা আবার স্লোগান দিতে শুরু করি। হঠাৎ পুলিশ এগিয়ে আসে আমাকে ধরতে। তখনই মানজুর আল মতিন ভাই চলে আসেন। তিনি জানতে চান—আমাকে কেন ধরে নিয়ে যেতে চায়। আসলে, যতবার পুলিশ ধরতে এসেছে, আইনজীবীরাই আমাদের বাঁচিয়েছে।
একপর্যায়ে, ওসি আরশাদ আমাকে ধরতে গিয়ে এক মেয়ের গায়ে হাত দিয়ে ফেলে। তখন আমি পাল্টা আক্রমণ করি, তাদের ঠেলতে থাকি। পুলিশ ভড়কে যায়। তাদের সাহস ভেঙে পড়ে। এমনকি তাদের মধ্যেও অনেকে শিক্ষার্থীদের মারতে চাইছিল না। চাকরির চাপে বাধ্য ছিল, কিন্তু মন থেকে চায়নি। তারা নিজেরাই নিজেদের মধ্যে বলছিল—‘তাদের সঙ্গে লাগতে যাইয়েন না।’ ওসি আরশাদ নিজেও ভয় পেয়ে গিয়েছিল। পরবর্তীতে আরও আইনজীবী আমাদের পাশে এসে দাঁড়ায়। আমাদের শক্তি তখন অনেক বেড়ে যায়।
বাসস : জুলাইয়ে সময় শত শত মানুষ শহীদ হয়েছেন। বৈষম্যহীন, নিরপেক্ষ একটি রাষ্ট্র গঠনের জন্য মানুষের যে আকাঙ্ক্ষা ওই জুলাইয়ের মধ্য দিয়ে প্রকাশ পেয়েছে, সেই অর্জন স্থায়ী হবে কি না?
মহিউদ্দিন রনি : সাধারণত আমরা সবাই জুলাই গণঅভ্যুত্থান বলি। তবে আমি সবসময় বলতাম—জুলাই হলো একটা বিপ্লব। বিপ্লব এক ধরণের প্রক্রিয়া, যার একটি অংশ হলো গণঅভ্যুত্থান। এখন যেটা ঘটেছে সেটা অভ্যুত্থান—গণঅভ্যুত্থান হয়েছে, বিপ্লবটা এখনও মানুষের মনে টিকেছে। যারা অংশগ্রহণ করেছে, তাদের মধ্যেই সেই বিপ্লবের বীজ লুকিয়ে আছে।
এখন অন্তর্বর্তী সরকার গঠন হয়েছে জন আকাঙ্ক্ষার মাধ্যমে। আমাদের তিনজন ছাত্র প্রতিনিধিও সেখানে ছিল। সরকারের প্রতি প্রত্যাশা ছিল, কিন্তু অনেক ক্ষেত্রে সেটা পূরণ হয়নি। আমাদের হয়তো এক বিপ্লবী সরকার গঠন করা প্রয়োজন ছিল। তবুও যা হয়েছে, সেটাকে আমরা মেনে নিয়েছি।
ড. মুহাম্মদ ইউনূস সাহেব আসার পরে আমাদের মাঝে একটা ভরসার জায়গা তৈরি হয়েছে। কারণ একটা দেশের অনেক অর্গান থাকে, সেগুলো চালাতে হাজার হাজার মানুষ লাগে।
অল্প মানুষ দিয়ে সে কাজ করতে গিয়ে সরকার হিমশিম খাচ্ছে—এটা স্বাভাবিক। আমি এখনও আশাবাদী তারা পারবে। সময় এখনো আছে। জনগণকে সঙ্গে নিয়ে দারুণ কিছু করা সম্ভব। আমাদের মনে রাখতে হবে, শেখ হাসিনা চলে গেলেও তার সন্তানরা এখনও রয়ে গেছে।
সে যে সিস্টেম তৈরি করেছে, সেটা নিয়ে যায়নি—তার বানানো বাহিনী, সচিবালয়, বিচার বিভাগ, প্রশাসনিক ইউনিট সব এখনো রয়েছে।
এই অভ্যুত্থান বিপ্লবে পরিণত হবে, দেশ বদলাবে তখন, যখন আমরা যারা জুলাইকে ধারণ করি, পড়াশোনা করব, লাইব্রেরির দিকে মুখ ফেরাবো। আমাদের শপথ নিতে হবে—আগামী চার-পাঁচ বছর নিজেদের এমনভাবে গড়ে তুলব, যাতে গিয়ে সেই সিস্টেমের মধ্যেই গিয়ে আমরা সিস্টেমটাই পরিবর্তন করতে পারি। তখন হয়তো দশ বছর পরে গিয়ে জুলাইয়ের বীজ আস্তে আস্তে চারায় পরিণত হবে। সেই সুফল আমরা পাবো। এটা একটা ইন্সট্যান্ট চেঞ্জ নয়। রাতারাতি কিছু হবে না। এটা সিনেমা নয়। ইনটারিম গভর্নমেন্টের দিকে তাকিয়ে থাকলে হবে না। আমরা ১৮ কোটি মানুষের যদি প্রতিদিন দুটো করে সমস্যা থাকে, তাহলে ৩৬ কোটি সমস্যা ইউনুস একাই সমাধান করতে পারবেন? না। আমাদের নিজেদেরই আমাদের সমস্যা সমাধান করতে হবে। আমাদের দেশকে ধারণ করতে হবে।
এখন অন্তর্বর্তী সরকারের এখন একটাই কাজ হলো—মানুষের মধ্যে এই অনুভূতিটা তৈরি করা যে, আমরা সবাই মিলে বাংলাদেশ। আর আমরা নিজেদের পরিবর্তন না করলে জুলাই হারিয়ে যাবে আমাদের কথায়, অবহেলায়, ঠাট্টায়। কিন্তু আমরা জুলাইকে হারাতে চাই না। আমরা জুলাইকে হারাতে দেবো না, ইনশাআল্লাহ।