শিরোনাম
দিদারুল আলম ও মোশতাক আহমদ
ঢাকা, ১৭ মে, ২০২৫ (বাসস) : অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের খাদ্য উপদেষ্টা আলী ইমাম মজুমদার বলেছেন, সারাদেশে নিম্ন-আয়ের মানুষকে স্বল্প মূল্যে খাদ্যবান্ধব কর্মসূচির আওতায় আরো ৫ লাখ পরিবার বাড়িয়ে ৫৫ লাখ পরিবারকে সহায়তা দেয়া হবে। বছরে ৫ মাস থেকে বাড়িয়ে এ সহায়তা ৬ মাস দেয়ার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। আজ বাসসের সাথে আলাপকালে তিনি এ তথ্য জানান।
উপদেষ্টার সঙ্গে কথা বলেন বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থার প্রধান প্রতিবেদক দিদারুল আলম ও সচিবালয় প্রতিবেদক মোশতাক আহমদ।
এক প্রশ্নের উত্তরে খাদ্য মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা বলেন, টিসিবি স্থানীয় বাজার থেকে কিনে ভর্তুকি দিয়ে কম মূল্যে পণ্য সরবরাহ করে। আর মন্ত্রণালয় খোলা বাজারে খাদ্যশস্য বিক্রয় (ওএমএস) এর আওতায় সরকার কম মূল্যে চাল বিতরণে বড় ধরনের ভর্তুকি দিয়ে থাকে। এটি আমাদের সরবরাহের সব থেকে বড় আউটলেট।
খাদ্যবান্ধব কর্মসূচির আওতায় চলতি অর্থবছরে (২০২৪-২৫) ৫০ লাখ পরিবার বছরে পাঁচ মাস ৩০ কেজি করে চাল পেত, আগামী বছরের বাজেটের জন্যও খাদ্য নিরাপত্তা কর্মসূচির আওতায় এটি নির্দিষ্ট করা হয়ে গেছে। ২০২৫-২৬ অর্থবছরে পরিবারের সংখ্যা ৫০ লাখ থেকে ৫৫ লাখে বাড়ানো হবে এবং পাঁচ মাসের স্থলে ছয় মাসে উন্নীত করা হচ্ছে।
বর্তমানে খাদ্য মজুদের অবস্থা কেমন এমন প্রশ্নে উপদেষ্টা আলী ইমাম মজুমদার বলেন, ‘প্রতিদিন আমাদের মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইটে খাদ্য মজুদের তথ্য দেওয়া হচ্ছে। মজুদ সন্তোষজনক পর্যায়ে রয়েছে। আজ সকাল পর্যন্ত চাল ও গমের মজুদ ছিল ১৪ লাখ ৬৫ হাজার ৩৫৫ টন। এরমধ্যে চাল ১১ লাখ ৪৪ হাজার ৬৫৫ মেট্রিক টন এবং গম তিন লাখ ৫ হাজার ৮৮০ মেট্রিক টন। তিনি বলেন, আরো একটি গমের জাহাজ আসছে। গম কেনার জন্য টেন্ডারও দেওয়া হবে। কিছু চাল হয়তো আমদানি করতে হবে তবে এখনই নয়, আমরা চাল পরে আমদানি করব।’
খাদ্য উপদেষ্টা বলেন, ‘চলতি মৌসমে বোরো ধানের খুব ভালো ফলন হয়েছে। আমাদের লক্ষ্য আছে ১৪ লাখ মেট্রিক টন চাল আভ্যন্তরীণ উৎস থেকে সংগ্রহ করা এবং এটি সংগ্রহ করতে পারলে এখনই আমাদের বাইরে থেকে চাল আমদানি করতে হবে না। গতবার আমন ধানের ফলন ভালো না হওয়ায় আমাদের বাইরে থেকে চাল আনতে হয়েছিল।’ এবার আমন চালের ফলন ভালো তাই বাইরে থেকে চাল কেনার পরিমাণ কম হবে বলে আশা প্রকাশ করেন উপদেষ্টা।
উপদেষ্টা বলেন, ‘গমের ব্যাপারটা হলো বর্তমানে বাঙালি মধ্যবিত্ত পরিবারের অনেকেই বিষয়টা অনুধাবন করতে পারেন না যে চালের পাশাপাশি গম আমাদের প্রধান খাদ্যের জায়গায় চলে গেছে। আমাদের দেশে গমের চাহিদা বছরে ৭০ লাখ টন। স্থানীয়ভাবে উৎপাদিত হয় ১০ লাখ টন, ৬০ লাখ টনই বিদেশ থেকে আনা হয়। এ আমদানির অধিকাংশই প্রাইভেট সেক্টর দ্বারা কাভার করা হচ্ছে। এরমধ্যে প্রায় ৭ লাখ মেট্রিক টনের মত ওএমএস- এর কারণে সরকার আমদানি করে থাকে।’
প্রাকৃতিক দুর্যোগের ফলে খাদ্যে ঘাটতি হওয়ার কোন সম্ভাবনা রয়েছে কি-না এমন প্রশ্নে উপদেষ্টা বলেন, ‘প্রকৃতির উপরে পৃথিবীর সবচেয়ে সমৃদ্ধতম দেশেরও কোন হাত নেই। সে সব দেশেও খরায় অথবা অন্য কারণে ফসল নষ্ট হয়ে থাকে।’
খাদ্য উপদেষ্টা বলেন, ‘প্রয়োজন অনুযায়ী বাজারে খাদ্য সরবরাহ করা খাদ্য মন্ত্রণালয়ের কাজ। বাজারকে স্থিতিশীল রাখা আমাদের প্রধান কাজ। এর পাশাপাশি সশস্ত্র বাহিনী, পুলিশ, কারারক্ষী বা যারা রেশন পেয়ে থাকেন তাদের একই গোডাউন থেকে রেশন সরবরাহ করা হয়। ওএমএসের মাধ্যমে গমের বিতরণ চালু রয়েছে কিন্তু আমাদের দেশে যে পরিমাণ উৎপাদন হয় তা সরবরাহ করার জন্য পর্যাপ্ত নয়। ওএমএসের মাধ্যমে গমের সরবরাহ চলমান রেখে দাম স্থিতিশীল রাখা আমাদের লক্ষ্য।’
চাল আমদানি প্রশ্নে উপদেষ্টা বলেন, ‘এখন পর্যন্ত চাল আমদানির বড় একটি উৎস হচ্ছে প্রতিবেশী দেশ ভারত। সিদ্ধ চাল মূলত ভারত ছাড়া প্রতিবেশী অন্য কোনো দেশ আমাদের দিতে পারে না। মিয়ানমার কিংবা ভিয়েতনামে সিদ্ধ চাল হয় না। মিয়ানমার, ভিয়েতনাম এবং পাকিস্তান থেকে আমরা মূলত আতপ চাল এনে থাকি। চাল আমদানির জন্য সোর্স বৃদ্ধি করার চেষ্টা চালানো হচ্ছে এবং অনেকেই আমাদের চাল আমদানি করার জন্য অফার দিচ্ছে।’
তিনি বলেন, ‘রাশিয়া থেকে গভর্মেন্ট টু গভর্মেন্ট ব্যবস্থায় আমরা কিছু গম এনে থাকি এবং ইসরাইল ব্যতীত আন্তর্জাতিক টেন্ডারেও বিশ্বের যেকোন দেশ থেকে কিছু আনা হয়।’
এক প্রশ্নে খাদ্য উপদেষ্টা বলেন, ‘নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ আমাদের আরেকটি উইং। যদিও এখনো এর কার্যক্রম উল্লেখ করার মতো নয়। ক্রমান্বয়ে এর শক্তি বৃদ্ধি করার জন্য আমাদের পরিকল্পনা রয়েছে। রেষ্টুরেন্টের লাইসেন্স দিয়ে থাকেন ডিসিরা অথবা ক্ষেত্রবিশেষে সিভিল এভিয়েশন মন্ত্রণালয় বা বিএসটিআই। এই প্রক্রিয়াকে খাদ্য মন্ত্রণালয় বা নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষের আওতায় আনার কাজ চলছে এবং এক্ষেত্রে কিছুটা সময় লাগবে।’
উপদেষ্টা বলেন, ‘নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষের জন্য কাজ করতেন স্যানেটারি ইন্সপেক্টররা। প্রত্যেকটা মিউনিসিপ্যাল এরিয়াতে একজন করে ছিলেন। তারা সিভিল সার্জন অথবা প্রশাসনের নিয়ন্ত্রণে থাকলেও মিউনিসিপ্যালিটির অধীনে ছিলেন। এখন সিটি কর্পোরেশন হয়ে যাওয়াতে কিছু কিছু তাদের অধীনে গিয়েছে। নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষের একজন করে কর্মকর্তা প্রত্যেকটি জেলায় দেওয়া হয়েছে , তারা ডিসিদের সাথে এ কাজে অংশ নেন। তাদের জন্য একটি করে ছোট ল্যাবরেটরির ব্যবস্থা করা হয়েছে।’
নিরাপদ খাদ্য আইন বিষয়ে এক প্রশ্নে খাদ্য উপদেষ্টা বলেন, ‘নিরাপদ খাদ্য আইনে যে সকল বিধান রয়েছে সেগুলো গ্রাম অঞ্চলে অনেক সময় বাস্তবায়ন করা যায় না। যেমন গ্রামের একজন ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী যিনি দিন শেষে ১৫০ থেকে ২০০ টাকা লাভ করেন তাকে ১০০০ টাকা জরিমানা করা যায় না। দেশের আর্থ-সামাজিক অবস্থায় দেখা যায় এমন অনেক কিছুই খাদ্য নিরাপত্তা আইনের সাথে সাংঘর্ষিক, যেমন রাস্তায় খাবার বিক্রি। কিন্তু আর্থ-সামাজিক দিক থেকে দেখতে গেলে দেখা যাবে এদের বড় একটি অংশ দরিদ্র মানুষ । তারা কম টাকায় খাদ্য সংস্থান করছেন, কিন্তু এখানে জেল-জরিমানা হলে খাবারের দাম হঠাৎ অস্বাভাবিক বেড়ে যাবে, যা এই ভোক্তাদের জন্য অসুবিধা হয়ে দাঁড়াবে। তাই দেশের আর্থ-সামাজিক পরিবেশ বিবেচনায় খাদ্য নিরাপত্তা বাস্তবায়ন করতে হলে আমাদের সময় লাগবে।’
গম ও চাল মজুদের গোডাউনের সংকটের প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘আসলে এই মৌসুমে আমরা একটু চাপে থাকি। বেশিরভাগ সময় ধারণ ক্ষমতার বাইরে ফসল সংগ্রহ হওয়ার কারণে তা সংরক্ষণ করা যায় না। এ সমস্যা সমাধানের জন্য গোডাউন স্থাপন করা হচ্ছে। এছাড়াও এসব গোডাউনও চিরস্থায়ী নয়। এগুলো মেরামত কিংবা পুনঃনির্মাণের প্রয়োজন হয়।’
তিনি বলেন, খাদ্যপণ্য সরবরাহ ও বহনে পরিবহন ব্যবস্থার মধ্যে ট্রেন তুলনামূলকভাবে সাশ্রয়ী। তবে রেলওয়ের ধারণ ক্ষমতা, সক্ষমতা ও রেলওয়ে কর্মকর্তাদের ইচ্ছা-অনিচ্ছার ব্যাপার এখানে আছে। এটি নিয়েও ভাবা যেতে পারে।
বাজার দর স্থিতিশীল রাখার লক্ষ্যে পাবলিক ফুড ডিস্ট্রিবিউশনের আওতায় খোলা বাজারে খাদ্যশস্য বিক্রয় (ওএমএস) কার্যক্রমে চাল ও আটা বিক্রয় চলমান রয়েছে। এ কার্যক্রমের পরিধি অধিকতর স্বচ্ছ, গতিশীল ও জনবান্ধব করার লক্ষ্যে খোলা বাজারে খাদ্যশস্য বিক্রয় (ওএমএস) নীতিমালা-২০১৫ বাতিলক্রমে খোলা বাজারে খাদ্যশস্য বিক্রয় (ওএমএস) নীতিমালা-২০২৪ জারি করা হয়েছে।