বাসস
  ০৮ নভেম্বর ২০২৫, ১২:৫১

জলবায়ু রহস্যের সূত্র মিলছে পামির পর্বতের বরফে

ঢাকা, ৮ নভেম্বর, ২০২৫ (বাসস) : স্ট্যানিস্লাভ কুতুজভ হঠাৎ টের পেলেন, তাজিকিস্তানের পামির পর্বতের এক হিমবাহ থেকে তিনি যে ড্রিল মেশিন পরিচালনা করছেন তা ১০০ মিটারেরও বেশি গভীরে থাকা শক্ত বরফ স্তরে গিয়ে ঠেকেছে। এই ড্রিলিং থেকে বরফের যে কোর নমুনা সংগ্রহ করা হবে, সেটি জলবায়ু বিজ্ঞানের বড় রহস্য উন্মোচনে সহায়ক হতে পারে বলে মনে করছেন বিজ্ঞানীরা।

তাজিকিস্তানের চুকুরবাশি এলাকা থেকে এএফপি এই খবর জানিয়েছে।

রুশ বংশোদ্ভূত গ্লেসিওলজিস্ট কুতুজভ সেই সময়ের অভিজ্ঞতা জানিয়ে বলেন, ‘এটি জীবনের সেরা অনুভূতি।’

তিনি ছিলেন ১৫ জন আন্তর্জাতিক বিজ্ঞানীদের নিয়ে গঠিত অভিযাত্রী দলের সদস্য। একমাত্র সংবাদ সংস্থা হিসেবে ঐতিহাসিক এই অভিযানটির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন এএফপি’র প্রতিনিধিরা।

বিজ্ঞানীদের দলটি চীন সীমান্তের কাছাকাছি ৫ হাজার ৮১০ মিটার (১৯ হাজার ফুট) উচ্চতার বরফঢাকা এক শৃঙ্গে অভিযানটি চালায়।

এই অভিযানের মূল লক্ষ্য ছিল পামির হিমবাহ থেকে সবচেয়ে গভীরের বরফ কোর সংগ্রহ করা। যাতে পৃথিবীর এই উঁচু ও কম গবেষণা হওয়া পর্বতশ্রেণি থেকে প্রাচীনতম জলবায়ুর তথ্য পাওয়া যায়। 

জানা যায়, শতাব্দী কিংবা সহস্রাব্দ ধরে সঞ্চিত বরফের স্তরগুলোয় ধূলিকণা জমে থাকে। সেগুলো থেকে অতীতের বায়ুমণ্ডল, তাপমাত্রা ও তুষারপাতের ইতিহাস সম্পর্কে ধারণা মেলে।

বিজ্ঞানীদের প্রত্যাশা, সংগৃহীত বরফ নমুনাগুলো পামির-কারাকোরাম অঞ্চলের ইতিহাসে সবচেয়ে প্রাচীন বরফ হতে পারে। কারণ, এটি পৃথিবীর একমাত্র পাহাড়ি অঞ্চল যেখানে হিমবাহ এখন পর্যন্ত বৈশ্বিক উষ্ণায়নের বিরুদ্ধে টিকে আছে।

এই অভিযানটি গত সেপ্টেম্বরে, সুইস পোলার ইনস্টিটিউট ও আইস মেমোরি ফাউন্ডেশনের অর্থায়নে পরিচালিত হয়। মূলত ফেডচেঙ্কো হিমবাহে ড্রিল করার পরিকল্পনা ছিল, কিন্তু সেখানে হেলিকপ্টার নামানো সম্ভব না হওয়ায় পরিকল্পনা বদলাতে হয়। এটি মধ্য এশিয়ার পামির পর্বতমালায় অবস্থিত। ফেডচেঙ্কো বিশ্বের সবচেয়ে দীর্ঘ পর্বতীয় হিমবাহগুলোর মধ্যে একটি।

পাহাড় নামা শুরু

পরিকল্পনা পরিবর্তনের পর সুইস, জাপানি, রাশিয়ান ও তাজিক বিজ্ঞানীদের দল যায় তুলনামূলক নিচু চুকুরবাশি হিমবাহের দিকে। এই সিদ্ধান্তটি শেষ পর্যন্ত ফলপ্রসূ হয়।

পাহাড়ি দুঃসাহসিক এই অভিযানটি ধাপে ধাপে শেষ করতে হয়েছিল। চাঁদের মতো পাথুরে ভূমি, জমাট ও চোকা বরফের সমুদ্র ও তুষারঢাকা গম্বুজাকৃতি চূড়া পেরিয়ে তারা পৌঁছান গন্তব্যে। সেখান থেকে মধ্য এশিয়ার অপূর্ব দৃশ্য দেখা যাচ্ছিল। ড্রিলিং চলে টানা এক সপ্তাহ। সেসময় রাতে তাপমাত্রা কখনও কখনও মাইনাস ১৮ ডিগ্রি সেলসিয়াসে নেমে যেত।

দলটি বরফ থেকে ৫০ সেন্টিমিটার (২০ ইঞ্চি) লম্বা কয়েক ডজন কোর তুলতে সক্ষম হয়। প্রতিটি নমুনায় নম্বর ট্যাগ লাগিয়ে বরফবক্সে রাখা হয়। সেগুলো পাহাড় থেকে নামিয়ে চার চাকার গাড়িতে করে রেফ্রিজারেটেড ট্রাকে স্থানান্তর করা হয়, যাতে বরফের গঠন নষ্ট না হয়।

যিনি যুক্তরাষ্ট্রের ওহাইও স্টেট বিশ্ববিদ্যালয়ের প্যালিওক্লাইম্যাটোলজিস্ট (প্রাচীন জলবায়ু বিজ্ঞানী) কুতুজভ জানান, প্রথম ৫০ মিটার আমরা একদিনেই শেষ করতে পেরেছি। তবে ৭০ থেকে ৮০ মিটারের পর থেকেই সমস্যা দেখা দেয়। কোরের গুণমান খারাপ হতে শুরু করে। বরফ হঠাৎ শক্ত ও ভঙ্গুর হয়ে পড়ে, যা ড্রিল পরিচালনা কঠিন করে তোলে।

কিন্তু এ অবস্থাকেও আশাব্যঞ্জক মনে করছেন অভিযানের নেতৃত্বে থাকা ইভান মাইলস। তিনি সুইজারল্যান্ডের ফ্রিবুর্গ ও জিউরিখ বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্লেসিওলজিস্ট (হিমবাহ বিশেষজ্ঞ)।

তিনি বলেন, বরফের ভেতরে প্রচুর ধূলিকণা পাওয়া গেছে, যা ড্রিলের গতি কমিয়ে দিয়েছিল। শেষদিকে বরফের রংও বদলে যায়।

কুতুজভ জানান, ‘শেষ ৩ থেকে ৫ মিটারে বরফ হয়ে যায় গাঢ় বাদামী, প্রায় হলদেটে’ । এটি নির্দেশ করে, সেখানে হয়তো জলবায়ু পরিবর্তনের প্রাচীন কোনো চিহ্ন লুকিয়ে আছে।

৩০ হাজার বছরের পুরনো হতে পারে

‘শেষ কোরটি যখন তুললাম, আমাদের সবার মনে হচ্ছিল এটি এক অবিশ্বাস্য মুহূর্ত,’ স্মৃতিচারণ করে বলেন মাইলস। বরফের ভেতরে কাদা মেশানো হলদেটে স্তরটি আমাদের আশাবাদী করে তুলেছে।

বিজ্ঞানীরা আরও জানান, এর আগেও এ অঞ্চলের হিমবাহ থেকে প্রাচীন বরফের নমুনা পাওয়া গেছে। উদাহরণ হিসেবে কিরগিজস্তানের গ্রিগোরিভ হিমবাহ থেকে ১৭ হাজার বছর পুরনো বরফ কোর পাওয়া গিয়েছিল।

তিব্বতের গুলিয়া হিমবাহ থেকে আরও পুরনো বরফ পাওয়া গেছে, তবে সেটির বয়স নিয়ে বিতর্ক আছে।

অক্টোবরে তাজিকিস্তানের রাজধানী দুশানবেতে ফেরেন মাইলস। সেসময় তিনি বলেন, আমাদের সংগৃহীত বরফ গ্রিগোরিভের তুলনায় অনেক বেশি ঠান্ডা এবং সম্ভবত আরও পুরনো। এটি আমাদের আশার আলো দেখাচ্ছে।

তিনি আরও বলেন, এখন ল্যাবরেটরিতে বিশ্লেষণ করলেই নিশ্চিত হওয়া যাবে। আশা করছি, এই কোর শুধু ওই এলাকার জন্য নয়, পুরো অঞ্চলের জন্য ব্যতিক্রমী তথ্য দেবে। এটি হয়ত ২০, ২৫, এমনকি ৩০ হাজার বছর পুরনোও হতে পারে।