শিরোনাম
ঢাকা, ১৮ জুলাই, ২০২৫ (বাসস) : সিরিয়ার দ্রুজ অধ্যুষিত সুয়েইদা প্রদেশে গত কয়েক দিনের ভয়াবহ সংঘর্ষে ৫শ’ জনের বেশি মানুষ নিহত হওয়ায় বৃহস্পতিবার সেখান থেকে সেনা প্রত্যাহার করেছে ইসলামপন্থি নেতৃত্বাধীন সরকার। যুদ্ধ পর্যবেক্ষণকারী একটি সংস্থা এই তথ্য জানিয়েছে।
সুয়েইদা থেকে বার্তা সংস্থা এএফপি এ খবর জানিয়েছে।
গত রোববার থেকে সুয়েইদায় দ্রুজ যোদ্ধাদের সঙ্গে সুন্নি বেদুইন গোত্র এবং সেনাবাহিনী ও তাদের মিত্রদের সংঘর্ষে শত শত মানুষ নিহত হয়েছেন বলে জানা গেছে।
এএফপি সংবাদদাতারা জানিয়েছেন, বৃহস্পতিবার সুয়েইদা শহরের পরিস্থিতি ছিল জনশূন্য। দোকানপাট লুট হয়েছে, ঘরবাড়ি পুড়ে গেছে এবং রাস্তায় পড়ে ছিল মৃতদেহ।
৩৯ বছর বয়সী চিকিৎসক হানাদি ওবেইদ এএফপি’কে বলেছেন, ‘শহরটিকে দেখে মনে হচ্ছিল যেন এটি সদ্য বন্যা বা প্রাকৃতিক দুর্যোগ থেকে বেরিয়ে এসেছে।’
গত মঙ্গলবার সরকারি সেনা মোতায়েন ও ইসরাইলের সামরিক হস্তক্ষেপের কারণে সাম্প্রদায়িক রক্তপাত আরও বেড়ে যাওয়ার পর অন্তর্বর্তীকালীন প্রেসিডেন্ট আহমেদ আল-শারা এক টেলিভিশন ভাষণে বলেছেন, ‘সর্বোচ্চ জাতীয় স্বার্থের’ কথা মাথায় রেখে সুয়েইদায় নিরাপত্তার দায়িত্ব আবার স্থানীয় সম্প্রদায়ের নেতাদের হাতে ফিরিয়ে দেওয়া হবে।
সিরিয়ান অবজারভেটরি ফর হিউম্যান রাইটস জানিয়েছে, রোববার থেকে সুয়েইদা প্রদেশে সংঘর্ষে ৫৯৪ জন নিহত হয়েছেন।
জাতিসংঘের মানবিক বিষয়ক সংস্থা ওসিএইচএ জানিয়েছে, এই সহিংসতার কারণে দক্ষিণ প্রদেশের ‘প্রায় দুই হাজার পরিবার বাস্তুচ্যুত হয়েছে।’
সরকারি বাহিনী সুয়েইদায় অবস্থান নেওয়ার পর ইসরাইল একের পর এক বিমান হামলা চালায়। শুধু সুয়েইদা নয়, রাজধানী দামেস্কের সামরিক সদর দফতরসহ বিভিন্ন স্থাপনায় হামলা চালানো হয়। ইসরাইল জানায়, সেনা প্রত্যাহার না হওয়া পর্যন্ত হামলা জোরদার হবে।
অবজারভেটরি জানিয়েছে, ইসরাইলের হামলায় দামেস্কে তিনজন নিহত হয়েছেন।
পরে সিরিয়ার রাষ্ট্রীয় সংবাদ সংস্থা ‘সানা’ জানায়, সরকারি বাহিনী সরে যাওয়ার পরও ইসরাইল থামেনি এবং সুয়েইদার উপকণ্ঠে ফের আঘাত হেনেছে।
এদিকে, সিরিয়ার প্রেসিডেন্ট সুয়েইদায় দ্রুজ যোদ্ধাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধবিরতি লঙ্ঘনের অভিযোগ করেছেন, যার ফলে সরকারি বাহিনীকে সেখান থেকে সরে আসতে হয়।
এক বিবৃতিতে প্রেসিডেন্ট কার্যালয় জানিয়েছে, কিছু ‘বেআইনি গোষ্ঠী’ চুক্তি ভেঙে বেসামরিক মানুষের ওপর ‘ভয়াবহ সহিংসতা’ চালিয়েছে।
প্রেসিডেন্ট কার্যালয় আরও সতর্ক করে বলেছে, সিরিয়ার অভ্যন্তরীণ বিষয়ে ইসরাইলের এমন সরাসরি হস্তক্ষেপ চলতে থাকলে তা শুধু বিশৃঙ্খলা ও ধ্বংস বাড়াবে এবং গোটা অঞ্চলের পরিস্থিতি আরও জটিল করে তুলবে।
গত ডিসেম্বরে দীর্ঘদিনের শাসক বাসার আল-আসাদকে সরিয়ে ইসলামপন্থি নেতৃত্বে গঠিত অন্তর্বর্তী সরকার ক্ষমতায় আসে। তখন থেকেই সংখ্যালঘু গোষ্ঠীগুলোর সঙ্গে সরকারের টানাপোড়েনের সম্পর্ক শুরু হয়। সেই সরকারের প্রধান আহমেদ আল-শারা এবার বলেছেন, দ্রুজ সম্প্রদায়ের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা হবে।
একসময় আল-কায়েদার সঙ্গে যুক্ত থাকা ‘হায়াত তাহরির আল-শাম’ আন্দোলনের নেতা শারা বলেছেন, ‘আমাদের দ্রুজ জনগণের ওপর যারা নির্যাতন ও অন্যায় করেছে, তাদের জবাবদিহির আওতায় আনা হবে, কারণ দ্রুজরা রাষ্ট্রের সুরক্ষার দায়িত্বে রয়েছে।’
মার্চে ভূমধ্যসাগরীয় উপকূলীয় এলাকায় আলাউইট সংখ্যালঘুর আবাসস্থলে এক নির্মম হত্যাকাণ্ডে ১ হাজার ৭০০-এর বেশি বেসামরিক লোক নিহত হয়। হত্যাকাণ্ডের জন্য মূলত সরকারি মিত্র গোষ্ঠীকে দায়ী করা হয়েছে।
এপ্রিল ও মে মাসে সরকারি বাহিনী সুয়েইদা ও দামেস্কের কাছাকাছি দ্রুজ যোদ্ধাদের সঙ্গেও লড়াই করেছে, যেখানে ১০০ জনেরও বেশি মানুষ নিহত হয়েছেন।
কয়েকদিন ধরে চলা মারাত্মক সাম্প্রদায়িক সংঘর্ষের পর মঙ্গলবার যুদ্ধবিরতির তদারকির উদ্দেশ্যে সুয়েইদায় প্রবেশ করে সরকারি বাহিনী।
তবে, প্রত্যক্ষদর্শীরা জানিয়েছেন যে সরকারি বাহিনী এর পরিবর্তে বেদুইনদের সঙ্গে দ্রুজ যোদ্ধা ও বেসামরিক নাগরিকদের ওপর হামলা চালিয়েছিল।
দ্রুজ সম্প্রদায়ের উদ্দেশে ভাষণ দিয়ে শারা তাদের আশ্বস্ত করার চেষ্টা করেন এবং প্রতিশ্রুতি দেন, ‘আপনাদের অধিকার ও স্বাধীনতা রক্ষা করা আমাদের অগ্রাধিকার।’
সিরিয়ার প্রেসিডেন্ট ইসরাইলের সামরিক হস্তক্ষেপের সমালোচনা করে বলেছেন, ‘মার্কিন, আরব ও তুর্কি মধ্যস্থতা ছাড়া এটি বড় ধরনের উত্তেজনার দিকে ঠেলে দিত, যা অঞ্চলকে এক অজানা পরিণতি থেকে বাঁচিয়েছে।’
ইসরাইলের ঘনিষ্ঠ মিত্র ও সিরিয়ার সঙ্গে সম্পর্ক পুনঃস্থাপনের চেষ্টা চালিয়ে আসা যুক্তরাষ্ট্র বুধবার রাতে জানিয়েছে, ওই অঞ্চলে শান্তি ফিরিয়ে আনতে একটি চুক্তি হয়েছে। তারা সব পক্ষকে দেওয়া প্রতিশ্রুতি পূরণ করার আহ্বান জানিয়েছে।
বৃহস্পতিবার হোয়াইট হাউসের প্রেস সেক্রেটারি ক্যারোলিন লেভিট জানান, সিরিয়া সেনা প্রত্যাহারে সম্মত হয়েছে এবং উত্তেজনা কমানোর প্রক্রিয়া ‘চলমান রয়েছে’।
ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু বৃহস্পতিবার বলেছেন যে তার দেশের ‘জোরালো পদক্ষেপের’ কারণে যুদ্ধবিরতি সফল হয়েছে। অন্যদিকে, ক্যারোলিন লেভিট দাবি করছেন এই সফলতার কৃতিত্ব ওয়াশিংটনের।
মার্কিন পররাষ্ট্র দফতরের একজন মুখপাত্র বলেছেন যে ওয়াশিংটন ‘সাম্প্রতিক ইসরাইলি হামলাকে সমর্থন করেনি।’
দ্রুজ সম্প্রদায়ের একটা অংশ ইসরাইলে বাস করে তাই ইসরাইল এই গোষ্ঠীর রক্ষক হিসেবে নিজেকে উপস্থাপন করেছে। যদিও কিছু বিশ্লেষক বলছেন এটি একটি অজুহাত। ইসরাইল-অধিকৃত গোলান মালভূমি থেকে সিরিয়ার সরকারি বাহিনীকে দূরে রাখা যায়।
বৃহস্পতিবার তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রজব তাইয়্যিব এরদোয়ান ইসরাইলকে অভিযোগ করে বলেন, দ্রুজ সম্প্রদায়কে অজুহাত বানিয়ে ইসরাইল সিরিয়ায় তাদের দখলদারিত্ব বাড়াচ্ছে।
সহিংসতার কারণে, বৃহস্পতিবার ইসরাইল-অধিকৃত গোলান মালভূমিতে কয়েক ডজন দ্রুজ একত্রিত হয়েছিলেন, সিরিয়ার দিকে থাকা তাদের আত্মীয়দের এক ঝলক দেখার আশায়, যারা কাঁটাতারের সীমানা অতিক্রম করার চেষ্টা করতে পারে।
৩৬ বছর বয়সী শিক্ষাবিদ কামার আবু সালেহ বলেছেন যে কিছু লোক ‘বেড়া খুলে প্রবেশ করেছে এবং সিরিয়া থেকেও লোকজন এখানে পার হতে শুরু করেছে।’
তিনি আরও বলেন, ‘এটা স্বপ্নের মতো ছিল এবং আমরা এখনও বিশ্বাস করতে পারছি না যে এটা ঘটেছে।’