শিরোনাম
যশোর, ২১ জুন ২০২৫ (বাসস): প্রতিষ্ঠার পর মাত্র ১৪ বছরেই দেশের ফুটবল জগতের এক অবিচ্ছেদ্য অনুষঙ্গে পরিণত হয়েছে যশোরের শামস-উল-হুদা ফুটবল একাডেমি।
দেশীয় ফুটবলের হারিয়ে ফেলা গৌরবোজ্জ্বল সোনালি অতীত আবার ফিরিয়ে আনার প্রত্যাশায় ২০১১ সালে যশোর জেলার ৩০ জন ক্ষুদে ফুটবলার নিয়ে স্বল্প পরিসরে যাত্রা শুরু হয় একাডেমিটির।
যশোর শহর থেকে ৬ কিলোমিটার পূর্বে সবুজে ঘেরা, পাখির কলতানে মুখর হামিদপুর গ্রামে একাডেমির কলেবর বাড়তে থাকে দ্রুত। ৬৫ বিঘা জায়গার ওপর তৈরি করা হয়েছে তিনটি আন্তর্জাতিক মানের মাঠ। চতুর্থ আরেকটি মাঠ তৈরির কাজ চলছে। একই জায়গায় ৬০ হাজার স্কয়ার ফুটের একটি ছয় তলা মাল্টিপারপাস বিল্ডিং রয়েছে। যেখানে একসাথে ২৪০ জন ফুটবলারের থাকা, খাওয়া, বিনোদনসহ আধুনিক সব সুযোগ-সুবিধা রয়েছে।
২০১১ সালে ক্রীড়াবিদ ও ক্রীড়া সংগঠক এবং যশোরের বিশিষ্ট ব্যবসায়ী শামস-উল-হুদার নামে প্রতিষ্ঠিত হয় এই একাডেমি। ৭০ বছরের জীবনে ৫৬ বছরই তিনি কাজ করেছে যশোর ও সর্বোপরি দেশের খেলাধুলার উন্নয়নে। তার নেতৃত্বেই ১৯৫০ সালে গঠিত হয় যশোর জেলা ক্রীড়া সংস্থা।
প্রতিষ্ঠার পরের বছরই খুলনা বিভাগের বিভিন্ন জেলা থেকে ক্ষুদে ফুটবলাররা একাডেমির সাথে যুক্ত হয়। বর্তমানে ১০-১২, ১৩-১৪ ও ১৫-১৭ এ তিনটি বয়সভিত্তিক ক্যাটাগরিতে ১৫০ জন খেলোয়াড় আছে একাডেমিতে। তাদের মধ্যে ৬০ জন আবাসিক ভাবে একাডেমিতে থাকে।
একাডেমিটিতে একজন হেড কোচের অধীনে আরও তিনজন কোচ দায়িত্ব পালন করেন। আছেন ১৪ জন কর্মকর্তা-কর্মচারী। যাদের অক্লান্ত প্রচেষ্টায় প্রতিষ্ঠার পর থেকেই ঈর্ষণীয় সাফল্য পেতে শুরু করে প্রতিষ্ঠানটি।
প্রতিষ্ঠার পর বিগত বছরগুলোতে কাতার, থাইল্যান্ড, ভারত, নেপাল, মালয়েশিয়া ও মায়ানমারে অনুষ্ঠিত সিনিয়র ন্যাশনাল, অনূর্ধ্ব-১৪, অনূর্ধ্ব-১৫, অনূর্ধ্ব-১৬, অনূর্ধ্ব-১৮, অনূর্ধ্ব-১৯ ও অনূর্ধ্ব-২৩ বয়সভিত্তিক টুর্নামেন্টগুলোতে শামস-উল-হুদা ফুটবল একাডেমির ১৬ জন খেলোয়াড় অংশ নিয়েছেন।
গত কয়েক বছরে ইংল্যান্ডের ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড ক্লাব এবং ব্রাজিল ও আর্জেন্টিনায় অনুষ্ঠিত ট্রেনিং ক্যাম্পে একাডেমির চারজন খেলোয়াড় অংশ নেওয়ার সুযোগ পায়। আর বাংলাদেশের প্রিমিয়ার লীগে ঢাকা আবাহনী, চট্টগ্রাম আবাহনী, ব্রাদার্স ইউনিয়ন, পুলিশ এফসি, বসুন্ধরা কিংস, বিজেএমসি, ঢাকা মুক্তিযোদ্ধা, রহমতগঞ্জ ও আরামবাগে খেলেছে ও খেলছে এখানকার ২৩ জন ফুটবলার।
একাডেমিতে থাকার সর্বাধুনিক সুযোগ-সুবিধা, সুপরিসর প্র্যাকটিস মাঠ, নিরিবিলি গ্রামীণ পরিবেশের কারণে অনূর্ধ্ব-১৯ জাতীয় দল গত ১৭-২৯ এপ্রিল পর্যন্ত এখানে ক্যাম্প করে। কোচ গোলাম রাব্বী ছোটনের অধীনে এই দলের ৪০ জন সদস্য এখানে অনুশীলন করেছেন। এরপরই তারা অনূর্ধ্ব-১৯ সাফ চ্যাম্পিয়নশিপ খেলতে ভারতের অরুণাচলে যান।
আগামীতে কোরিয়াতে অনুষ্ঠেয় একটি টুর্নামেন্টে অংশ নেওয়ার প্রস্তুতি হিসেবে অনূর্ধ্ব-১৭ জাতীয় দলের চার মাসের পূর্ণাঙ্গ একটি ক্যাম্পও যশোরের শামস-উল-হুদা ফুটবল একাডেমিতে অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা রয়েছে।
সম্পূর্ণ ব্যক্তি উদ্যোগে গড়ে ওঠা যশোরের এই ফুটবল একাডেমি অত্যন্ত অল্প সময়ে দেশের ফুটবল জগতের অবিচ্ছেদ্য অনুষঙ্গ হয়ে উঠেছে। শামস-উল-হুদা ফুটবল একাডেমির হেড কোচ কাজী মারুফ বলেন, বিশিষ্ট শিল্পপতি বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশনের (বাফুফে) সহ-সভাপতি ও ডেভেলপমেন্ট কমিটির চেয়ারম্যান মো. নাসের শাহরিয়ার জাহেদী স্বপ্নটা দেখিয়েছিলেন। তিনিই এ একাডেমির প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান। তাঁর পরিকল্পনা অনুযায়ীই সবকিছু হয়েছে।
হেড কোচ বলেন, একাডেমির একটানা সাফল্যের পেছনে চেয়ারম্যান থেকে গ্রাউন্ডসম্যান, প্রত্যেকেরই উল্লেখযোগ্য অবদান রয়েছে। সবার অবদানেই প্রতিবছর নতুন নতুন সাফল্যের পালক যুক্ত হচ্ছে একাডেমির নামের সাথে।
শামস-উল-হুদা ফুটবল একাডেমির ক্ষুদে ফুটবলার মো. আল মাহদি। নবম শ্রেণির ছাত্র ১৬ বছর বয়সী মাহদি জামালপুর জেলার মাদারগঞ্জ উপজেলার মহিষবাথান গ্রামের সন্তান। গত জানুয়ারি মাসে এ একাডেমিতে ভর্তি হয়েছে সে। এখানে সুযোগ পাওয়া মাহদির কাছে স্বপ্নের মতো মনে হয়। মাহদি জানায়, এর আগে সে জামালপুরের একটা ফুটবল একাডেমিতে কোচিং নিত। খেলেছে ময়মনসিংহ বিভাগ দলে। বড় ভাইয়ের কাছ থেকে শামস-উল-হুদা ফুটবল একাডেমির কথা শুনে এখানে ভর্তি হয় সে।
এই একাডেমির শিক্ষার্থী হতে পারায় খুশি মাহদি জানায়, ‘এখানকার থাকা, খাওয়া, প্র্যাকটিস সবকিছু আধুনিক মানের। এমনকি স্থানীয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ভর্তি ও লেখাপড়ার দায়িত্বও নেয় একাডেমি’।
নারায়ণগঞ্জ জেলার বন্দর মদনগঞ্জের গোলাম রাব্বি খান (১৮) এ একাডেমিতে ভর্তি হয় ২০১৯ সালে। খেলেছে রাশিয়ার ফেস্টিভ্যাল টুর্নামেন্টে। দেশে ধানমন্ডি ক্লাবের হয়েও খেলেও নাম করেছে।
রাব্বি জানায়, ‘এখানকার সুযোগ সুবিধা খুবই উন্নতমানের। থাকা, খাওয়া, পরিবেশ সবকিছু অসাধারণ। দুই মাস পরপর ছুটি দেয়। সপ্তাহে একদিন মোবাইলে বাবা-মায়ের সাথে কথা বলা যায়’।
একাডেমির পরিচালক (প্রশাসন) শেখ শামসুল বারী শিমুল প্রতিষ্ঠানটিকে ঘিরে তাদের বর্তমান কার্যক্রম ও স্বপ্নের কথা জানান। তিনি বলেন, ‘আমাদের এখানকার সব কোচ লাইসেন্সধারী এবং সেরা লেভেলের। ছাত্ররা ২৪ ঘণ্টা তাদের তত্ত্বাবধানে থাকে’।
তিনি বলেন, ‘মেয়েদের জন্যও খুব দ্রুতই এই একাডেমিতে আলাদা মাল্টি পারপাস বিল্ডিং ও আলাদা মাঠ তৈরি করা হবে। তখন ক্ষুদে মেয়ে ফুটবলাররাও এখানে ভর্তি হতে পারবে’।
অদূর ভবিষ্যতে এ একাডেমিতে গোথিয়া ও ডানা কাপের মতো বয়সভিত্তিক জাতীয় ও আন্তর্জাতিক টুর্নামেন্ট আয়োজনের স্বপ্নের কথাও জানান তিনি।
সাফল্যের স্বীকৃতি হিসেবে এপ্রিলে ক্রীড়া সাংবাদিকদের সংগঠন বাংলাদেশ স্পোর্টস প্রেস এসোসিয়েশনের (বিএসপিএ) বর্ষসেরা সংগঠন নির্বাচিত হয় শামস-উল-হুদা ফুটবল একাডেমি।
সকাল-বিকেল প্রতিদিন, শামস-উল-হুদা ফুটবল একাডেমির সবুজ মাঠে ঘাম ঝরায় একঝাঁক কিশোর, যে ঘামে জড়িয়ে আছে সংগ্রাম, স্বপ্ন আর সম্ভাবনার সুবাস। দেশের প্রতিটি বিভাগে, অঞ্চলে যদি এমন উদ্যোগ ছড়িয়ে দেওয়া যায়, হয়তো বিশ্ব ফুটবলের মানচিত্রে ‘বাংলাদেশ’ নামটাও একদিন সগৌরবে উচ্চারিত হবে।