॥ সঞ্জীব চন্দ বিল্টু ॥
শেরপুর, ৭ মার্চ, ২০২২ (বাসস) : অ্যাডভোকেট আব্দুল হালিম বলেন, ১৯৭০ সালে শ্রীবরদী-ঝিনাইগাতী আসনে আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়ে বঙ্গবন্ধুর বাড়িতে একান্ত সাক্ষাত করতে যাই, সময়টা ছিল ১৯৭১ সালের ফেব্রুয়ারি মাসের প্রথম দিকে। সাক্ষাত করতে গিয়ে দেখি সকালে বঙ্গবন্ধু তার বাড়িতে খাটের উপর বসে নাস্তা খাচ্ছেন। আমাকে দেখে বঙ্গবন্ধু বললেন, হালিম তুই কিসের জন্যে এসেছিস। আমি বললাম কিছু কথা আছে। তিনি বললেন, কোন কথা নেই, এলাকায় যা। ছাত্র-শ্রমিক-কৃষক অবসরপ্রাপ্ত সামরিক-বেসামরিক কর্মকর্তা ও সিপাহীদের তালিকা তৈরী কর এবং সীমান্তে অবস্থানরত ইপিআরদের সাথে নিয়মিত যোগাযোগ রাখ। তোর ঢাকা বসে থাকার দরকার নাই। আমি বঙ্গবন্ধুর কথায় এলাকায় চলে আসি। তখনও বুঝিনি দেশে কী হতে যাচ্ছে। সে কথাটি আমার বার-বার মনে পড়ে। ৭ নভেম্বর রোববার দুপুর ১২টায় শ্রীবরদীতে মাদারপুর গ্রামে একান্ত সাক্ষাতকারে আওয়ামী লীগ নেতা সাবেক এমপি অ্যাডভোকেট আব্দুল হালিম এসব কথা বলেন।
অ্যাডভোকেট আব্দুল হালিম ১৯৭০ ও ’৭৩ সালে আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। ১৯৫৮ সালে ময়মনসিংহ আনন্দ মোহন কলেজে অধ্যয়নকালে তৎকালীন আওয়ামী লীগ নেতা রফিক উদ্দিন ভূইয়ার অনুপ্রেরণায় ছাত্রলীগের সক্রিয় কর্মী হিসেবে তার রাজনৈতিক জীবন শুরু হয়। পরবর্তীতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় ১৯৬২ সালে শিক্ষানীতি আন্দোলন করতে গিয়ে কারাবরণ করেন। এই প্রবীণ নেতার এখন বয়স ৮৫ বছর। বার্ধক্যজনিত কারণে অতীত ইতিহাস অনেক কিছুই তিনি এখন আর সেভাবে মনে করতে পারেন না। তারপরও ভাঙ্গা-ভাঙ্গা গলায় কিছু স্মৃতি এ প্রতিবেদকের কাছে তুলে ধরেন।
সাবেক এমপি আব্দুল হালিম বলেন, ১৯৭৩ সালে আমি পুনরায় সংসদ সদস্য নির্বাচিত হওয়ার পর বঙ্গবন্ধুর সাথে আমার সরাসরি সাক্ষাত হয়। তিনি তখন বলেছিলেন, আমি যা চেয়েছিলাম, তা পেয়েছি; বাঙালী জাতিকে একটি স্বাধীন রাষ্ট্র উপহার দিতে পেরেছি। এখন আমাদের দফা নেই। এখন তোরা যার-যার অবস্থান থেকে দেশকে অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী করতে কাজ চালিয়ে যা।
১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধু হত্যাকান্ডের পর খুনি মোস্তাক তৎকালীন সংসদ সদস্যদের নিয়ে যে সংসদীয় দলের বৈঠক করেন, সে বৈঠকে আমি উপস্থিত হয়ে বঙ্গবন্ধুর খুনীদের বিচার দাবী করি এবং সংসদীয় দলের বৈঠক বর্জন করি। তারপর আমার উপর নেমে আসে বিভিন্ন জুলুম, নির্যাতন, অত্যাচার। দীর্ঘদিন আত্মগোপনে থাকি এবং বঙ্গবন্ধু ও তাঁর পরিবারের সদস্যদের নির্মম হত্যাযজ্ঞের প্রতিবাদে জনগণকে সংগঠিত করার জন্য কাজ চালিয়ে যাই।
অতীত স্মৃতি রোমন্থন করতে গিয়ে কখনও তিনি বাকরুদ্ধ হয়ে পড়েন। দু’চোখ গড়িয়ে পানি ঝরতে থাকে। বিদায় বেলায় তিনি শেষ যে কথাগুলো বললেন তা হলো-‘হয়তো আমি চলে যাব, কিন্তু বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলা অসাম্প্রদায়িক চেতনায় বাংলাদেশ এগিয়ে যাবে।’
বর্ষিয়ান এ আওয়ামী লীগ নেতা অ্যাডভোকেট আব্দুল হালিম শেরপুরে শ্রীবরদী উপজেলার মাদারপুর গ্রামের সভ্রান্ত মুসলিম পরিবারের ১৯৩৭ সালের এপ্রিল মাসের ১১ তারিখে জন্মগ্রহণ করেন। ১৯৫৪ সালে শেরপুর সরকারি ভিক্টোরিয়া একাডেমি থেকে ম্যাট্রিকুলেশন, ১৯৫৬ সালে ময়মনসিংহ আনন্দ মোহন কলেজ থেকে ইন্টারমিডিয়েট ও ১৯৫৮ সালে একই প্রতিষ্ঠান থেকে বিএ পাশ করেন। কলেজে থাকাকালীন তিনি ছাত্র রাজনীতিতে অর্থাৎ ছাত্রলীগে জড়িয়ে পড়েন।
ঢাকা বিশ^বিদ্যালয় থেকে ১৯৬২ সালে এলএলবি ডিগ্রি নেয়ার পর আইন পেশার পাশাপাশি আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে মনোনিবেশ করেন। ১৯৭০ সালে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে একজন সংগঠক হিসেবে সক্রিয় ভুমিকা পালন করেন। তিনি সুপ্রীম কোর্ট আওয়ামী আইনজীবী সমিতির সভাপতি ছিলেন। জেলা পরিষদের প্রশাসক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। সৎ, নিষ্ঠাবান আইনজীবী ও রাজনীতিক হিসেবে স্থানীয় ও জাতীয়ভাবে তার ব্যাপক সুনাম রয়েছে। দুই সন্তানের জনক সাবেক এমপি অ্যাডভোকেট আব্দুল হালিম স্ত্রী বিয়োগের পর বর্তমানে রাজধানী ঢাকা ছেড়ে গ্রামের বাড়ি শেরপুরের মাদারপুরে থাকছেন।