বাসস
  ০২ মার্চ ২০২২, ১৩:৫২
আপডেট  : ০২ মার্চ ২০২২, ১৪:০৮

বঙ্গবন্ধুকে কাছ থেকে বার-বার দেখেও আমার তৃপ্তি হয়নি : মোহাম্মদ আলী টিপু

॥ শাহ ফখরুজ্জামান ॥
হবিগঞ্জ, ২ মার্চ, ২০২২ (বাসস) : রাজনৈতিক পরিবারে জন্ম। লেখাপড়ায় উচ্চ শিক্ষিত। চাইলেই হতে পারতেন বড় নেতা। কিন্তু তিনি আজীবন নিজেকে কর্মী ভাবতেই পছন্দ করেন। পিতা বড় নেতা ও জনপ্রতিনিধি হওয়ায় নিজ বাসায় বঙ্গবন্ধুকে দেখার সুযোগ হয়েছে। হবিগঞ্জের প্রতিটি আগমন আর কর্মসূচিতে উপস্থিত হয়ে কাছ থেকেই বঙ্গবন্ধুকে দেখেছেন। তারপরও সুযোগ পেলেই চলে যেতেন ঢাকার ধানমন্ডি ৩২ নম্বর বাসায়। উদ্দেশ্য বঙ্গবন্ধুকে দেখা। এভাবে বহু বার দেখা হলেও তৃপ্তি মিলেনি তার। বার-বার দেখার ইচ্ছা জাগ্রত হত। হবিগঞ্জের বীর মুক্তিযোদ্ধা মোহাম্মদ আলী টিপুর সঙ্গে আলাপকালে তিনি তার এই অনুভূতির কথা জানান।
মোহাম্মদ আলী টিপু বলেন, ‘আমি একজন মুক্তিযোদ্ধা। আমি একজন রাজনৈতিক কর্মী। ৬০ ও ৭০-এর দশকের ছাত্র রাজনীতিতে, হবিগঞ্জে স্বাধীকার আন্দোলন সংগ্রামে আমি একজন কর্মী ছিলাম। মহকুমা ছাত্রলীগ প্রতিষ্ঠায় আমারও ভূমিকা ছিল। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান রাজনৈতিক কর্মকান্ড পরিচালনার জন্য বিভিন্ন সময়ে হবিগঞ্জ এসেছেন। শুধুমাত্র একবার ডাক বাংলোতে উঠেছিলেন। এছাড়া, সবসময় আমাদের বাসায় উঠেছেন। আম্মার হাতের রান্না পছন্দ করতেন এবং ভাবী সম্বোধন করতেন। আওয়ামী লীগের নেতারা ও উনার সঙ্গে থাকতেন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব উনার মহানুভবতায় আমাকে নিজ সন্তানতুল্য স্নেহ করতেন। পিতৃ পরিচয়ের বাইরে আমি অতি সাধারণ একজন মুক্তিযোদ্ধা ও রাজনৈতিক কর্মী।’
মোহাম্মদ আলী টিপু স্মৃতি হাতড়ে বলেন, ১৯৬৭ সালে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ৬ দফার প্রচারের জন্য এবং এর  যৌক্তিকতা পূর্ব বাংলার মানুষের সামনে তুলে ধরার লক্ষ্যে সারা বাংলাদেশে পথসভা এবং জনসভা করে যাচ্ছিলেন। এরই ধারাবাহিকতায় তিনি হবিগঞ্জ আসেন। তাঁর সঙ্গে ছিলেন তখনকার কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগ সাধারণ সম্পাদক শাহ মোয়াজ্জেমসহ অনেক কেন্দ্রীয় নেতা। হবিগঞ্জ শহরের মুসলিম কোয়ার্টার এলাকার চিলড্রেন পার্কে সভা অনুষ্ঠিত হয়। এর আগে বঙ্গবন্ধু আমাদের বাসায় খাওয়া দাওয়া ও বিশ্রাম নেন। সভাস্থলের পাশেই সাবেক অর্থমন্ত্রী মরহুম শাহ এ এম এস কিবরিয়ার বড়ভাই এডভোকেট শামসুদ্দীন জিপি সাহেবের বাসা। তিনি মহকুমা আওয়ামী লীগে থাকলেও পরবর্তীতে কনভেনশন মুসলিম লীগে যোগদান করেন এবং জিপি হন। উনার বাসার বারান্দায় চেয়ার টেবিল নিয়ে বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থার লোকজন খাতাকলমসহ ১২টা থেকেই বসা ছিলেন। বাদ জোহর আওয়ামী লীগ নেতা মরহুম জবান উল্লাহ চাচা, মরহুম নিম্বর আলী চাচা ও আমিসহ আরও কয়েকজন মাঠে যাই। চিলড্রেন পার্কের পূর্ব দিকে মধ্যখানে মাইক স্ট্যান্ড আর উপরে একটি ত্রিপল টানিয়ে সভা মঞ্চের আকার দেয়া হয়। বঙ্গবন্ধু কিছুক্ষণের মধ্যেই সভাস্থলে এসে পৌঁছান। সিএন্ডবি সড়কের (যা শহরের উত্তর-দক্ষিণে চলমান তার) পশ্চিম পাশে দোকান ঘরের বারান্দায় অনেক মানুষ উপস্থিত। কিন্তু কেউ মাঠে প্রবেশ করতে রাজী না। তাদের চোখে মুখে ভয় পরিলক্ষিত হয়। আমার পিতা মরহুম মোস্তফা আলীর সভাপতিত্বে সভা শুরু হয়। শাহ মোয়াজ্জেম সাহেবের বক্তব্যের পর বঙ্গবন্ধু বক্তব্য দিতে দাঁড়ালেন। মাউথ পিস ঠিক করতে গিয়ে মাইকের লোকটি ৩/৪ বারে মাউথ পিসটি উনার মুখের বরাবরে নিয়ে আসেন। বঙ্গবন্ধু হাসতে-হাসতেই বলা আরম্ভ করলেন, ‘সভাপতি সাহেব লম্বা ত কম হই নাই, হয়ত আরও বেশিই হইতাম, যদি আয়ুব খাঁর কারাগারে এইভাবে বন্দী না থাকতে হত’ আরও অনেক কিছুই বলেছিলেন। সবই ৬দফা ভিত্তিক, আজ আর মনে নেই। সেটি বঙ্গবন্ধুর প্রথম হবিগঞ্জ আগমন।’  
মোহাম্মদ আলী টিপু বলেন, ‘১৯৬৯ সালে বঙ্গবন্ধু ২য় বার হবিগঞ্জে আসেন। সেবার বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সারা বাংলাদেশে গণসংযোগ আরম্ভ করলেন। এরই ধারাবাহিকতায় হবিগঞ্জ আসার কর্মসূচি দিলেন। আমার পিতাকে জানানো হয় তিনি আমাদের বাসায় মেহমান হবেন। হবিগঞ্জে আমাদের বাসায় এসে পৌঁছানোর সময় খুব বেশি দেরি হলে সন্ধ্যা হতে পারে। কিন্তু, তিনি আসলেন রাত ১টায়। তার সাথে খুনি মোশতাকসহ কেন্দ্রীয় নেতৃবৃন্দ এবং শেখ কামাল ভাইও ছিলেন। বঙ্গবন্ধু আমাদের বাসার সামনে পৌঁছালে আমি শ্লোগান ধরি, ‘৬ দফা, ১১ দফা মানতে হবে’, তখন মরহুম ফিরোজম মতি, শিবু, জাহিদ, নিমু সিরাজ মালেক, মুক্তিযোদ্ধা সিরাজ, সিরাজ কমিশনার হালিম খানসহ আরও অনেকেই এর সাথে শ্লোগান দেয় ‘‘নইলে বাংলা স্বাধীন হবে"। বঙ্গবন্ধু প্রায় লাফ দিয়ে উনার সাদা টয়োটা থেকে নেমে আমাকে বললেন, ‘এই ছেলে বল, ৬ দফা ১১দফা মানতে হবে, নইলে বাংলা ছাড়তে হবে।’ নিজে-নিজে স্বগোক্তি করেছন, ‘স্বাধীন করবে, স্বাধীন করবে। শেখ মুজিবকে আবার জেলে ঢুকালে,কিছুই হবে না’-এই বলে আমাদের বাসায় ঢুকে গেলেন।
হবিগঞ্জে তখন ছাত্র ইউনিয়নের একচেটিয়া আধিপত্য। হবিগঞ্জ ছাত্র ইউনিয়নের নেতৃবৃন্দ ১১দফা আন্দোলনের আহ্বায়ক আব্দুল  মোত্তালিব চৌধুরী, শহীদ উদ্দিন চৌধুরী, আহাদ খান, ফজলুল করিম চৌধুরীসহ আরো অনেকেই ছিলেন তারা আমাদের বাসায় বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে দেখা করতে আসেন। ছাত্র ইউনিয়নের নেতৃবৃন্দকে বললাম-একটু অপেক্ষা করুন। কারণ, আমরা ছাত্রলীগাররা তখন আমাদের নেতার কারণে পাওয়ারফুল। আমরা দেখা করার পর উনারা দেখা করেন। আব্বা আমাকে দেখিয়ে বঙ্গবন্ধুকে বললেন, আমার বড় ছেলে। আমি বঙ্গবন্ধুকে কদমবুসি করলাম। বঙ্গবন্ধু ছাত্রলীগের সকলকে আবার ডেকে বললেন, সকালে আমাদের ছাত্রলীগ অফিসে যাবেন।
পরদিন সকাল ১০/১১টায় রিক্সায় চড়ে বঙ্গবন্ধু আমাদের ছাত্রলীগ অফিসে আসলেন। আবদুল মালেক ভাই প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি, আব্দুর রহিম ভাই সাধারণ সম্পাদক আর আমি সাংগঠনিক সম্পাদক হিসেবে পরিচয় দিলে, উনি আমাকে বললেন, ‘পাগল, তুই এখানেও আছিস?’। ছাত্রলীগের অফিস থেকে, বঙ্গবন্ধু টাউন হলে সভাস্থলে চলে যান’।
১৯৭০ সালের নির্বাচনী প্রচারণায় বঙ্গবন্ধু হবিগঞ্জ জালাল স্টেডিয়ামে জনসভায় ভাষণ প্রদান করেন। আব্বার সভাপতিত্বে সভায় গণসংগীত পরিবেশন করেন চট্টগ্রামের শফী ভাই এবং আমাদের সাদী ভাই। হালকা বৃষ্টি হলে, বঙ্গবন্ধূ বলেছিলেন-‘এটি আল্লাহ তায়ালার রহমত’।
হবিগঞ্জে সেইবার তিনি জেলা পরিষদের ডাক বাংলোয় উঠেছিলেন। নির্বাচনী জনসভা করার জন্য ১৯৭০ সালের শেষ দিকে আবারও শায়েস্তাগজ্ঞ হাই স্কুল মাঠে বক্তব্য রাখেন। সেই সভায় ভীড় হলে বঙ্গবন্ধুর নিরাপত্তায় থাকা মহিউদ্দিন বল প্রয়োগ করলে আমরা তীব্র প্রতিবাদ জানাই। তখন তিনি চুপ হয়ে যান।
১৯৭০ সালের সাধারণ নির্বাচনের আগে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে আমার দুইবার দেখা হয়। নির্বাচনের ১৭/১৮ দিন পূর্বে, আব্বা আমাকে একটি চিঠি দিয়ে বঙ্গবন্ধুর কাছে পাঠান। আব্বার নির্বাচনী এলাকা ছিল মাধবপুর, হবিগঞ্জ ও লাখাই। আব্বা ছিলেন জাতীয় পরিষদ সদস্য পদপ্রার্থী। আমি বঙ্গবন্ধুর বাসভবনে (সুরমা মেইলে) চিঠি নিয়ে পৌঁছাই এবং বঙ্গবন্ধুর রেসিডেন্ট পিএ মোহিতুল ইসলাম (বঙ্গবন্ধূ হত্যা মামলার বাদী) এর কাছে দেই। উনি আব্বার চিঠিটি দোতলায় পাঠিয়ে দেন। কিছুক্ষণের মধ্যেই বঙ্গবন্ধু মনিভাইসহ নীচে নেমে আসেন এবং লাইব্রেরির রুমে আমাকেসহ প্রবেশ করেন। আমি কদমবুসি করে দাঁড়াই। আমার পরনে ছিল পাজামা পাঞ্জাবী, বঙ্গবন্ধু আমাকে ৫ হাজার টাকা (৫০০ টাকার নোট) দিয়ে বললেন-আব্বাকে দিতে। একই সময় লক্ষ্য করলেন, আমার পাঞ্জাাবীর বুক পকেট নাই, "বললেন, বাঙ্গাল সব ভদ্রলোক হয়ে গিয়েছে" আমাকে জিজ্ঞেস করলেন টাকা কোথায় রাখব? আমি আমার পায়জামার পকেট দেখালে, উনি হেসে দিলেন। আমাকে সাবধানে যেতে বললেন এবং কয়েক দিন পর আবার আসতে বললেন।
ডিসেম্বর মাসের খুব সম্ভব ৪ তারিখ আব্বাকে না বলেই আবার বঙ্গবন্ধুর বাসায় গেলাম। সুরমা মেইলে ভোরে ৩২ নম্বর সড়কের বাসায় পৌঁছে আহাম্মক হয়ে গেলাম। সুনসান নীরবতা। ভেবে পাচ্ছিলাম না কি করব! শেখ শহীদ ভাই সামনের রুমে থাকতেন, ওনার রুম বন্ধ। বারান্দায় চেয়ারে বসে আছি, এমনি সময় বঙ্গবন্ধুর ধূলি ধূসরিত সাদা টয়োটা গাড়িটি ভিতরে প্রবেশ করল। উনি গাড়ি থেকে নেমে আমাকে দেখে বললেন, ‘তুই এসেছিস, বস। আমি হাত মুখ ধুয়ে আসছি।’ আমি জিজ্ঞাসা করলাম- চাচা, কোথা  থেকে এসেছেন? বললেন- ‘দালালটার ওখান থেকে এসেছি, স্বগোক্তি করলেন, পাশ করে ফেলবে।’ বলে উপরে উঠে গেলেন ।
আমি ড্রাইভার চাচাকে জিজ্ঞেস করলাম, কোথা থেকে এসেছেন। বললেন, নান্দাইল থেকে। নুরুল আমিনের নির্বাচনী এলাকা। আপনারা জানেন, এই দালাল নির্বাচনে জয়ী হয়েছিল। বাংলাদেশের মানুষ সম্পর্কে বঙ্গবন্ধুর ধারণা কেমন ছিল, এই ঘটনার আলোকে একটুখানি ভাবুন। উনি লুঙ্গি পাঞ্জাবী পরে মনিভাইসহ নীচে আসলেন। আমাকে ৩ হাজার টাকা দিলেন, খবর নিলেন সকলের। আমি বিদায় নিয়ে চলে আসলাম।
১৯৭৩ সালের সাধারণ নির্বাচনের ১০/১২ দিন পূর্বে উনার ৩২ নম্বর বাসায় আবারও দেখা হয়। এই বাসায় গিয়ে আমি আহাম্মক হয়ে যাই। স্বাধীনতার পর ওই বাসায় আর যাই নাই। পূর্বে ওই বাসায় আমার প্রবেশ ছিল অবারিত। কিন্তু এবার পুলিশ গেইটে আটকিয়ে দিল। লজ্জায় পড়ে গেলাম সাথে বন্ধু উতুকে নিয়ে যাওয়ায়। তাকে বঙ্গবন্ধুর সাথে দেখা করাতে এনে এখন বাড়িতেই প্রবেশ করতে পারছি না। বঙ্গবন্ধুর বাড়ির সীমানা প্রাচীর বুক সমান উঁচু। প্রাচীরের ভিতরে শেখ মনি, তোফায়েল আহমেদ ও আব্দুর রাজ্জাক দাঁড়িয়ে কথা বলছিলেন। আমি মনি ভাইকে ডাক দিলাম এবং তিনি এগিয়ে এলে, আমি হবিগঞ্জ থেকে এসেছি বললাম আর বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে দেখা করতে হবে বললে উনি বললেন, আজ-কাল-পরশু দেখা করা সম্ভব নয়। মাথা গরম হয়ে গেল, ঠিক আছে  দেখা করতে হবে না। এই চিঠিটি, মোহিতুল ইসলাম সাহেবকে দিয়েন বলে চিঠিটি দিলে, তিনি চিঠি নিয়ে ভিতওে গেলেন আর আমি উতুসহ ঘুরে হাঁটা ধরি। একটুখানি সামনে এসে প্র¯্রাব করতে যাই। পেছন থেকে উতু বলে, এই টিপু তোকে কে যেন ডাকছে। আমি বলি ভূতে, দেখি মনি ভাই দাঁড়িয়ে আছে। উনি বললেন, উত্তর না নিয়ে কোথায় যাচ্ছ? আমি বললাম, আপনিই তো বললেন আগামী তিনদিন দেখা হবে না। এখানে কি করব? উনি হাতে ধওে টেনে বাসার ভেতর নিয়ে গেলেন। উতুকে নীচে বসিয়ে আমাকে নিয়ে দোতলায় উঠে বঙ্গবন্ধুর শোবার ঘরে নিয়ে দাঁড় করিয়ে দিলেন। বঙ্গবন্ধু প্রথম কথাটি জিজ্ঞাসা করলেন, মানিক পাশ করবে? আমি বললাম জ্বী, সামাদ চাচা ফেইল করবে। উনি বললেন, আগামীকাল সেখানে যাব। উনার পরনে ছিল লুঙ্গি ও সাদা ফতোয়া। পালঙ্কে বিছানো ছিল নক্শী কাঁথা। আমাকে ১০ হাজার টাকার একটি বান্ডিল দিলেন আব্বাকে দিতে। আমি চলে আসার কথা। মনি ভাইও দাঁড়িয়ে। আমি উসখুস করছি। বঙ্গবন্ধু জিজ্ঞাসা করলেন, কি চাস ? আমি তখন বললাম, চাচা, আপনাকে নীচে যেতে হবে। আবার প্রশ্ন, কেন? আমি উতুর সম্পর্কে সব জানালে, উনি আবার জিজ্ঞাসা করলেন, যেতেই হবে? আমি মাথা নাড়ি। উনি উপরে উঠে এলে, রাতে সাধারণত আর নীচে নামতেন না। আমি মহকুমা আওয়ামী লীগের উনার এক সহকর্মীর ছেলে, আমার সম্মানে, উনি পাঞ্জাবী গায়ে দিয়ে আমি আর মনি ভাইকে নিয়ে নীচে রওয়ানা হলেন। সিঁড়িতে মনি ভাইকে বললেন, ‘ওকে চিনে রাখিস। ও মুক্তিযুদ্ধ করেছে।
ওই সিঁড়িতে আজো আমি আর পা রাখিনি! পরে অনেক বার গিয়েছি, আপার (শেখ হাসিনা) সাথে দেখা হয়েছে। কিন্তু, সিঁড়ি ঘরে আর পা রাখিনি।
 নীচে নামার পর, সাড়া পওে গেল। উতু সালাম জানাল। উনি মন দিয়ে লেখাপড়ার বিষয়ে বললেন। হঠাৎ আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, কোথায় উঠেছি। আব্বার এমপি হোস্টেলের রুমে বলার পর, আবার প্রশ্ন, কিভাবে যাবি ? বললাম  রিক্সায়। হুংকার দিয়ে বলেন, মাথা খারাপ হয়েছে। তারপর মনি ভাইকে বললেন, গাড়ীতে করে এমপি হোস্টেলে পৌঁছে দিতে। এই ছিলেন- আমার নেতা, বাঙ্গালী জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। বীরের মতো সকলের সামনে কদমবুসি করে চলে আসলাম।
১৯৭৩ সালের এপ্রিল মাসের শেষ দিকে প্রবল বর্ষণে এবং উজানের বন্যার পানির প্রবল চাপে খোয়াই নদীর শায়েস্তাগঞ্জে কলিমনগরে ভাঙ্গনের সৃষ্টি হয়। যুদ্ধ বিধ্বস্ত দেশে বানভাসি মানুষের অসহায় অবস্থা স্বচক্ষে দেখার জন্য বঙ্গবন্ধু ১২ মে, সকালের দিকে রাশিয়ান হেলিকপ্টারে হবিগঞ্জের নিউ ফিল্ডে অবতরণ করেন। হাজার-হাজার মানুষ রেললাইনের ওপর দাঁড়িয়ে বঙ্গবন্ধুকে একনজর দেখার জন্য, কিংবা উনি কিছু বলেন কি-না তার জন্য অপেক্ষায় ছিলেন। কিন্তু তিনি কারও কোন কথা না শুনেই দূর্গত এলাকায় যাওয়ার জন্য হাটা শুরু করেন। আমি তখন পথ আটকিয়ে বলি- ‘অন্তত দুটি কথা বলে যান। উনি বললেন ‘তুই বলে দে।’ জবান উল্লাহ চাচা তখন বললেন, ‘সাব, একটু ডাবের পানি খেয়ে রওয়ানা হন’ তখন দাঁড়ালেন। জবান চাচার হাতে ডাবের পানি খেয়ে মাইকে সালাম জানিয়ে বললেন, ‘আপনারা দোয়া করবেন, যেন এই দূর্যোগ আমরা কাটিয়ে উঠতে পারি।’ উনি গাড়িতে উঠে ঈদগাহ পর্যন্ত গিয়ে গাড়ি থেকে নেমে কিছুদূর হেঁটে দেখে ঘুরে এসে গাড়িতে করে নিউফিল্ডে চলে আসেন। সকলের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে,  হেলিকপ্টারে চড়ে সিলেটের উপদ্রুত এলাকা দেখার জন্য চলে যান। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের, এটিই শেষ হবিগঞ্জ সফর !
১৯৭৫ সালের ১২ আগস্ট মাগরিবের পর আবারও বঙ্গবন্ধুর সাথে দেখা করি গণভবনে। আমি কদমবুসি করে দাঁড়াতে না দাঁড়াতেই, নিম্বর চাচা সেখানে পৌঁছান। মানিক চৌধুরী ছাড়া অন্য কাউকে পেলেন না বলতেই, বঙ্গবন্ধু বললেন- ‘নিম্বর, নো হাঙ্কিপাঙ্কি। কোন কথা শুনব না। ৬ মাস পর আসবা।’ আমাকে জিজ্ঞেস করলেন- তোর বয়স কত? আমি বললাম-২৪ বছর ৬ মাস। আমি বঙ্গবন্ধুকে বললাম, আমি জাতীয় যুবলীগের সম্পাদক হব। বঙ্গবন্ধু বললেন, আমি মনিকে (শেখ মনি ভাই ) বলে দিব, তুই সকালে ওর সাথে  দেখা করবি, জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সাথে সেই আমার জীবনের শেষ দেখা।
 

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়