বাসস
  ২৫ সেপ্টেম্বর ২০২১, ১৫:৩৩

চকরিয়ার চমক: হাতের নাগালে নাগরিক সেবা

॥ আবু তাহের ॥
কক্সবাজার, ২৫ সেপ্টেম্বর, ২০২১ (বাসস): কক্সবাজারের চকরিয়া উপজেলার এক প্রত্যন্ত জনপদ বদরখালী। দুর্গম এই এলাকায় চিকিৎসা ব্যবস্থা অপ্রতুল। বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের সুবিধা পাওয়া ছিল অকল্পনীয়। কিন্তু ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ’ এই কল্পনাকে দিয়েছে বাস্তব রূপ। করোনা সংকটে এলাকাবাসী পাচ্ছে টেলিমেডিসিন সেবা। পরামর্শ নিচ্ছে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের । 
বদলে যাওয়ার প্রকৃত চিত্র ফুটে উঠলো বদরখালীর ৩ নং ব্লকের বাসিন্দা আহমদুর রহমানের কথায়। তিনি বলেন, ‘স্ত্রী-পুত্র-কন্যাসহ পরিবারের ৫ সদস্য গত মে মাসে করোনা আক্রান্ত হয়। উপজেলা বা জেলা সদরে গিয়ে চিকিৎসা নেয়া আমাদের সামর্থের বাইরে ছিলো। প্রতিবেশী একজনের পরামর্শে ৩৩৩ নম্বরে ফোন করি। মোবাইলে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের পরামর্শ নিয়ে বাড়িতেই অবস্থান করি। এই চিকিৎসা সুবিধা পেয়ে পরিবারের সবাই এখন পুরোপুরি সুস্থ।’ 
পেশায় কৃষক আহমদুর রহমান বলেন, ‘আমরা কোন দিন চিন্তাও করি নাই। বাড়িতে বসে মোবাইলে বিশেষজ্ঞ ডাক্তারের পরামর্শ পাওয়া যায়। পরিবারের ভয়াবহ দুঃসময়ে সেই সুবিধা পেয়েছি। দোয়া করি শেখ হাসিনার সরকারের জন্য।’
বদরখালীর এক সমাজকর্মী নুর হাবিব তসলীম বলেন, করোনার ভয়াবহ এই দুঃসময়ে এলাকার অনেকে টেলিমেডিসিন সেবা নিয়েছে। মোবাইলে বিশেষজ্ঞ ডাক্তারের পরামর্শ পেয়েছেন। সরকারের যুগান্তকারি এই পদক্ষেপ মানুষকে ঘরে বসেই চিকিৎসা সেবা দিচ্ছে। 
শুধু তো টেলিমেডিসিন নয়, ডিজিটাল বাংলাদেশ এর সুবিধা সেবাতো বহুমাত্রিক। হেফাজ মোর্সেদ এর কথাই ধরা যাক। 
উপজেলার ডুলাহাজারা ইউনিয়নের হেফাজ মোর্সেদ বেসরকারি একটি প্রতিষ্ঠানে চাকুরি করতেন। করোনা পরিস্থিতিতে চাকুরি হারিয়ে তিনি বাড়ি চলে আসেন। কিন্তু সরকারের ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ’ তাকে নতুন করে আশার আলো দেখিয়েছে। বাড়িতে বসেই হেফাজ শুরু করেছেন অনলাইনে পণ্য বেচা কেনার ব্যবসা। শুঁটকি, আচার, সবজী বিক্রি করে তিনি এখন বেশ স্বাবলম্বি। 
হেফাজ মোর্সেদ বলেন, ‘করোনা পরিস্থিতিতে ঘরে বসে হতাশ হয়ে পড়েছিলাম। এক বন্ধুর পরামর্শে শুরু করি অনলাইনে পণ্য বেচা কেনা। প্রথমে শুঁটকি ও আচার দিয়ে শুরু। এরপর এখন সবজীও সরবরাহ করছি। ঢাকা, চট্টগ্রামসহ বিভিন্ন স্থানে পণ্য পাঠাচ্ছি।’ 
হেফাজ জানান, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়েও পণ্য সরবরাহ করেছেন তিনি। তার সাফল্য দেখে চকরিয়ায় আরো অনেকে অনলাইন পণ্য বেচা কেনার ব্যবসায় যুক্ত হয়েছেন বলে জানান হেফাজ মোর্সেদ। 
চকরিয়া উপজেলা সদরে ডিজিটাল সেন্টারের তরুন উদ্যোক্তা এরশাদুল হক। তার সেন্টার থেকে প্রশিক্ষণ নিয়ে শতাধিক তরুন এখন অনলাইন মার্কেটিং, ফ্রি ল্যান্সিং, আউট সোর্সিং- এর সফল উদ্যোক্তা। ঘরে বসেই প্রতিমাসে ৫০ হাজার থেকে ৮০ হাজার টাকা আয় করছেন এই উদ্যোক্তারা। এরশাদুল হক বলেন, এটুআই এর সহযোগিতায় বাস্তবায়িত ডিজিটাল সেবা মানুষকে বদলে দিয়েছে। ঘরে বসেই নানা সুবিধা ভোগ করছে। 
এরশাদুল হকের ডিজিটাল সেন্টারে প্রতিদিন দুই শতাধিক মানুষ নানা ধরনের সেবা নিতে আসেন। তিনি জানান, ই-ব্যাংকিং, পাসপোর্ট ফরম পুরণ, ই-নামজারি, জন্ম নিবন্ধন, এনআইডি ফরম পুরণ, বিধবা ভাতা, বয়স্ক ভাতা নিবন্ধন, চাকুরির আবেদন, সরকারি বেসরকারি বিভিন্ন ফি, কর প্রদান, পরীক্ষার রেজিষ্ট্রেশন থেকে শুরু করে বহু সেবা তারা দিচ্ছেন ডিজিটাল সেন্টার থেকে। 
চকরিয়ার প্রত্যন্ত একটি ইউনিয়ন কাকারা। এই ইউনিয়নের ডিজিটাল সেন্টারের উদ্যোক্তা সাদিয়া কাউছার খানম। ডিজিটাল সেন্টারের মাধ্যমে গ্রামের জনগণকে অনলাইন সেবা দিয়ে জাতীয় পুরস্কার পেয়েছেন তরুণ এই নারী উদ্যোক্তা। তিনি বলেন, বিধবা ভাতা, বয়স্ক ভাতাসহ সরকারি ও বেসরকারি বিভিন্ন সেবা পেতে গ্রামের শিক্ষিত অশিক্ষিত লোকজনকে আগে থানা ও জেলা সদরে দৌড়াতে হতো। এখন দিন বদলেছে। ঘরে বসে অথবা গ্রামের ডিজিটাল সেন্টারে বসেই মানুষ সেই সেবা পাচ্ছেন। মানুষ দ্রুত বদলে যাচ্ছে। আধুনিক কলা কৌশল ও ডিজিটাল সুবিধায় অভ্যস্ত হচ্ছে। 
তরুণ এই নারী উদ্যোক্তা বলেন, ‘প্রত্যন্ত গ্রামে বসে ৭০/৮০ হাজার টাকা আয় করতে পারব স্বপ্নেও ভাবিনি। তিনি বলেন, “শিক্ষিত বেকার তরুণদের কাছে আমার বার্তা হচ্ছে, চাকুরির পেছনে না ছুটে নিজেকে উদ্যোক্তা হিসাবে গড়ে তুলুন। বাংলা ভাষার সর্ববৃহৎ ই-শিক্ষা প্ল্যাটফর্ম মুক্তপাঠ সেই প্রশিক্ষণ সুবিধা দিচ্ছে। এছাড়াও একশপ, দক্ষতা উন্নয়ন প্রকল্প বা আইডিয়া ব্যাংকের সুবিধা নিতে পারেন তরুন উদ্যোক্তারা।”
চকরিয়া উপজেলার পশ্চিম বড় ভেওলা ইউনিয়নের চেয়ারম্যান সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী বাবলা বলেন, ডিজিটাল সেবা দরিদ্র জনগোষ্ঠিকে অনেক সুবিধা দিচ্ছে। বিধবা ভাতা, বয়স্ক ভাতার জন্য এখন কাউকে ধর্না দিতে হয় না। ডিজিটাল সেন্টারে গিয়ে অথবা ঘরে বসে মোবাইলের সাহায্যে এই সুবিধা গ্রহণ করা যাচ্ছে। । 
চকরিয়া উপজেলার সহকারি কমিশনার ভূমি মোঃ তানভীর হোসেন বলেন, ই-নামজারির শতভাগ কাজই এখন এই অফিসে সম্পন্ন হচ্ছে। লোকজন ঘরে বসে অথবা নিজের এলাকায় ডিজিটাল সেন্টারে গিয়ে নামজারীর আবেদন করতে পারছে। তাদের দাখিলকৃত কাগজ যাচাই করে সর্বোচ্চ এক মাস অথবা আরো কম সময়ের মধ্যে ই-নামজারী করা হচ্ছে। তিনি জানান, কোন ক্ষেত্রে কাগজপত্রে গড়মিল পরিলক্ষিত হলে সেবা প্রত্যাশীকে সাক্ষাতকারে ডেকে তা সম্পন্ন করা হয়। 
তিনি জানান, এক বছর সময়ের মধ্যে উপজেলায় ১৪ হাজার ই-নামজারী সম্পন্ন করা হয়েছে। 
চকরিয়া উপজেলা নির্বাহী অফিসার সৈয়দ শামসুল তাবরীজ জানান, প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ উদ্যোগ ডিজিটাল বাংলাদেশ প্রকল্পের সাফল্য কাঙ্খিত লক্ষ্যকে ছাড়িয়ে গেছে। জনগণের জীবনমানের অসাধারণ উন্নয়ন হয়েছে। এটুআইয়ের বিভিন্ন উদ্যোগের ফলে গ্রামের সাধারণ মানুষও প্রযুক্তির সুবিধা গ্রহণ করছে। তাদের কর্মসংস্থান হচ্ছে। সরকারি দফতরগুলোতেও কাজের গতি বেড়েছে। অনৈতিক সুবিধা আদায় ও হয়রানী বন্ধ হচ্ছে। করোনা পরিস্থিতিতে উপজেলার সকল অফিসে প্রচলিত ফাইল ব্যবস্থাপনার পরিবর্তে ই-নথি বা ইলেকট্রনিক পদ্ধতির অফিস ব্যবস্থাপনার উপর গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। এতে লকডাউনেও অফিসের কাজে ব্যাঘাত ঘটেনি। অনলাইনে মানসম্পন্ন সেবা দেয়া সম্ভব হচ্ছে। 
তিনি জানান, জাতীয় হেল্পলাইন ৩৩৩ থেকে সংবাদ পেয়ে অনেক ব্যাক্তিকে দুর্যোগকালিন ত্রাণ দেয়া হয়েছে। উপজেলার প্রত্যন্ত এলাকার অসুস্থ রোগীদের ওষুধ ও টেলিমেডিসিন সুবিধা দেয়া সম্ভব হচ্ছে। এভাবেই করোনা মোকাবেলায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে ডিজিটাল বাংলাদেশ। 
ইউএনও জানান, উপজেলায় ইতিমধ্যে দুই শতাধিক নারী উদ্যোক্তা তৈরি হয়েছে। তাদের অনেকেই এখন সফল উদ্যোক্তা। এছাড়া আরো অনেক ক্ষেত্রে ডিজিটাল প্লাটফর্মে সাফল্যজনক ভাবে এগিয়ে গেছে চকরিয়া উপজেলা। 

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়