বাসস
  ২৩ সেপ্টেম্বর ২০২১, ১৩:০৪

তৃণমূলের নারী উদ্যোক্তা শরিফা এখন অন্যদের আদর্শ

ঢাকা, ২৩ সেপ্টেম্বর, ২০২১ (বাসস) : বাবার ঘরেও জীবনটা ছিলো দুর্বিসহ। একবেলা খাবার জুটতোতো অন্য বেলা উপোস। বিয়ের পর স্বামীর ঘরেও যে অবস্থার উন্নয়ন ঘটেছিলো তা নয়। অভাব-অনটন লেগেই ছিলো। এ অবস্থায় কিছু করার পথ খুঁজছিলেন শরিফা বেগম। একদিন তার মামা শরিফাকে ভেড়া পালনের পরামর্শ দেন।  
সেই থেকে শুরু। এখন শরিফার বাড়িতে ভেড়ার খামার। গত ১২ বছরে আয় করেছেন প্রায় ৮ লাখ টাকা। নিজের ভাগ্য বদল করে তিনি এখন গ্রামের অন্য নারীদেরও আদর্শ।
শরিফার গ্রামের বাড়ি রংপুর জেলার তারাগঞ্জ উপজেলার ইকরচালী ইউনিয়নের লক্ষ্মীপুর গ্রামে। উপজেলা সদর থেকে এ গ্রামের দূরত্ব মাইল-ছয়েক। স্থানীয় লোকজন জানিয়েছেন, শরিফার দেখাদেখি তার নিজ গ্রামসহ আশপাশের তিনটি গ্রাম মিলিয়ে প্রায় ৫০০ নারী এখন ভেড়া পালন করছেন। শরিফার মতো তাদের বাড়িতেও এখন ভেড়ার খামার।
এই প্রতিবেদককে দেখে বসার চেয়ার এগিয়ে দিয়ে শরিফা গেলেন পান-সুপোরি আনতে। তার পিছু নিল চারটি ভেড়ার ছানাও। বললেন, এই  প্রাণীদের নিয়েই তার দিনাতিপাত।
শুরুর দিনগুলোর কথা জিজ্ঞেস করলে যেন গলা ধরে আসে চল্লিশোর্ধ্ব শরিফার। কেননা ওই দিনগুলো ছিলে কষ্টের, অভাবের। কিন্তু এখন তিনি স্বচ্ছল। নিজের চেষ্টায় ভাগ্য ফিরিয়েছেন।
বললেন, ১৯৯৭ সালে বিয়ে হয়ে যায়। কিন্তু স্বামীর বাড়িতেও প্রায়ই অনাহারে থাকতে হতো। স্বামীও সেভাবে কিছু করতে পারছিলেন না। এর মাঝে ২০০৯ সালের জানুয়ারিতে তার বাড়িতে বেড়াতে আসেন মামা মনতাজুর রহমান।
শরিফার কিছু করার ইচ্ছার কথা শুনে তিনিই ভেড়া পালনের পরামর্শ দেন। এ অবস্থায় শরিফা তার মা অলিম বেগমের গয়না বিক্রির দুই হাজার টাকায় দুটি ভেড়া কিনে পালন শুরু করেন। বছর না ঘুরতেই ভেড়া দু’টি তিন দফায় ১২টি বাচ্চা দেয়। তা বিক্রি করে আয় হয় ১২ হাজার টাকা।
চলতি বছর ৩৬টি ভেড়া বিক্রি করে দুই লাখ টাকা আয় হয়েছে বলে জানালেন শরিফা বেগম। সমাজে পরিবর্তনের বার্তা দেয়া তৃণমূলের এই নারী উদ্যোক্তা জানান, বর্তমানে তার খামারে ৪০টি ভেড়া আছে। লাভের টাকায় খড়ের ঘরের জায়গায় টিনের ঘর করেছেন। কিনেছেন আবাদি জমি।
বাড়ির চারপাশে আম, জাম ও কাঁঠালের গাছ লাগিয়েছেন। সারাবছরই পেঁপেসহ নানা ধরনের মৌসুমী শাক-সবজি আবাদ করেন বাড়ির আঙিনায়। দুই ছেলে- মেয়ে পড়াশোনা করছে।
শরিফার ভাষায়, ‘একসময় খুব কষ্ট আছল। এখন ভালোভাবে চলবার পারছি।  ভেড়া পুষি হামার ভালোয় উন্নতি হইছে।’
এদিকে শরিফার ভাগ্যের পরিবর্তন দেখে প্রতিবেশী নারীরাও ভেড়া পালনে আগ্রহী হয়ে ওঠেন। শরিফা তাদের ভেড়া পালনের পরামর্শও দেন। ধীরে-ধীরে ইকরচালী ইউনিয়নের লক্ষ্মীপুর মুলপাড়া, দোহাজারী, বিড়াবাড়ি গ্রামের প্রায় ৫০০ নারী ভেড়া পালনের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন। এখন এসব নারী স্বাবলম্বী। সংসারের নানা দুঃসময়ে অবদান রাখেন অর্থ দিয়ে।
শরিফার প্রতিবেশী খোদেজা বেগম, এখন তারও ১৫টি ভেড়া রয়েছে। বললেন, শরিফা বু’র (বুবু) কাছে ভেড়া পালন শিখে নিছি। এখন আমার খামারে বড় ও ছোট মিলিয়ে ১৫টি ভেড়া রয়েছে। গেল কোরবানি ঈদে ৫৫ হাজার টাকার ভেড়া বিক্রি করেছি।  
দোহাজারী গ্রামের রাহেলা খাতুন বললেন, ‘শরিফা ভাবির কাছোত হামরা  ট্রেইনিং নিছি, কেমন করি ভেড়ার যতœœনিবার নাগে। শরিফার জন্যে হামার এই গ্রামোত উন্নতি হইছে।’
লক্ষ্মীপুর গ্রামের আবদুল হাই-এর স্ত্রী বানেছা খাতুন শুরু করেছিলেন একটি ভেড়া দিয়ে। এখন তার খামারে ২০টি ভেড়া, দু’টি গাভি ও দেড়শ’ হাঁস-মুরগি আছে। ৩৩ শতক জমিও কিনেছেন।
আরেক গৃহবধূ ফুলবী খাতুন ভেড়ার খামার করে সে আয়ের টাকায় স্বামীকে মুদি দোকান করে দিয়েছেন। কিনেছেন ১৮ শতক জমি। বর্তমানে তার খামারে ১৮টি ভেড়া আছে।
এভাবে নিজের গ্রাম তো বটেই, পাশের অন্যান্য গ্রামেও ছড়িয়ে পড়েছে শরিফার ভেড়া পালনের সাফল্যের গল্প।
এ বিষয়ে ইকরচালী ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান রফিকুল ইসলাম এই প্রতিবেদককে বলেন, লক্ষ্মীপুর গ্রামের মানুষের কষ্টের শেষ ছিল না। কিন্তু সেই জায়গা থেকে শরিফার দেখাদেখি অনেকেই ভেড়ার খামার করে আর্থিক অবস্থার উন্নতি করেছেন। এখন  এই গ্রামের ৭০ শতাংশ নারী স্বাবলম্বী।
তারাগাছ উপজেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা ফরহাদ নোমান বলেন, উপজেলার মধ্যে সবচেয়ে বেশি ভেড়া পালন করা হচ্ছে লক্ষ্মীপুর গ্রামে। এতে স্থানীয় চাহিদা মেটানোর পাশাপাশি দেশের অন্যান্য এলাকায়ও পাইকাররা তা বিক্রি করছেন।  
ভেড়া পালনের বিষয়ে প্রাণিসম্পদ বিভাগের পক্ষ থেকে স্থানীয়দের নানা ধরনের পরামর্শ দেয়া হচ্ছে বলে জানান তিনি।

 

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়