শিশুর চিকিৎসায় যথেচ্ছা অ্যান্টিবায়োটিকের ব্যবহার : বিপন্ন শিশু স্বাস্থ্য

1301

॥ এমরানা আহমেদ ॥
ঢাকা, ৩০ জানুয়ারি, ২০১৯ (বাসস) : রাজধানীর গোড়ান এলাকার বাসিন্দা হাসিবুল করিম। তার ৭ বছর বয়সী মেয়ে রোদেলা প্রায়ই সর্দি, কাশিজনিত সমস্যায় ভোগেন। এই সর্দি, কাশি মাত্রাতিরিক্ত বেড়ে গেলে তার শিশুটির জ্বর চলে আসে। থাকে ৪ থেকে ৫ দিন পর্যন্ত। তখন বাধ্য হয়েই চিকিৎসকের শরণাপন্ন হতে হন তাকে। চিকিৎসক জ্বরের সাধারণ ওষুধ নাপার পাশাপাশি ৫ থেকে ৭ দিনের কোর্স সম্বলিত অ্যান্টিবায়োটিক ওষুধ সেবনের জন্য লিখেন। তিনি এই প্রতিবেদকের সঙ্গে আলাপচারিতায় জানালেন, ‘বাচ্চারা এমনিতেই ওষুধ খেতে চায় না, তার উপর ৫-৭ দিনের কোর্স সম্বলিত অ্যান্টিবায়োটিক ওষুধ শিশুদের খাওয়ানো খুব কঠিন ব্যাপার। বেশি জোর করতে গেলেই অতিরিক্ত কান্নাকাটি শুরু করে দেয়। তখন ১/২ বেলা অ্যান্টিবায়োটিকটি খাওয়ানো বাদ পড়ে যায়। তাতে রোগ ভালো না হয়ে, তার শিশুর স্বাস্থ্যকে ক্ষতিগ্রস্ত করছে বলে মনে করছেন হাসিবুল করিম ।
জীবাণু সংক্রমণ চিকিৎসায় অত্যন্ত কার্যকরি ওষুধ অ্যান্টিবায়োটিক। তবে মাত্রাতিরিক্ত ব্যবহারে মানবদেহে কার্যকারিতা হারাচ্ছে তা। আইসিডিডিআরবি’র গবেষণা বলছে, চিকিৎসকের প্রেসক্রিপশন ছাড়া অ্যান্টিবায়োটিক কেনা ও সেবন বাড়ছে। আবার একটু সুস্থবোধ করার পরই তা বন্ধ করে দেন অনেকে। গবেষকদের শঙ্কা, এ অবস্থা চলতে থাকলে, কোনো এক সময় অ্যান্টিবায়োটিক আর কাজেই দেবে না। মানব শরীরে অপরিমিত অ্যান্টিবায়োটিক প্রবেশের ফলে মানুষের কিডনি, লিভারসহ বিভিন্ন অঙ্গ ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে, ক্রমে কার্যক্ষমতাও হারাচ্ছে মানুষ। ফলে বেশি করে মানুষ রোগাক্রান্ত হচ্ছে। এক্ষেত্রে শিশুরা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে সবচেয়ে বেশি।
বাংলাদেশে অ্যান্টিবায়োটিক বিষয়ে জাতীয় ভিত্তিক কোনো পরিসংখ্যান নেই। বিএসএমএমইউ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ অন্য যেসব প্রতিষ্ঠান বিচ্ছিন্নভাবে যেসব জরিপ ও গবেষণা করেছে তার ভিত্তিতে বিশেষজ্ঞরা বলছেন পরিস্থিতি ভয়াবহ।
দেশে অ্যান্টিবায়োটিকের যথেচ্ছা ব্যবহার সবচেয়ে বেশি হচ্ছে শিশুদের নিউমোনিয়ার চিকিৎসায়। এ প্রবণতা কোন দিকে, তা জানতে ঢাকার একটি বেসরকারি শিশু হাসপাতালে নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত পাঁচ বছরের কম বয়সী ৮০টি শিশুর ওপর গবেষণাটি পরিচালনা করেন গবেষকরা। গবেষণার আওতাধীন ২৮টি শিশু ছিল কম ওজনের। ১৪টি শিশুর ওজন স্বাভাবিকের তুলনায় কম। আর ১৩টি শিশুর ওজন ভয়াবহ রকমের কম। ডব্লিউএইচওর শ্রেণি বিন্যাস অনুযায়ী, ৪৩টি শিশুর নিউমোনিয়ার মাত্রা ছিল গুরুতর। বাকি ৩৭টি শিশু খুবই গুরুতর মাত্রায় নিউমোনিয়ায় ভুগছিল।
বাংলাদেশে শিশুদের চিকিৎসায় এ নীতিমালার কতটা চিকিৎসকরা অনুসরণ করছেন, তা জানতে একটি গবেষণা পরিচালনা করে আইসিডিডিআর,বি, ব্র্যাক ও শহীদ তাজউদ্দীন আহমদ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের একদল গবেষক। গবেষণার ফলাফলে দেখা যায়, নিউমোনিয়ার ধরন বিভাজন না করেই চিকিৎসকরা আক্রান্ত সব শিশুকেই একই মাত্রার অ্যান্টিবায়োটিক দিচ্ছেন। এমনকি রক্তসহ প্রয়োজনীয় অন্যান্য পরীক্ষা না করেও আক্রান্ত শিশুর ব্যবস্থাপত্রে উচ্চমাত্রার অ্যান্টিবায়োটিক লিখছেন তারা।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা সম্প্রতি একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। প্রতিবেদনে এই আশঙ্কা প্রকাশ করে বলা হয়েছে, অ্যান্টিবায়োটিকের যথেচ্ছা ব্যবহারে জীবাণু ওষুধ প্রতিরোধী হয়ে উঠছে। এতে অচিরেই খুব সাধারণ সংক্রমণ, সামান্য কাটাছেঁড়া থেকে মৃত্যু হবে মানুষের। বিশ্বের ১১৪টি দেশ থেকে তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা প্রতিবেদনটি প্রকাশ করে। প্রতিবেদনে ‘অ্যান্টিবায়োটিক-পরবর্তী যুগ’ বলে একটি কথা ব্যবহার করা হয়েছে। বলা হয়েছে, খুব দ্রুত যদি এ ব্যাপারে ‘তাৎপর্যপূর্ণ’ উদ্যোগ না নেয়া হয়, তাহলে বিপর্যয় এড়ানো অসম্ভব হয়ে উঠবে।
ঢাকা মেডিকেল কলেজের শিশুরোগ বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক মো. আবিদ হোসেন মোল্লা জানান, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার বিধিতে বলা আছে, পাঁচ বছরের কম বয়সী শিশুর নিউমোনিয়া নিরাময়ে অ্যাজিথ্রোমাইসিন ব্যবহার করা যাবে না। তিনি আরো জানান, শিশু ও মহিলাদের ওষুধ প্রয়োগের সময় আমরা ভুলে যাই, শিশুদের বাড়ন্ত শরীরের অঙ্গপ্রত্যঙ্গ এবং বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ প্রক্রিয়াগুলো আকার ও কর্মক্ষমতার দিকে থেকে পরিপূর্ণতা লাভ করে না বলে ওষুধের বিপদ ও পার্শ্ব প্রতিক্রিয়ার কারণে শিশুরা বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলছে, ব্যাকটেরিয়া, ভাইরাস, ছত্রাক ও ক্ষুদ্র পরজীবী ওষুধের ক্রিয়ার প্রতিরোধ গড়ে টিকে থাকতে চায়। মানসম্পন্ন অ্যান্টিবায়োটিক না হলে, অ্যান্টিবায়োটিকের মাত্রা সঠিক না হলে, সেবনের মেয়াদ পূর্ণ না হলে জীবাণুগুলো প্রতিরোধ গড়ে তুলতে সক্ষম হয়। একসময় অ্যান্টিবায়োটিকে ওই জীবাণু আর মরে না। জীবাণু অ্যান্টিবায়োটিক-প্রতিরোধী হয়ে দাঁড়ায়।
রোগের শুরুতে উচ্চমাত্রার অ্যান্টিবায়োটিক দেয়া গুরুংতর অপরাধ বলে মন্তব্য করেন শিশুরোগ বিশেষজ্ঞ স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ মিটফোর্ড হাসপাতালের সহকারী অধ্যাপক ডা. মো. আবদুল মান্নান। তিনি বলেন, এসব অ্যান্টিবায়োটিকে রোগী সুস্থ না হলে দ্বিতীয় কোনো ওষুধ কাজে আসবে না।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে পৃথিবীর অনেক দেশে অ্যান্টিবায়োটিকের অপব্যবহার হচ্ছে এবং তা গুরুতর স্বাস্থ্য সমস্যা হিসেবেও দেখা দিয়েছে। সংস্থার মতে, অ্যান্টিবায়োটিকের প্রতিরোধ সমস্যা নিয়ে সচেতনতা বাড়াতে হবে; প্রতিরোধের তথ্য সংগ্রহের জন্য নজরদারি বাড়াতে হবে এবং উন্নয়নশীল দেশে অ্যান্টিবায়োটিক প্রতিরোধ সমস্যা হ্রাস করার কাজে সম্পদ বাড়াতে হবে।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার হিসাব মতে অ্যান্টিবায়োটিক রেজিস্ট্যান্সের কারণে প্রতিবছর বিশ্বে সাত লাখ মানুষের মৃত্যু হয়। ২০৫০ সাল নাগাদ তা ১০ লাখে পৌঁছাবে।
যে অ্যান্টিবায়োটিক এক সময় বহু মানুষের জীবন রক্ষাকারী ওষুধ হিসেবে কাজ করত, তা এখন আর শরীরে সেভাবে কাজ করছে না। জীবন রক্ষাকারী মোক্ষম ওষুধের অভাবে জীবন হয়ে পড়ছে আরও ঝুঁকিপূর্ণ। সে জন্যই অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহারে সতর্কতা খুব জরুরি।