জয়পুরহাট মুক্ত দিবস ১৪ ডিসেম্বর

2878

জয়পুরহাট, ১১ ডিসেম্বর, ২০১৮(বাসস) : জয়পুরহাট হানাদার মুক্ত হয় ১৪ ডিসেম্বর। পুরো নয় মাস ধরে এ জেলায় হত্যাযজ্ঞ ও নির্যাতন চালায় পাক-সেনারা। জয়পুরহাটে মুসলিম লীগ ও জামায়াতের প্রভাব বেশি থাকায় পাক-সেনারা তাদের সহযোগিতায় অগ্নি সংযোগ, ধর্ষণ, খুন, লুটপাট চালায়। এ থেকে রক্ষা পায়নি মসজিদের মুসল্লি, মুয়াজ্জিনের ষোড়শী কন্যা, তাঁতী, কামার, কুমার।
২৫ এপ্রিল ’৭১ জয়পুরহাটের চিনিকলে প্রথম ক্যাম্প স্থাপনের মধ্য দিয়ে পাক-সেনারা মানুষ নিধন শুরু করে। এরপর জয়পুরহাট কলেজ ও খনজনপুরে ক্যাম্প স্থাপন করে। ২৬ এপ্রিল পূর্ব বাজারের দর্জি নাজির হোসেন ও আব্দুস সালাম নামে দু’জনকে হত্যা করা হয়। এসময় বাজার গলির রাম কুমার খেতান ভারতে পালিয়ে যাওয়ার জন্য বের হলে তাকেও গুলি করে হত্যা করা হয়।
পরের দিন পাক-সেনারা গারিয়াকান্ত এলাকা থেকে ৩৬ জনকে ধরে সেখানেই তাদের দিয়ে গর্ত করে নিয়ে লাইন করে গুলি চালায়। মুক্তিযোদ্ধার প্রশিক্ষণ গ্রহণ করা ও মুক্তিযোদ্ধাদের খাবার সরবরাহ করার অপরাধে পাঁচুরচক এলাকার লুৎফর রহমানকে ধরে এনে কয়লা ইঞ্জিনের ভেতর ঢুকিয়ে দিয়ে পুড়িয়ে হত্যা করা হয়। এসবের প্রত্যক্ষদর্শী মুক্তিযোদ্ধা আমজাদ হোসেন (ইউনিট কমান্ডার) আরও বলেন, পাক-সেনাদের দিক নির্দেশনা দানকারী হিসেবে শান্তি কমিটির চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালনকারী আব্দুল আলীমের বাড়ি ঘেরাও করে মুক্তিযোদ্ধারা। খবর পেয়ে মুসলিম লীগ ও জামায়াতের নেতা-কর্মীসহ তাদের গঠিত রাজাকার ও আলবদর বাহিনীর সদস্যরা মুক্তিযোদ্ধাদের ওপর হামলা চালিয়ে আব্দুল আলীমকে ছিনিয়ে নিয়ে যায়।
৩০ এপ্রিল বম্বু ইউনিয়নের কড়ই-কাদিপুর গ্রামের ৩৭১ জন কামার-কুমার সম্প্রদায়ের লোকজনকে সারিবদ্ধ করে হত্যা হরা হয়। স্বজন হারানোর বেদনা বুকে নিয়ে সেই সময়ের স্মৃতি বর্ণনা করতে গিয়ে কেঁদে ফেলেন ওই এলাকার শহীদ সন্তান ভগিরত চন্দ্র বর্মন ও যোগেন পাল। তারা ওই নির্মম হত্যাকান্ড থেকে বেঁচে যান। শহরের বুলুপাড়া (বামনকুন্ডা) এলাকায় জ্বালিয়ে দেয়া হয় হিন্দুদের ঘর বাড়ি। এখানে মাঠের মধ্যে ১১ জনকে লাইন করে গুলি করে হত্যা করার দৃশ্য বর্ননা করতে গিয়ে চোখের পানি ধরে রাখতে পারেননি এ ঘটনায় সৌভাগ্যক্রমে বেঁচে যাওয়া আবু তাহের ও শহীদ জায়া জমিরন বিবি। ডান পায়ের উরুতে গুলি লাগার সেই চিহ্ন আজও বহন করছেন আবু তাহের। মে মাসের প্রথম দিকে আওয়াম লীগ নেতা ও মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক দেবীপুরের ডা: আবুল কাশেম সহ আলেফ উদ্দিন ও আলতাফ হোসেনকে ধরে হত্যা করা হয়। এ সময় বগুড়া থেকে আসা ৫ মুক্তিযোদ্ধাকে (ভারতে যাবার পথে) কোমরগ্রাম এলাকার জামায়াত নেতা আফজাল আকন্দের (বর্তমানে মৃত) নেতৃত্বে শান্তি কমিটির সদস্যরা ধরে পাক-বাহিনীর হাতে তুলে দিলে তাদের নির্মমভাবে হত্যা করা হয়।
পাক-সেনারা মাদারগঞ্জ মসজিদের মুয়াজ্জিনের ষোড়শী কন্যাকে অনৈতিক কাজের জন্য ধরে নিয়ে যায়। মেয়ের ইজ্জত রক্ষার্থে পিতা নিজেই জামায়াতের ভারপ্রাপ্ত আমীর আব্বাস আলী খানের (বর্তমানে মৃত) নিকট আকুতি-মিনতি করেও কোন ফল পাননি বলে জানান মুক্তিযোদ্ধা জাকারিয়া হোসেন মন্টু। প্রামানিক পাড়ার আবেদ আলীর কন্যা আমেনা বেগমকেও পাক-সেনারা ধর্ষণসহ পাশবিক নির্যাতন চালিয়েছিল। সেই স্মৃতি বুকে লালন করলেও বিষয়টি নিয়ে কথা বলতে চাননি তিনি।
আসছে ১৬ ডিসেম্বর দেশের ৪৮ তম বিজয় দিবস। এ দিন নানা আয়োজনে স্মরণ করা হবে দেশের জন্য জীবন উৎসর্গকারী শহীদদের। ১৯৭১ সালের স্বাধীনতা সংগ্রামে বীর বাঙালীর ত্যাগ আর বীরত্বের কাহিনী ইতিহাসের পাতায় থাকবে স্বর্ণাক্ষরে। পাকিস্তানি পাক হানাদাররা সারাদেশের মত জয়পুরহাটেও নিরীহ মানূষের ওপর চালায় অমানুষিক নির্যাতন, হত্যা করে মুক্তিযোদ্ধাসহ সাধারণ মানুষকে। তবু থেমে থাকেনি মুক্তিযোদ্ধাদের সাহসী যাত্রা। স্বাধীনতা সংগ্রামে মুক্তিযোদ্ধাদের জীবনদান বৃথা যায়নি। বিজয় দিবসের প্রাক্কালে জেলাবাসী গভীর শ্রদ্ধায় স্মরণ করেন তাদের বীরত্বের কথা, জীবনদানের কথা। মুক্তিযোদ্ধাদের খাবার সরবরাহ করার অপরাধে পাঁচুরচক এলাকার লুৎফর রহমানকে ধরে এনে কয়লা ইঞ্জিনের ভেতর ঢুকিয়ে দিয়ে পুড়িয়ে হত্যা করা হয়। স্থানীয় রাজাকারদের সহযোগিতায় এটি ছিল পাক সেনাদের বিভীষিকাময় ও নির্মম অত্যাচারের স্মৃতিচিহ্ন। যা আজও জেলাবাসীকে নাড়া দেয়। জয়পুরহাটের ভাদসা ইউনিয়নের পাহাড়পুর সংলগ্ন এলাকায় সন্মুখযুদ্ধ চলাকালে গুলি ফুরিয়ে যাবার কারণে সাত মুক্তিযোদ্ধাকে আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য করে পাক সেনারা। নিয়তির নির্মম পরিহাস মুক্তিযুদ্ধে যাবার অপরাধে তাদের মুখে কালি লাগিয়ে জয়পুরহাট শহর ট্রাকে করে ঘুরানো শেষে জয়পুরহাট কলেজ (বর্তমান সরকারি কলেজ) মাঠে ছাত্রদের সামনে হাজির করা হয়। সেখানে বক্তব্য রাখেন যুদ্ধাপরাধীর দায়ে আমৃত্যু সাজাপ্রাপ্ত (বর্তমানে মৃত) আব্দুল আলীম। তিনি বলেন, মুক্তিযোদ্ধা হলে এভাবে সাজা পেতে হবে এবং এদেরকে হত্যা করা হবে মর্মে সভায় ঘোষণা দেয়া হয়। পাক-বাহিনীর কমান্ডার মেজর আফজালও এ সভায় উপস্থিত ছিলেন। ঘটনাটি ঘটে ১৯৭১ সালের ১৮ আগস্ট। কথাগুলো বলছিলেন প্রত্যক্ষদর্শী সেই সময়ের ছাত্রনেতা তবিবর রহমান। পরবর্তিতে ফজলুর রহমানের নেতৃত্বে থাকা এ সাত মুক্তিযোদ্ধাকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়।
জয়পুরহাট জেলা সীমান্ত ঘেঁষা হওয়ায় শরনার্থীরা এ পথে ভারতে যাবার সময় পাক-সেনারা পাখির মতো গুলি করে হত্যা করে চকবরকত ইউনিয়নের পাগলদেওয়ানে। হাজার হাজার মানুষকে এখানে হত্যা করা হয়। নিজের হাতে গর্ত করার পর লাইন করে গুলি চালিয়ে গর্তে ফেলে দেয় পাক-সেনারা। জ্ঞান ফিরে হামাগুড়ি দিয়ে পালিয়ে বাঁচেন চিরলাগ্রামের আবেদ আলী। গুলি করার সময় জ্ঞান হারিয়ে আগেই পড়ে যাওয়ার কারণে প্রাণে রক্ষা পান আবেদ আলী। সেই ভয়াল স্মৃতি আজও বুকে লালন করছেন তিনি। পাগলদেওয়ানে পাক-সেনাদের তৈরি সেই সুসজ্জিত বাংকারটি আজও রয়েছে কালের সাক্ষী হিসেবে। এর মধ্যেও প্রতিরোধ হিসেবে জয়পুরহাট স্টেশনের অদূরে উড়ি ব্রিজটি ডিনামাইট দিয়ে উড়িয়ে দেয়া হয়েছিল যাতে রেল যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয় এবং পাকিস্তানী সেনারা আসতে না পারে। পাগলাদেওয়ানে কয়েক দফা সন্মুখ যুদ্ধ হয়েছে পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে এতে নেতৃত্ব দেন ক্যাপ্টেন ইদ্রিস ও হাদিউজ্জামান হাদি। এ সময় পাকিস্তানী সৈন্যদের গোলার আঘাতে আহত হন মুক্তিযোদ্ধা হাদিউজ্জামান হাদি।
জয়পুরহাটের গণহত্যা চলে আব্দুল আলীম ও আব্বাস আলী খানের দিক নির্দেশনায়। বিশেষ করে আব্দুল আলীমের ( যুদ্ধাপরাধী হিসাবে আমৃত্যু সাজা প্রাপ্ত এবং মৃত) প্রত্যক্ষ মদদে জয়পুরহাটের তথা দেশের বৃহত্তর হত্যাকান্ডের ঘটনা ঘটে সীমান্ত সংলগ্ন পাগলাদেওয়ান এবং কড়ই-কাদিপুর দু’টি গ্রামে। ১৯৭২ সালে এদের বিরুদ্ধে দালাল আইনে মামলা হলে গ্রেফতারও হয়েছিলেন। এ মামলায় স্থানীয় রাজাকার কমান্ডার খনজনপুরের শামসুল আলমের ১০ বছর ও শহীদুল্লাহর ৭ বছর জেলও হয়েছিল। কিন্তু ১৯৭৫ সালে স্বপরিবারে বঙ্গবন্ধুকে হত্যা ও ক্ষমতার পালাবদলে সাজা মওকুফ সহ সকলেই জেল থেকে ছাড়া পেয়ে যান। দালাল আইনের মামলার বিষয়ে জয়পুরহাট থানায় একটি রেকর্ড রয়েছে। দালাল আইনে বিভিন্ন ধারায় মোট ২৩টি মামলা রয়েছে।