বাজিস-১ : সিডরের স্মৃতি শুধুই বিভিষিকাময়

369

বাজিস-১
বরগুনা-সিডরের স্মৃতি
সিডরের স্মৃতি শুধুই বিভিষিকাময়
বরগুনা, ১৫ নভেম্বর, ২০১৮ (বাসস) : ঘূর্ণিঝড় সিডরের আঘাত থেকে বেঁচে গিয়েছিলেন বরগুনার মাঝেরচরের গর্ভবতী গৃহবধূ বিলকিস বেগম। ঝড় ও বন্যার পানি নেমে যাওয়ার সপ্তাহখানেক পর বিলকিস বেগমের কোল আলো করে একটি পুত্র সন্তান জন্ম নেয়। আত্মীয়-স্বজনরা শিশুটির নাম রাখে সিডর। তার বয়স এখন ১১ বছর চলছে। ঘূর্ণিঝড় সিডরের স্মৃতি নিয়েই শিশু সিডর বেড়ে উঠছে। বিলকিস বেগমের কাছে ভয়াবহ স্মৃতিময় সিডরের পাশাপাশি আদরের সিডর রয়েছে কিন্তু স্থানীয় মানুষের কাছে ঘূর্ণিঝড় সিডরের স্মৃতি শুধুই বিভিষিকাময়।
সরকারি তথ্য অনুযায়ী ২০০৭ সালের ঘূর্ণিঝড় সিডরে বরগুনা জেলায় প্রাণ হারান ১ হাজার ৩৪৫ মানুষ। নিখোঁজ হন ১৫৬ জন। ৩০ হাজার ৪৯৯ টি গবাদি পশু ও ৬ লাখ ৫৮ হাজার ২৫৯ টি হাঁস-মুরগী মারা যায়। ২ লাখ ১৩ হাজার ৪৬১ টি পরিবার ক্ষতিগ্রস্ত হয়। সম্পূর্ণ গৃহহীন হয়ে পড়ে ৭৭ হাজার ৭৫৪ টি পরিবার।
সিডরের স্মৃতিতে এখনো শিউরে ওঠেন উপকূলের মানুষেরা। রাত তখন সাড়ে সাতটার মতো। মহাবিপদ সংকেতের কথা শুনে আতঙ্কিত বরগুনা উপকূলের মানুষ। তীব্র দমকা হাওয়ার সাথে গুড়ি গুড়ি বৃষ্টি হচ্ছে। আশ্রয় কেন্দ্রে না গিয়ে বেশির ভাগ মানুষই রয়ে গেলেন বাড়িতে। তাদের ধারনা ছিল, কত ঝড়ই এলো গেলো, এবারেও তাদের কিছু হবেনা। রাত সাড়ে ১০ টার দিকে সিডর আঘাত হানলো উপকূলীয় এলাকায়। প্রবল ঝড় ও মাত্র ১০ মিনিটের জলোচ্ছ্বাসে উপকূলের অনেক মানুষ মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে। সকালে দেখা গেল চারিদিকে শুধুই ধ্বংসলীলার চিহ্ন।
সিডরের আগে আবহাওয়া অফিস ৪ নম্বর সতর্ক সংকেত থেকে হঠাৎ করে ১০ নম্বর বিপদ সংকেতের কথা ঘোষণা করে। মংলা সমুদ্র বন্দরকে কেন্দ্র করে যে সতর্ক সংকেত প্রচার করা হয়েছিল, তা বোঝার উপায় বরগুনার মানুষের ছিল না। জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে তথ্য অফিস মাইকিং করলেও তা ছিল শহর এলাকার মধ্যে সীমাবদ্ধ। যারাও ঘূর্ণিঝড়ের সংকেত শুনেছেন, তারাও গাফিলতি ও পর্যাপ্ত আশ্রয় কেন্দ্রের অভাবে নিরাপদ আশ্রয়ে যেতে পারেননি।
বরগুনা সদর উপজেলার সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয় নলটোনা গ্রাম। ঘূর্ণিঝড়ের পরের দিনই সেখানে অর্ধ শতাধিক মানুষের লাশ পাওয়া যায়। গ্রামটি পানির নিচে থাকায় লাশ দাফনের জন্যও কোন স্থান খুঁজে পাওয়া যাচ্ছিল না।
সিডর চলে গেলে দক্ষিণাঞ্চলের সঙ্গে দেশের সড়ক যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন ছিল প্রায় দেড় মাস। বিদ্যুতের সংযোগ বিচ্ছিন্ন ছিল একমাস। দেশি-বিদেশি দাতা সংস্থারাও যোগাযোগ না থাকার কারণে সঠিক সময় ত্রাণসহ সাহায্য-সহযোগিতায় এগিয়ে আসতে পারেনি। দীর্ঘ এগারো বছর অতিবাহিত হলেও অনেকে হারানো স্বজনদের এখনো ফিরে পায়নি। অনেকে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসতে পারেনি। প্রতিবছর উপকূলের মানুষ এ দিনটিকে সিডর দিবস হিসেবে পালন করে।
সিডরে বরগুনার মানুষ স্বজন হারানোর পাশাপাশি ৭৭ হাজার ৭৫৪ টি বসত ঘর সম্পূর্ণভাবে হারিয়েছিল। আংশিক ক্ষতি হয়েছিল ১ লাখ ১২ হাজার ৩১ টি বসত ঘরের। সম্পূর্ণভাবে হারানো বসত ঘরের মধ্যে ৩৪ হাজার ৮৭১ টি ঘর পুনরায় নির্মাণ করা হয়েছে। বাকী ৫৯ হাজার ৮৮৩ টি ঘর নির্মানে ৫ হাজার টাকা ছাড়া আর কোন সহায়তা করা হয়নি। সিডরের পর পর ঐ টাকাটি দেয়ায় কেউই ঘর নির্মাণের কাজে লাগাতে পারেনি। খাবার এবং কাপড় কিনতেই টাকা শেষ হয়ে গেছে।
স্থানীয় হিসেব অনুযায়ী বেসরকারি সংস্থা সংগ্রাম সাড়ে ৫ হাজার, দি ক্রাপডা ২২৯ টি, লন্ডন প্রবাসী ১৫০টি, অপরাজেয় বাংলাদেশ ৩০০টি, আকিজ গ্রুপ ১২০টি, সোনালী উন্নয়ন ফাউন্ডেশন ১০টি, কারিতাস ১ হাজার ১৫০টি, ঢাকা আহসানিয়া মিশন ২ হাজার ৮০০টি, কৈননীয়ার সহায়তায় ফারিয়া লারা ফাউন্ডেশন ১০৬টি, সেইফ দ্যা চিলড্রেন ৪ হাজার ৭৪২টি, ইসলামিক ফাউন্ডেশন ৫০টি, স্টুডেন্ট অব ইস্ট ওয়েস্ট বিদ্যালয় ১২টি, ওয়ামী ৫২টি, স্যাপ বাংলাদেশ ৫৫০টি, ফ্রেন্ডশিপ বাংলাদেশ ১৬০টি, বাংলাদেশ স্কাউটস ১৬টি, এসিআই ৬২টি, বাধন ৩৬টি, হোপ বাংলাদেশ ৩৮৪টি, অ্যাসেড ১৫টি, এডিআরএ ৬৫টি, ডিএসকের সহায়তায় উদ্যম ৯১৮টি ও আরআইসি ৫০০টি ঘর নির্মাণ করে দিয়েছে। এছাড়া ফারিয়া লারা ফাউন্ডেশন ঘর নির্মাণে সহায়তা হিসেবে ৬১০টি পরিবারকে ২ বান্ডিল করে ঢেউটিন বিতরণ করেছে।
বরগুনা পানি উন্নয়ন বোর্ডে সূত্রে জানা গেছে, সিডর ও আইলায় বরগুনার ৪৮৩ কিলোমিটার বেড়ি বাঁধ ভেঙ্গে গিয়েছিল। তখন সরকার ৯ কোটি টাকা বরাদ্দ দেয়। যা দিয়ে ২৭ কিলোমিটার বেড়ি বাঁধ নির্মাণ করা সম্ভব হয়েছে। এছাড়া ১ হাজার ৪৪৮ মে. টন গমের মাধ্যমে ১০.৬৫৮ কি.মি. বাঁধ (অস্থায়ী প্রতিরক্ষা) মেরামত করা হয়েছে। পুরোনো আদলে বেড়ি বাঁধ নির্মাণ করতে হলে দেড়শো কোটি টাকা দরকার। বরগুনা সদর উপজেলার পুরাকাটা, ডালভাঙ্গা, আমতলীর জয়ালভাঙ্গা, ঘটখালী, পাথরঘাটার পদ্মা ও রুহিতায় বেড়ি বাঁধই নেই। এসব এলাকার মানুষ দুর্যোগ ঝুঁকিতে রয়েছে। তাছাড়া স্ল¬ুইজ নেই ১৬টি। এসব জায়গা দিয়ে এখনো পানি ঢুকে ফসলহানী হচ্ছে। তবে আমতলী পৌরসভা, বগী বাজার, বেতাগীতে বেড়ি বাঁধ রক্ষায় সিসি ব্লক স্থাপনের কাজ এগিয়ে চলছে।
বরগুনার জেলা চেয়ারম্যান ও সাবেক সংসদ সদস্য মো. দেলোয়ার হোসেন জানিয়েছেন, ১৫ নভেম্ব^র সিডরে স্বজনহারা উপকূলের মানুষেরা মিলাদ মাহফিল, দোয়া মোনাজাত, কোরআনখানি ও নানাবিধ পারিবারিক আয়োজনে দিনটিকে স্মরণ করেন। বিভিন্ন সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠনও নানা ধরনের কর্মসূচি পালন করবে। স্থানীয় দুটি কমিউনিটি রেডিও বেসরকারি লোকবেতার ও সরকারি কৃষি রেডিও প্রচার করে ১৫ নভেম্বরের সিডর স্মৃতি বিষয়ক নানা অনুষ্ঠানাদি, জানিয়েছেন, লোকবেতারের স্টেশন ম্যানেজার মনির হোসেন কামাল। উপকূলবাসীর দাবি, ১৫ নভেম্বর দিনটিকে যেন জাতীয় দুর্যোগ দিবস হিসেবে ঘোষণা করে সরকারিভাবে সিডর দিবস পালন করা হয়।
বাসস/সংবাদদাতা/কেইউ/১০২৫/নূসী