রোহিঙ্গা ক্যাম্পের গর্ভবতী নারীরা পাচ্ছেন নিয়মিত স্বাস্থ্য সেবা

646

ঢাকা, ১১ নভেম্বর, ২০১৮ (বাসস) : মিয়ানমারে রোহিঙ্গাদের ওপর অত্যাচার শুরু হওয়ার প্রথম দিকেই বাংলাদেশে চলে আসেন ২৫ বছর বয়সী আমেনা খাতুন। তার সঙ্গে আসে স্বামী আর তিন সন্তান। এখানে উখিয়ার এক রোহিঙ্গা ক্যাম্পে ঠাঁই হয় এই পরিবারটির। ক্যাম্পে আসার দু’মাসের মাথায় আবার নতুন করে গর্ভবতী হয়ে পড়েন আমেনা। এই গর্ভধারণের বিষয় নিয়ে প্রথম দিকে তার একেবারেই কোন মাথাব্যথা ছিল না। কারণ, মিয়ানমারে থাকতে তিনি গর্ভবতী মায়ের স্বাস্থ্য সেবা কি জিনিস তা জানতেনই না।
ক্যাম্পের পাশেই নিকটস্থ এক স্বাস্থ্য ক্যাম্পে বসেই তার সঙ্গে কথা হয়। গর্ভবতী হওয়ার পর থেকে স্বাস্থ্য ক্যাম্পে নিয়মিত আসছেন তিনি। আমেনা জানান, ডাক্তার আপা বলেছেন, আর দেড়মাস রয়েছে তার ডেলিভারির। তিনি বলেন, আগের তিনটি সন্তান জন্মদানের সময় মিয়ানমারে চেকআপ কি জিনিস তা সম্পর্কে তাদের পরিবারের কারোরই কোন ধারণা ছিল না। বাড়িতেই তিনি সন্তান জন্ম দিয়েছেন। কিন্তু এখানে আসার পর তিনি অনেক নতুন নতুন তথ্য জানতে পারছেন ডাক্তার আপাদের কাছ থেকে।
আমেনার পাশেই বসে ছিলেন আরেক রোহিঙ্গা নারী জোবেদা খাতুন। তার বয়স ৩১। তিনিও সাড়ে সাত মাসের গর্ভবতী। স্বাস্থ্য ক্যাম্পে এসেছেন চেকআপের জন্য।
জোবেদা বলেন, এখানে এসে আমার অনেক উপকার হয়েছে। বাচ্চার কীভাবে যতœ নিতে হয়, প্রথম ছয় মাস তাদের কী ধরনের খাবার দিতে হবে এবং এর পরে তাদের কী কী খাওয়াতে হবে এমন অনেক তথ্যই এখান থেকে জানতে পারছি।
জোবেদা বলেন, ‘আমার আগের বাচ্চাদের আমি জন্মের দু’মাস পর হতেই পানি খাওয়াতাম। অথচ এখানে এসে জানলাম, জন্মের ছয় মাস পর্যন্ত শুধুমাত্র বুকের দুধ ছাড়া বাচ্চাদের আর কিছুই দেওয়া যায় না।’ তিনি বলেন, এখানকার ডাক্তার আপারাই ঘুরে ঘুরে আমার মত গর্ভবতী নারীদের খুঁজে বের করে তাদের চিকিৎসা দিচ্ছেন, যা আমাদের দেশ মিয়ানমারে কখনো কল্পনাও করতে পারিনি।
স্বাস্থ্য ক্যাম্পে যাদের রোহিঙ্গা নারীরা ডাক্তার আপা বলে ডাকেন তারা আসলে মিডওয়াইফ। কারণ, এত বিপুল সংখ্যক রোহিঙ্গা নারীর সেবা দেয়ার মত ডাক্তার সেখানে নেই। মিডওয়াইফ রোদেলা বলেন, এই ক্যাম্পে প্রতিদিন গড়ে ৫০ থেকে ৬০ জন রোহিঙ্গা নারী আসেন সেবা নেয়ার জন্য। আমরা তাদের স্বাস্থ্য পরীক্ষা করে প্রয়োজনীয় ওষুধ এবং পরামর্শ দেই। এছাড়াও এখান থেকে এসব রোহিঙ্গা নারী প্রসব পরবর্তী সেবাও পেয়ে থাকেন।
সম্প্রতি পরিচালিত এক গবেষণায় দেখা যায়, দেশে এখনো সন্তান জন্ম দিতে গিয়ে প্রতি এক লাখ মায়ের মধ্যে ১৯৬ জন মা মারা যান। জাতীয় জনসংখ্যা গবেষণা ও প্রশিক্ষণ প্রতিষ্ঠান পরিচালিত ওই গবেষণা হতে জানা যায়, বর্তমান বাংলাদেশ সরকার এই মাতৃমৃত্যু কমিয়ে আনতে বিভিন্ন ধরনের প্রকল্প হাতে নিয়েছেন। তার মধ্যে রয়েছে দক্ষ ও প্রশিক্ষিত মিডওয়াইফ, যারা প্রসবকালীন সময়ে মায়েদের সেবা দেবেন।
এ লক্ষ্যে ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ে ২০১২ সাল থেকে চালু করা হয়েছে ডেভেলপিং মিডওয়াইভস প্রজেক্ট। এই প্রজেক্টের মাধ্যমে শুরু হয় তিন বছর মেয়াদী মিডওয়াইফারী প্রশিক্ষণ।
ব্র্যাকের সূত্র মতে ঢাকা, দিনাজপুর, খুলনা, সিলেট এবং ময়মনসিংহ’এ এ পর্যন্ত সাতটি একাডেমিক সেন্টার চালু করা হয়েছে। এসব প্রতিষ্ঠানে এই পর্যন্ত ৮৬০ জন শিক্ষার্থী ভর্তি হয়েছেন এবং ৪শ’ জন কোর্স সম্পন্ন করে দেশের বিভিন্ন স্থানে সেবা দিয়ে যাচ্ছেন।
এসব প্রতিষ্ঠানে কোর্স সম্পন্ন করা ১৫০ জন মিডওয়াইফ বিভিন্ন রোহিঙ্গা স্বাস্থ্য ক্যাম্পে চিকিৎসা সেবা দিয়ে যাচ্ছেন।
এমনই একজন মিডওয়াইফ মেহের আফরোজ বলেন, আমি এখানে এসেছি আজ সাড়ে পাঁচ মাস। এ পর্যন্ত প্রায় সাড়ে সাতশ’ ডেলিভারি করেছি।
তিনি বলেন, ক্যাম্পে আসা প্রায় সব নারীই তাদের স্বাস্থ্য সম্পর্কে সচেতন নন। আমাদেরকেই খুঁজে খুঁজে বের করতে হয় গর্ভবতী নারীদের। শুরুর দিকে তারা স্বাস্থ্য ক্যাম্পে আসতে চান না। অনেক বুঝানোর পর তারা আসতে রাজী হন। তবে, আগের তুলনায় রোহিঙ্গা নারীরা এখন অনেক সচেতন হয়েছেন।
রোহিঙ্গা স্বাস্থ্য ক্যাম্পে কর্মরত গাইনি বিশেষজ্ঞ ডা. নূরানী সুলতানা বলেন, আসলে ডাক্তারদের পক্ষে এত সংখ্যক নারীকে স্বাস্থ্য সেবা দেয়া সম্ভব নয়। কারণ, আমাদের প্রতিদিন গড়ে ৭০ থেকে ৮০ জন রোগী দেখতে হয়। অনেক সময় তা ১০০’এর উপরও চলে যায়। এখানে আমরা মিডওয়াইফদের বুঝিয়ে দেই করণীয় কী। তারা আবার রোগীদের এ ব্যাপারে ভালো করে বুঝিয়ে দেন।
তিনি বলেন, এসব রোহিঙ্গা ক্যাম্পে মিডওয়াইফরা অনেক বেশি সক্রিয়। তারা দিনরাত পরিশ্রম করে সেবা দিয়ে যাচ্ছেন।