চ্যারিটেবল ট্রাস্ট মামলায় খালেদা জিয়াসহ চার আসামীর ৭ বছরের সশ্রম কারাদন্ড

792

ঢাকা, ২৯ অক্টোবর, ২০১৮ (বাসস) : অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় বিএনপি চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়াসহ চার আসামীকে ৭ বছরের সশ্রম কারাদন্ড দেয়া হয়েছে।
রাজধানীর ঢাকার নাজিম উদ্দিন রোডের পুরনো কেন্দ্রীয় কারাগারের ভেতর স্থাপিত পঞ্চম বিশেষ জজ আদালতের বিচারক ড. আখতারুজ্জামান আজ এ রায় দেয়।
পাশাপাশি রায়ে প্রত্যেককে ১০ লাখ টাকা করে জরিমানা, অনাদায়ে আরও ছয় মাসের কারাদন্ডের আদেশ দেয়া হয়েছে। এছাড়া এ ট্রাস্টের নামে ঢাকার কাকরাইলে থাকা ৪২ কাঠা জমি রাষ্ট্রের অনুকূলে বাজেয়াপ্তের আদেশ দেয় আদালত।
কারা কর্তৃপক্ষ বার বার খালেদা জিয়াকে আদালতে নিতে ব্যর্থ হওয়ায় তার অনুপস্থিতিতেই এ মামলার শেষ দিকের কার্যক্রম চালিয়ে নেয় আদালত। রায়ের সময়ও আজ খালেদা জিয়াকে আদালতে হাজির করা সম্ভব হয়নি। গত ১৬ অক্টোবর আজ রায় ঘোষণার দিন ধার্য করে আদেশ দেয়া হয়।
রায় ঘোষণার প্রাক্কালে আদালত বলেন, ১৫টি বিবেচ্য বিষয় সামনে রেখে মামলার রায় দেয়া হয়েছে। রায়ে বলা হয়, জিয়া চ্যারিটেব্যাল ট্রাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্কিত নয় এমন ব্যক্তির মাধ্যমে এ ট্রাষ্ট্রের অর্থ লেনদেন হয়েছে। অবৈধ উপায়ে এ ট্রাষ্ট্রে বিভিন্ন সময় লেনদেন হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী থাকাকালীন খালেদা জিয়ার জ্ঞাতসারে অবৈধভাবে এ ট্রাষ্ট্রে অর্থের লেনদেন হয়েছে যা ক্রিমিনাল মিসকন্ডাক্ট বলে রায়ে উল্লেখ করা হয়। দুদকের পেশকৃত সাক্ষ্য-প্রমাণ অনুযায়ী খালেদা জিয়াসহ মামলার অপর আসামীদের সহযোগিতায় এখানে অপরাধ সংগঠিত হয়েছে। রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ পর্যায়ে দায়িত্বে থেকে ভবিষ্যতে যেন কেউ এরূপ অপরাধ করতে না পারে তার দৃষ্টান্ত স্থাপনে আইন অনুযায়ী আসামীদের সর্বোচ্চ সাজা দিয়ে আদালত রায় ঘোষণা করে।
রায়ের পর এ মামলায় দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) আইনজীবী মোশাররফ হোসেন কাজল রায়ে সন্তোষ প্রকাশ করে বলেন, আসামীদের বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগ আমরা প্রমাণ করতে সক্ষম হয়েছি। আইন অনুযায়ী আসামীদের সর্বোচ্চ সাজা হয়েছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, এতে স্বস্তি বোধ করছি। তিনি বলেন, মামলায় সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়াকে আদালত দুর্নীতি দমন আইন, ১৯৪৭ এর ধারা: ৫(২) অনুযায়ী অপরাধমূলক অসদাচরণের সাজা দিয়েছেন। যেখানে বলা আছে, ‘কোন সরকারি কর্মচারি অপরাধমূলক অসদাচরণ সংঘঠন করিলে বা সংঘঠনের উদ্যোগ গ্রহণ করিলে সে সাত (০৭) বছর পর্যন্ত কারাদন্ড অথবা জরিমানা অথবা উভয় দন্ডে দন্ড যোগ্য হইবে এবং অপরাধমূলক অসদাচরণ সংশ্লিষ্ট অর্থিক সম্পদ অথবা সম্পত্তি ও রাষ্ট্রের অনুকূলে বাজেয়াপ্ত হইবে।’ অপর তিন আসামীকে দন্ডবিধির ১০৯ ধারায় সাজা দেয়া হয়েছে এবং দুর্নীতি দমন কমিশনের আইনে অপরাধের সিডিউল অনুযায়ি মামলায় আসামীদের বিরুদ্ধে রায় দেয়া হয়েছে বলে জানান আইনজীবী কাজল।
আজ রায় ঘোষণাকে কেন্দ্র করে রাজধানীর পুরাতন কেন্দ্রিয় কারাগার এলাকায় নিরাপত্তা জোড়দার করা হয়। মোতায়েন করা হয় আইন-শৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনীর বিপুল পরিমান সদস্য। কারাগারের প্রধান সড়ক কাটাতারের বেড়া দিয়ে বন্ধ করে দেয়া হয়। তল্লাসি ছাড়া কাউকে প্রবেশ করতে দেয়া হয়নি।
এ মামলায় চার আসামির মধ্যে খালেদা জিয়া, জিয়াউল ইসলাম মুন্না ও মনিরুল ইসলাম খান বর্তমানে কারাগারে আছেন। আরেক আসামি হারিছ চৌধুরী শুরু থেকেই পলাতক। আজ রায়ে হারিছ চৌধুরীর বিরুদ্ধে সাজা পরোয়ানা জারির আদেশ দেয়া হয়। আসামী জিয়াউল ইসলাম মুন্না ও মনিরুল ইসলাম খানকে আজ আদালতে হাজির করা হয়। তাদের উপস্থিতিতে রায় দেয়া হয়।
এর আগে গত ২৬ সেপ্টেম্বর দুদকের পক্ষে আইনজীবী আদালতে একটি আবেদন পেশ করে জানান, যেহেতু আসামীপক্ষ শুনানি করতে আগ্রহী নয়, তাই মামলাটির রায়ের তারিখ ঘোষণা করা হোক। এর আগে খালেদা জিয়ার অনুপস্থিতিতেই বিচার চলবে কি-না, এ বিষয়ে সেদিন মামলার বাদী দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) আইনজীবী ও আসামিপক্ষের আইনজীবীদের বক্তব্য শুনে ২০ সেপ্টেম্বর আদেশ দেয় আদালত। আদেশে খালেদা জিয়ার অনুপস্থিতিতে মামলা চলবে বলে বলা দেয়া হয়। এ আদেশ হাইকোর্ট ও আপিল বিভাগেও বহাল থাকে।
গত ৫ সেপ্টেম্বর প্রথমবারের মতো রাজধানীর নাজিমউদ্দিন রোডের পুরাতন কেন্দ্রীয় কারাগারে জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলার শুনানি অনুষ্ঠিত হয়। কয়েকটি কার্যদিবস মামলার ধার্য তারিখে যুক্তিতর্ক পেশ করেনি আসামীপক্ষ। গত ৪ সেপ্টেম্বর আইন, বিচার ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের আইন ও বিভাগ চ্যারিটেবল ট্রাস্ট মামলার বিচার সম্পন্ন করতে পুরনো কেন্দ্রীয় কারাগারে অস্থায়ী আদালত স্থাপন করে গেজেট প্রকাশ করে। আইন মন্ত্রণালয়ের ওই গেজেটে বলা হয়, নিরাপত্তাজনিত কারণে সরকারি আলিয়া মাদ্রাসার মাঠে স্থাপিত অস্থায়ী আদালত থেকে নাজিমুদ্দিন রোডে অবস্থিত পুরাতন ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের প্রশাসনিক ভবনের কক্ষ নম্বর-৭ কে অস্থায়ী আদালত ঘোষণা করা হয়েছে।
২০১০ সালের ৮ আগস্ট খালেদা জিয়াসহ চার জনের বিরুদ্ধে তিন কোটি ১৫ লাখ ৪৩ হাজার টাকা আত্মসাতের অভিযোগে জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট মামলাটি দায়ের করে দুদক। এ মামলায় ২০১২ সালের ১৬ জানুয়ারি আদালতে অভিযোগপত্র দাখিল করে দুদক। মামলাটিতে খালেদা জিয়াসহ অন্য আসামিদের বিরুদ্ধে ২০১৪ সালের ১৯ মার্চ তৎকালীন বিচারক বাসুদেব রায় অভিযোগ গঠন করে বিচার শুরুর আদেশ দেয়। মামলায় প্রসিকিউশনের পক্ষে ৩২ জন সাক্ষ্য দেয়। আসামীপক্ষ তাদের জেরা করে।
দুদকের আইনজীবী কাজল বলেন, ২০০১ সাল থেকে ২০০৬ সালের ক্ষমতায় থাকার সময় ৬ শহীদ মইনুল রোডের বাড়ির ঠিকানা ব্যবহার করে জিয়াউর রহমান চ্যারিটেবল ট্রাস্ট নামে গুলশান সাব রেজিস্ট্রি অফিসে রেজিস্ট্রি করেন খালেদা জিয়া। চ্যারিটেবল কাজের জন্য ট্রাস্ট করেছেন তা উল্লেখ আছে। কিন্তু চ্যারিটেবল কাজে কোনো টাকা খরচ করেননি। খালেদা জিয়া ট্রাস্টের কাজে তাঁর রাজনৈতিক সচিব হারিছ চৌধুরী, হারিছের এপিএস জিয়াউল ও অন্যান্যদের সহযোগিতায় প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের সোনালী ব্যাংক শাখার হিসাবে (অ্যাকাউন্টে) ক্ষমতার অপব্যবহার করে অবৈধভাবে টাকা সংগ্রহ করে লেনদেন করেন। ট্রাস্টের নামে অবৈধভাবে টাকা গ্রহণ ও খরচ সংক্রান্ত প্রতিটি পদক্ষেপে স্বচ্ছতার অভাব দেখা গেছে।
তিনি বলেন, খালেদা জিয়া প্রধানমন্ত্রী পদে থেকে ক্ষমতার অবৈধ প্রভাব খাঁটিয়ে ১ কোটি ৯০ লাখ ৫০ হাজার টাকা বিভিন্ন প্রক্রিয়ায় জমা করেন। ওই টাকার বৈধ উৎসের কোনো তথ্য-প্রমাণ পাওয়া যায়নি। প্রধানমন্ত্রী থাকার সময় ওই হিসাবে লেনদেন হলেও প্রধানমন্ত্রী পদ ছেড়ে যাওয়ার পর ওই হিসাবে আর কোনো লেনদেন হয়নি। খালেদা জিয়া জানতেন, ১ কোটি ৯০ লাখ ৫০ হাজার টাকার উৎস অবৈধ ছিল। কারণ, তিনি ট্রাস্টের প্রথম ম্যানেজিং ট্রাস্টি। তাঁর অগোচরে ওই ট্রাস্টের হিসাবে টাকা জমা হওয়ার কথা নয়। আমরা সাক্ষ্য-প্রমাণ দিয়ে মামলা প্রমাণ করতে পেরেছি। তিনি বলেন, এ মামলায় আসামী হারিছ চৌধুরীর সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়ার রাজনৈতিক সচিব ছিলেন। হারিছ চৌধুরী অবৈধভাবে অর্জিত সকল টাকা নিজ দায়িত্বে সংগ্রহ করে তাঁর এপিএস জিয়াউল ইসলাম এবং ঢাকার সাবেক মেয়র সাদেক হোসেন খোকার এপিএস মনিরুল ইসলাম খানের সহায়তায় সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়াকে অবৈধভাবে জিয়াউর রহমান ট্রাস্টের নামে জমি কেনার জন্য টাকা দেয়ার ক্ষেত্রে সহযোগিতা করেছেন।
এডভোকেট কাজল বলেন, হারিছ চৌধুরীর পিএস জিয়াউল ইসলাম মুন্না বিভিন্ন সময় পে-ইন স্লিপের মাধ্যমে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়, সোনালী ব্যাংক শাখায় জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্টের নামে জমা করেন। হারিছ চৌধুরীর নামে অন্যান্য যেসব পে-অর্ডার আসে তাও তিনি জমা রাখেন। এসব পে-অর্ডার ও নগদ টাকা তাঁর অধস্তন কর্মকর্তা হিসেবে তাঁরই নির্দেশে অবৈধ টাকা দিয়ে অপরাধ করেছেন। কাজল বলেন, ঢাকা সিটি কর্পোরেশনের সাবেক মেয়র সাদেক হোসেন খোকার সহকারী একান্ত সচিব প্রধানমন্ত্রীর সচিবালয়ের সাবেক প্রধানমন্ত্রীর রাজনৈতিক সচিব হারিছ চৌধুরীর কাছ থেকে টাকা নিয়ে পেঅর্ডার করার জন্য মেট্রো মেকার্স ডেভেলপমেন্ট-এর ব্যবস্থাপনা পরিচালক এ এফ এম জাহাঙ্গীরের সাহায্যে শাহজালাল ইসলামী ব্যাংক ধানমন্ডি শাখায় যান। ৫টি পে অর্ডারের মাধ্যমে জিয়াউর রহমান চ্যারিটেবল ট্রাস্টের নামে অ্যাকাউন্টে অবৈধভাবে সংগৃহীত মোট ১ কোটি ৩৫ লাখ টাকা পাঠানোর ব্যবস্থা করে দন্ডবিধির ১০৯ ধারার অপরাধ করেছেন।
জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট মামলায় ৫ বছরের কারাদন্ডে দন্ডিত হয়ে কারাবন্দি রয়েছেন বেগম খালেদা জিয়া। গত ৮ ফেব্রুয়ারি জিয়া অরফানেজ মামলায় রায় দেয় বিচারিক আদালত। ওইদিন থেকেই কারাগারে রয়েছেন খালেদা জিয়া। উচ্চ আদালতের আদেশ অনুযায়ী তিনি কারা হেফাজতে বিএসএমএমইউ’তে বর্তমানে চিকিৎসাধীন আছেন।