পাহাড়ি জনপদে নারী ও শিশুর স্বাস্থ্যসেবা

1029

খাগড়াছড়ি, ২৮ সেপ্টেম্বর, ২০১৮ (বাসস) : তাহি হিতে চাকমা (৩২)। রাঙামাটি জেলার কাপ্তাই উপজেলার মগবান বড়ধন পাড়ার অনিমেষ চাকমার মেয়ে সে। দীর্ঘদিন ধরে বিভিন্ন মৌসুমী রোগ বালাইসহ মেয়েলী রোগে ভোগছেন।
প্রীতিজিপ চাকমা (১২)। পিতা আলো বিকাশ চাকমা। এ উপজেলার দুর্গম পাহাড়ী পল্লী জীবতলা এলাকার ৫ম শ্রেণীর এ ছাত্রী বেশিরভাগ সময়ই জ্বর, ম্যালেরিয়া, টাইফয়েড রোগে ভোগে।
জ্বর, ডায়রিয়া, জন্ডিস, হার্ট-এর রোগ পাহাড়ি জনপদের নারী ও শিশুর নিত্যসঙ্গী।
পার্বত্য অঞ্চলের দুর্গম পাহাড়ি এলাকায় সহজে হাতের নাগালে চিকিৎসা সেবা নেই। তাই রোগ-শোক নিয়েই এ জনপদের মানুষের জীবন কাটাতে হয়। বড় ধরনের কোন স্বাস্থ্য সমস্যা দেখা দিলে উপজেলা বা জেলা হাসপাতালে যেতে হয়।
এ বিষয়ে তাহি হিতে চাকমার বাবা অনিমেষ চাকমা বলেন, আমরা বেশির ভাগ সময় জ্বর, ডায়রিয়া, টাইফয়েড রোগে ভুেগ থাকি। প্রায় প্রতি গ্রীষ্ম মৌসুমে জ্বর, ডায়রিয়া, জন্ডিস, হার্ট-এর রোগ লেগেই থাকে। এ দুর্গম পাহাড়ী পল্লীতে তেমন কোন চিকিৎসা সেবা পাচ্ছি না। চিকিৎসা নিতে হলে কাপ্তাই মিশন খ্রিস্টিয়ান হাসপাতাল বা কাপ্তাই উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে যেতে হয়।
সেখানে বেশিরভাগ সময়ই ডাক্তার থাকেন না। দীর্ঘ সময় পর ডাক্তার পাওয়া গেলেও সরকারি ওষুধ জোটে না। হাসপাতালের রোগীরা তেমন কোন সুচিকিৎসা পাচ্ছেন না। কারণ, হাসপাতালের পরিবেশ জরাজীর্ণ, অপরিচ্ছন্ন ও অনিয়মে ভরা। মশা-মাছি আর দুর্গন্ধে চিকিৎসা ও নার্সিং সেবা পাওয়াতো দূরের কথা হাসপাতালের বেডে শুয়ে থাকাই দায়। হাতেগোনা কয়েকটি এনজিও আছে যারা মাঝে মধ্যে কিছু কিছু চিকিৎসা সেবা দিয়ে থাকে। তবে তাদের বাণিজ্যিক ও মিশনারি কাজেই বেশি মনোযোগী হতে দেখা যায়।
২০১১ সালের আদমশুমারি অনুযায়ী পার্বত্য এলাকার মোট জনসংখ্যা ১৫,৯৮,২৯১ জন। এদের প্রায় অর্ধেকই নারী। বাঙালি ছাড়াও এখানে ১৩টি ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী বসবাস করে। এরা হচ্ছে চাকমা, মারমা, ত্রিপুরা, মুরং, তঞ্চঙ্গ্যা, বোম, পাংখোয়া, খুমি, চাক, লুসাই, উসাই, বনযোগী এবং খিয়াং। মোট জনসংখ্যার ৪৭% বাঙালি, ২৬% চাকমা, ১২% মারমা এবং ১৫% অন্যান্য ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী।
পার্বত্য অঞ্চলের দুর্গম পাহাড়ী জনপদের স্বাস্থ্যসেবা বিষয়ে কাপ্তাই উপজেলার স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. মাসুদ আহমেদ চৌধুরীর কাছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, শুষ্ক মৌসুম এলেই মৌসুমী জ্বর, টাইফয়েড, জলবসন্ত, চোখ ওঠা গলাফুলা রোগ হয়। তবে এখন ম্যালেরিয়া আগের ছেয়ে কম। দুর্গম এলাকায় আমাদের কমিউনিটি সেন্টারের মাধ্যমে চিকিৎসা সেবা দেয়া হয়। আর যদি বেশি সমস্যা দেখা দেয় তাহলে আমরা হাসপাতাল হতে মেডিকেল টিম পাঠিয়ে চিকিৎসা সেবা দিয়ে থাকি। আমাদের যতটুকু সম্ভব আমরা তা করে থাকি বলে তিনি মন্তব্য করেন।
দুর্গম পার্বত্য অঞ্চলে বসবাসরত ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী এলাকায় সরেজমিন গিয়ে দেখা যায়, তারা কুসংস্কারে আচ্ছন্ন। নারীদের শিক্ষা ও সচেতনতার অভাবে তারা অনেক রোগ-ব্যাধিতে আক্রান্ত হচ্ছেন। পাশাপাশি সরকারের স্বাস্থ্য শিক্ষা ও গণসচেতনতা কার্যক্রম নেই বললেই চলে। পরিবার ও সমাজে স্বাস্থ্য সচেতনতা না থাকায় বয়ঃসন্ধিকালে কিশোরী, বাল্যবধূ, নববিবাহিতা, গর্ভবতী, দুধপ্রদানকারী মায়েরা রক্তস্বল্পতাসহ নানান জটিল ও কঠিন মেয়েলীরোগে ভোগেন। এ ছাড়া ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর নারীরা নিয়মিতÑ ম্যালেরিয়া, টাইফয়েড, জন্ডিস, যক্ষ্মা, ক্যান্সার, ডায়রিয়া, চর্মরোগ, রক্তশূন্যতা, মাতৃত্বকালীন জটিলতা, নবজাতকের মৃত্যু, কৃমিরোগে আক্রান্ত হচ্ছেন।
পার্বত্য অঞ্চলের ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী নারীরা ঘরে ও বাইরে খেটে চলে উদয়াস্ত। একদিকে স্বামীর সাথে ফসলের মাঠে অন্যদিকে ঘরে প্রেমময়ী স্ত্রী ও স্নেহময়ী মা সমানভাবে ভূমিকা রাখে। এ নারী একজন সক্রিয় উপার্জনকারী। সন্তান জন্ম দেয়া লালন-পালন করা ও ঘর-গৃহস্থালির যাবতীয় কাজ এক হাতেই সমাধান করে তাকে। দেশের প্রতিটি মানুষের মতো তারও রয়েছে স্বাস্থ্যসেবা প্রাপ্তির অধিকার। নারী হওয়ার সুবাদে কতিপয় স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করা প্রয়োজন। যেমন প্রজনন ও মাতৃত্বকালীন স্বাস্থ্যসেবা। এটি নারী জীবনের খুবই স্পর্শকাতর সময়। একটি গুরুত্বপূর্ণ অধিকারও। রাষ্ট্রীয় পরিম-লে এমনিতেই নারীর অবস্থান প্রান্তিক। নৃ-গোষ্ঠী নারীর অবস্থান আরও প্রান্তিক। আর তাই তার অবস্থান বড় বেশি নাজুক। সাধারণ বিচারে নৃ-গোষ্ঠী নারী হিসেবে সমাজ ও রাষ্ট্রীয় জীবনে তার যে নির্ধারিত অবস্থান সেই অবস্থান সমাজে বিদ্যমান পারিপার্শ্বিকতার প্রেক্ষিতে আর দশটি মূল ধারার নারীর অবস্থান থেকে অনেক নিচে।
একটি জাতীয় দৈনিকের কাপ্তাই উপজেলা সাংবাদিক কবির হোসেনের মতে, কুসংস্কার, অশিক্ষা ও অসচেতনতা এ জনপদের নারী ও শিশুর স্বাস্থ্য সমস্যার অন্যতম কারণ। এখানকার পাহাড়ে বসবাসকারী প্রায় সকল বয়সী নারী-পুরুষ ধূমপান ও মাদক সেবনে অভ্যস্ত। প্রাচীন রীতিনীতি ও কুসংস্কার থেকে এরা বেরুতে চায় না।
ঢাকার মিরপুরের ডিজিল্যাব মেডিকেল সার্ভিসের সার্জন ডা. জি.এম. জাহাঙ্গীর হোসেন বলেন, দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে বসবাস করা ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী নারীরা অবহেলিত। উপযুক্ত স্বাস্থ্যসেবা না পেয়ে তারা বিভিন্ন রোগ-শোকে ভোগেন। জেলা ও উপজেলা শহরের কাছাকাছি যারা বসবাস করেন তারা কিছু সরকারি স্বাস্থ্যসেবা পেয়ে থাকেন। ইউনিয়ন পর্যায়ে এ সেবা একেবারেই অপ্রতুল। কিন্তু যারা নিতান্তই প্রত্যন্ত অঞ্চলে বসবাস করে তাদের কাছে এনজিও স্বাস্থ্য কর্মীরাও যেতে পারে না। তাই পার্বত্য অঞ্চলের ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী নারীরা স্বাস্থ্য সমস্যা ও রোগ-ব্যাধি নিয়েই জীবনযাপন করেন।