শিশুর খাওয়া দাওয়া ও মায়ের ভাবনা

1365

ঢাকা, ২৮ সেপ্টেম্বর, ২০১৮ (বাসস) – আঠারো মাসের সিদরাত। কিছুই খেতে চায় না। তাকে খাওয়ানো নিয়ে মায়ের রীতিমত যুদ্ধ চলে। মা লাভলী আক্তার সারাক্ষণ সন্তানকে খাওয়াতে না পারার টেনশনে ভোগেন। বিভিন্ন কৌশলে কিছু খাওয়াতে পারলেও তা যথেষ্ট মনে করেন না তিনি। তাই বাজারের বিভিন্ন মজাদার মিষ্টি জাতীয় খাবার খাওয়াতেও চেষ্টা করেন। সিদরাতের বাবা জি এম এরশাদ সন্তানের পছন্দমত খাবার আনতে ভুল করেন না।
সরেজমিনে চাঁদপুর সদর উপজেলা বাহ্মণসাখুয়া গ্রামের বাড়িতে এমন চিত্র দেখা যায়।
ইদানিং প্রায় সকল মায়েদের বলতে শোনা যায়, আমার বেবি খেতে চায় না। বেবি খেলছে, পড়ছে, দুষ্টুমি করছে, কিন্তু খেতে চাইছে না। খাবার গ্রহণে শিশুর এই অনীহা কেন? কেন শিশু খেতে চায় না?
অনেক মা অনুযোগের সুরে বলেন,আমার বাচ্চা খাবার মুখে নিয়ে বসে থাকে গিলে না, আবার কেউ বা বলেন, আমার বাচ্চা শুধু চকলেট, মিষ্টি জাতীয় খারার, চিপস ও কোক খেতে চায়। অন্য একজন মা বলেন, আমার বাচ্চা ফাস্টফুড পাগল। বিজ্ঞাপন, কার্টুন বা গান না দেখালে খেতে চায়না না।
এখন আমার প্রশ্ন হল বাচ্চারা তো বিজ্ঞাপন, চা, কোক, চিপস, চকলেট, ফাস্টফুড চিনে না, ওদের এসব খাইয়ে অভ্যাস করেছেন কেন? আসলে অনেক মায়েরা তাদের বাচ্চাদের খাবার নিয়ে একটু বেশি চিন্তিত থাকেন বলে খাবারের ক্ষেত্রে কোন রুটিন মেনে চলেন না। আর এই অনিয়মিত খাদ্যাভ্যাসের দরুন ধীরে ধীরে খাবারের প্রতি অনীহা তৈরি হয়।
মনে রাখবেন শিশুর শরীর ছোট, তার চাহিদা কম, তার হজম শক্তিত কম, এতএব শিশুর চাহিদা অনুযায়ী তাকে খেতে দিন। তার ক্ষিদে লাগলে সে নিজেই চেয়ে খাবে।
এ বিষয়ে ঢাকার গেন্ডারিয়াস্থ আজগর আলী হসপিটালের চীফ ডায়েটিশিয়ান সেলিনা বদরুদ্দিন বলেন, খাওয়ার ব্যাপারে শিশুকে চাপ প্রয়োগ ঠিক নয়। ক্ষুধা লাগলে শিশু খাবে এটাই স্বাভাবিক; আর খাবার হজম হলেই শিশুর ক্ষিদে লাগবে। যদি খাওয়ার সুনির্দিষ্ট সময় ছাড়া অন্য সময়ে শিশুকে কিছু খাওয়ানো হয়, তবে তা ঠিকমতো হজম হবে না। হজম না হলে ক্ষিদে পাবে না। ক্ষিদে না পেলে শিশু খেতে চাইবে না। শিশুর খেতে ‘না চাওয়া’টা মায়ের দুশ্চিন্তার কারণ। আবার শিশুর চিকিৎসকও যখন এই বিষয়টা খুব একটা আমলে নেয় না, তখন মায়ের জন্য সেটা হয়ে যায় অসহায়ত্বের বিষয়। আসলে শিশুর এই খেতে না চাওয়াটা খুব সাধারণ একটি সমস্যা।
প্রতিটা শিশুই আলাদা আর তাদের খাবারের চাহিদাও ভিন্ন। এমনকি একথাও বলা হয়ে থাকে, দিনভেদে একই শিশুর খাবারের প্রতি চাহিদা বা আগ্রহের রকমফের ঘটে। মাঝেমধ্যে শিশু কোনো রকম ঝামেলা ছাড়াই তার জন্য বরাদ্দ খাবার খেয়ে ফেলে। আবার অন্যদিন হয়তো একদমই খেতে চায় না। এতে মা-বাবা চিন্তিত হয়ে পড়েন। ধারনা করে থাকেন যে এটা বুঝি শিশুর বৃদ্ধি ও বিকাশ কে বাধা গ্রস্ত করছে। আসলে ব্যাপারটি তা নয়। আপনার বাচ্চা যদি স্বাভাবিক চলাফেরা ও খেলা ধুলায় ক্লান্ত না হয়ে পরে তবে চিন্তার কোন কারন নেই। সাধারণত যেসব কারণে শিশু খেতে চায় না তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো:
১. জোরপূর্বক খাওয়ানো। জোর করে খাওয়ানোর ফলে শিশুর মধ্যে প্রচ- ভাবে খাদ্য অনীহা দেখা দেয়।
২. অনেক সময় শক্ত খাবার, অপছন্দের খাবার এবং একই খাবারের পুনরাবৃত্তি করে খাওয়ালে খাবারের প্রতি শিশুর অনীহা তৈরি হয় এবং সে খাবার দেখলে ভয় পায় বা বমি করেফেলে।
৩. ছোট শিশুদের ঘ্রাণেন্দ্রিয় বেশ স্পর্শকাতর। খাবারের গন্ধ এবং রঙ যদি ভাল না হয় বাচ্চারা সে খাবার খেতে চায়না, মুখ থেকে ফেলে দেয়।
৪. অনেক সময় শরীরের জিনঘটিত কারণে কিছু কিছু খাবারের গন্ধ বা স্বাদ বাচ্চারা সহ্য করতে পারে না। এর ফলে তারা সব ধরনের খাবার খেতে চায় না, বেছে বেছে খায়।
৫. হজম প্রক্রিয়াতে সমস্যা থাকায় অনেক বাচ্চার খিদে কম পায় এবং খাবার ইচ্ছা থাকে না। এ কারণেও অনেক বাচ্চা খাবার নিয়ে বায়না করতে পারে।
৬. যেসব শিশুদের ঘন ঘন মুড পরিবর্তন হয়, তারা খাবার নিয়ে সমস্যা করে বেশি। নিজের স্বাধীন মেজাজ বোঝানোর জন্য বা বজায় রাখার জন্য অনেক শিশু খাবার নিয়ে বায়না ও জেদ করতে থাকে।
৭. শিশুর খাবার না খেতে চাওয়ার পেছনে অনেক সময় সাইকোলজিকাল ব্যাপার কাজ করে। যেসব বাচ্চার মা অতিরিক্ত আদর বা শাসন করে, সে বাচ্চাদের মধ্যে খাবার নিয়ে ঝামেলা করার প্রবণতা বেশি দেখা যায়।
৮. অনেক মা শিশুকে নিয়মমাফিক খাওয়ানোর মাঝে কান্নামাত্রই মায়ের দুধ খাওয়ান বা অন্যোন্য খাবার খাওয়ান। এই অনিমিয়ত খাবারের দরুন শিশুর খাবারের রুচি ও ক্ষিধা নষ্ট হয়ে যায়। ফলে সে খাবার খেতে অনীহা প্রকাশ করে।
৯. কোনো কোনো বাড়িতে শিশু নিজের খাবার সময় ছাড়া অন্য সময়ও পরিবারের অন্যান্য সদস্য বা আত্মীয়-স্বজন সবার সাথে খায়। আবার অনেক মা তার শিশু সাতটায় সময় পেটভরে খায়নি বলে আটটার সময় তাকে আরেকবার খাবার দেন, নয়টার সময় আবার চেষ্টা করেন এবং এমনিভাবে সারাদিন ধরেই প্রচেষ্টা চলতে থাকে। এ সব অভ্যাসই শিশুর খাবারের প্রতি অনিহা তৈরি করে।
১০.মুখ ভর্তি করে খাবার দিলে অনেক সময় তার গিলতে সমস্যা হয়। যার ফলে খাবার গ্রহণে শিশু অনীহা প্রকাশ করতে পারে।
শিশু কে খাওয়ানোর নিয়ম:
শিশু চিকিৎসক ডা, জহুরুল হক সাগর বলেন, প্রকৃত পক্ষে শিশুর মূল খাদ্যাভ্যাস তৈরি করতে হবে ছয় মাস বয়স থেকে, যখন সে মায়ের বুকের দুধের পাশাপাশি পরিপূরক খাবার খেতে শুরু করে। শিশুকে দৈনিক চার-পাঁচবার অল্প অল্প করে পরিপূরক খাবার খেতে দিতে হবে।
শিশুর পরিপূরক খাবার অবশ্যই সুষম হতে হবে। এজন্য সবজি, ডাল, মাছ বা মুরগির মাংস এবং তেল দিয়ে খিচুড়ি রান্না করে দেয়া যেতে পারে। এছাড়া শিশুকে ডিম, সুজি, পাশাপাশি বুকের দুধ খাওয়াতে হবে।
একটি শিশু যখন থেকে বাড়তি খাবার খেতে শিখে তখন থেকেই শিশুকে সব ধরনের খাবার খেতে অভ্যাস করতে হবে। একটি শিশুর সঠিকভাবে বেড়ে ওঠার জন্য মাছ, মাংস, ডিম, দুধ, শাকসবজি, ফলমূল সবকিছুই সমান গুরুত্বপূর্ণ। তাই তাকে ছোটবেলাতেই এসব খাবার দিতে হবে।
শিশুর খাবার থালা, বাটি, চামচ পরিস্কার পরিচ্ছন্ন ও তার উপযোগী অর্থাৎ রঙিন, সাইজে ছোট হলে শিশু খেতে আকৃষ্ট হবে।
পরিবারের সবার সঙ্গে শিশুকে খেতে দিতে হবে। পরিবারে একাধিক শিশু থাকলে তাদের একসঙ্গে খেতে দিলে প্রতিন্দ্বন্দ্বিতায় উৎসাহী হয়ে তারা খাওয়া শিখবে।
বাহিরের কোন খাবার বাচ্চাকে খাওয়ানো যাবে না। বাচ্চারা অনেক বেশি খাবার গ্রহন করতে পারে না তাই ওদের খাবারটা পরিমানে অল্প কিন্তু উচ্চ ক্যালোরি সম্পন্ন হবে।
বাচ্চাদের টেলিভিশন, কম্পিউটার, মোবাইল আর গেইম থেকে দূরে রাখতে হবে। তাকে কিছু খেলনা দিতে হবে যা খেললে শারিরিকভাবে তার শক্তি খরচ হবে এবং ক্ষুধা বৃদ্ধি পাবে।
মায়েদের প্রতি কিছু পরামর্শ:
ডা. জহুরুল হক সাগর আরো জানান, শিশুকে কখনও জোর করে কিংবা বকা দিয়ে বা মারধর করে খাওয়ানো যাবে না। উৎসাহ দিয়ে, প্রশংসা করে শিশুকে খাওয়াতে হবে। মনে রাখতে হবে, কোনো কোনো সময় শিশুর বৃদ্ধির গতি কিছুটা কমে আসে অথবা শিশু মাঝেমধ্যে খেলাধুলা কমিয়ে দেয়। সেসব সময় শিশুর খাবারের চাহিদাও কমে আসে।
শিশুকে তার বয়স অনুযায়ী খাবার খেতে দিন।
মূল খাবারের মধ্যবর্তী সময়ে বাচ্চাকে স্ন্যাকস জাতীয় খাবার মূল খাবারের পরিমাণের বেশি খেতে দেবেন না।
বাচ্চাকে সব ধরনের খাবার খেতে উৎসাহ দিন। সাধারণ খাবারও সুন্দর করে সাজিয়ে দিলে শিশু খাবার খেতে আগ্রহী হবে।
খেয়াল রাখুন যেন খাবারের আইটেম প্রতিদিন একই রকম না হয়ে যায়, কারণ বাচ্চারা সবসময় এক রকম খাবার খেতে বিরক্তবোধ করে। তারা খাবারে নতুনত্ব চায়। তাই মাঝে মাঝে খাবারে পরিবর্তন আনুন।
খাবার দেয়ার শুরুতেই আপনার বাচ্চা পিপাষার্ত কি-না তা খেয়াল করুন। পিপাষার্ত বাচ্চা কখনো খাবার খেতে চাইবে না। তাই প্রথমে তাকে পানি খেতে দিন আর তার কিছুক্ষণ পর খাবার খেতে দিন। এতে ক্ষিধে আর হজম শক্তি দুই ই বাড়বে!
বাচ্চার ক্ষুধা পাবার জন্য সময় দিতে হবে। খাবার নিয়ে শিশুর পেছনে দৌড়ানো বন্ধ করতে হবে।
শিশুকে খাবার খাওয়ার সময় আনন্দ দিতে চেষ্টা করুন। মজার গল্প বলে খাওয়ান বাচ্চারা গল্প শুনতে খুব ভালবাসে। গল্প বোলে খাওয়ালে দেখবেন সে বেশ আগ্রহ সহকারেই খাচ্ছে। তবে সেটা প্রতিদিন করতে যাবেন না। একদিন গল্পের ছলে তো আরেক দিন খেলার ছলে খাওয়াতে পারেন।
যদি দেখেন সে এমনিতেই খাচ্ছে তাহলে তার মত করেই খেতে দিন। ছোট বাচ্চাদের খেতে দেয়ার সময় তাদের প্রিয় খেলনা কাছে রাখুন।
মনে রাখবেন ক্ষুদা পেলে সে নিজেই খাবে বা খাবার চাইবে। আর বাচ্চা ছোট হলেও তার নিজস্ব পছন্দ অপছন্দ থাকতে পারে খাবারের ব্যাপারে। খাবার সুস্বাদু না হলে আমাদের যেমন খাবার প্রতি আগ্রহ কমে যায় বাচ্চার জন্যও কিন্তু ব্যাপারটা একই। তাই পুষ্টিকর খাবার যেন সুস্বাদু হয় তা খেয়াল রাখবেন। একটু কষ্ট করে ঠিক মত পুষ্টিকর খাবার খাওয়ালেই দেখবেন আপনার সন্তান সুস্থ ও সুন্দরভাবে বেড়ে ওঠবে।