আর্চার নাজমিন খাতুন লড়াকু এক মা

2426

ঢাকা, ১৬ জুন, ২০২১ (বাসস) : যত ঝড়-ঝঞ্জাই আসুক না কেন কিছু-কিছু ব্যক্তি তার নির্দিষ্ট লক্ষ্যে এগিয়ে যাবেনই। কোন বাঁধাই যেন তাকে আটকাতে পারেনা। কিছুদিন আগে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে একটি ছবি ভাইরাল হয়েছিল। যেখানে দেখা গেছে খেলার বিরতিতে কোর্টের পাশেই চেয়ারে বসে এক মা তার সাত মাসের শিশুকে বুকের দুধ পান করাচ্ছেন। ভারতের মিজোরাম তুইকুম ভলিবল ক্লাবের মহিলা দলের অধিনায়ক লালভেন্তলুয়াঙ্গি ভেনি। লড়াকু এ মা খেলার সঙ্গে আপস করেননি। আবার খেলার মধ্যেই সন্তানকে সামলাচ্ছেন। এমনকি দলকেও সেদিন জিতিয়েছিলেন ভেনি। বাংলাদেশের আর্চার নাজমিন খাতুন যেন ভেনিরই প্রতিচ্ছবি।
কোলের সন্তানকে মাঠের পাশে রেখে নাজনিন অংশ নিয়েছেন বাংলাদেশ অলিম্পিক এসোসিয়েশন (বিওএ) আয়োজিত বঙ্গবন্ধু ৯ম বাংলাদেশ গেমসে। শুধু তাই নয়, বাংলাদেশ আনসারের হয়ে রিকার্ভ ইভেন্টে মেয়েদের এককে জিতেছেন রৌপ্য পদক।
নাজমিনের কোলে সন্তান আব্দুল্লাহ ইমনের বয়স পাঁচ মাস। সিজারের মাধ্যমে জন্ম হয়েছিল ইমানের। তারপরও সন্তান জন্মেও তিন মাসের মাথায় বাংলাদেশ গেমসে অংশগ্রহণের প্রস্তুতি শুরু করেন। শুরুতে গেমসে খেলার ইচ্ছা ছিলনা। কিন্তু আনসারের কোচ বাবুল মিয়া নাজমিনকে বলেন, ‘তুমিতো আনসারের একজন গুরুত্বপুর্ণ খেলোয়াড়। তোমাকে আমাদের দরকার।’
কোচের অনুরোধ উপেক্ষা করতে পারেননি। তাছাড়া বড় মঞ্চে নিজের প্রিয় ইভেন্টে নিজেকে চেনানোর তাগিদও ছিল ভেতরে। রাজশাহী থেকে চলে এলেন ঢাকায়। কিন্তু একেতো সন্তান সম্ভবা হওয়ার পর অনুশীলনে ছিলেন না। তাছাড়া সন্তান জন্মের পর কিছু শারিরীক জটিলতায় ছিলেন। তবু নিজকে ফিট রাখতে শুরু করেন কঠোর পরিশ্রম।
এই সময়ের কষ্টের কথা জানিয়ে নাজমিন বলেন,‘শুরুতে পেটে ব্যথা থাকতো। কিন্তু আমাদের কঠোর অনুশীলন করা লাগে। বাংলাদেশ গেমসে ভাল কিছু করতে হলে, কোচের আস্থার প্রতিদান দিতে হবে। এই ভেবে অনুশীলন চালিয়ে গেছি।
গাজিপুর শফিপুর আনসার একাডেমিতে চলতো আরচারির ক্যাম্প। অনুশীলন ক্যাম্প থেকে ১০ মিনিট হাঁটা দূরত্বে বাসা। সেখানে ছেলেকে রেখে আসতেন ছেলের বড় ফুপু রাহেলা বেগমের কাছে। রাহেলা বেগমের কাছে কৃতজ্ঞতার যেন শেষ নেই নাজমিনের,‘ তিনি না থাকলে আমার হয়তো এই গেমসে খেলাই হতো না। উনি আমাতে সাহায্য না করলে এভাবে অনুশীলনও করতে পারতাম না। ভাল কিছু অর্জন করতেও পারতাম না।’ বাংলাদেশ গেমসেও টঙ্গীর আহসান উল্লাহ মাস্টার স্টেডিয়ামে মাঠের একপাশে রাহেলা বেগমের কোলে থাকতো ছেলে।
নাজমিন বলছিলেন,‘বুলস আইয়ে চোখ থাকলেও মনটা পড়ে থাকতো ছেলের কাছেই। খুব খারাপ লাগতো তখন। ভাবতাম ছেলে এই বুঝি ঘুম থেকে উঠে মাকে খুঁজছে। দুধপান করিয়ে আসতাম গিয়ে।’
ছেলের পাশাপাশি সামনে দেখতেন পদক মঞ্চ। নাজমিন বলেন,‘ মনের দিক থেকে সাহস দিতেন বাবুল স্যার, কোচ অনি চাকমা। রায়হান স্যারও (আনসারের ক্রীড়া পরিচালক রায়হান উদ্দিন)। তাদের উৎসাহ আর অনুপ্রেরণায় ফাইনালে উঠি।’
ক্যারিয়ারে পঞ্চমবারের মতো কম্পাউন্ডের একক ইভেন্টের ফাইনালে উঠেছেন। কিন্তু স্বর্ণপদক জেতা হয়নি কখনোই। এবারতো সন্তানকে সঙ্গে নিয়ে খেলতে হয়েছে। তবু আশা করেছিলেন স্বর্ণ জিতবেন। খেলা শেষে নাজমিন বলছিলেন,‘এতবার ফাইনালে উঠলাম, কিন্তু সোনা জিততে পারিনি।’ ছোট ছেলেকে সঙ্গে নিয়েই গত মাসে অংশ নেন কক্সবাজারে জাতীয় আরচারি চ্যাম্পিয়নশীপে। ছেলেকে নিয়ে ১৮ ঘন্টার ভ্রমণের পর একটু অসুস্থ হয়ে পড়েন নাজমিন, ‘১৩ দিনের অনুশীলনে রুপা জিতে কক্সবাজারে। ওখান থেকে আসার পর সর্দি, জ্বর আর কাশি হয়েছিল আমার ও ছেলের। ৮-৯দিন অনুশীলন করতে পারিনি। এখনো শরীর কিছুটা দুর্বল।’
এতো লড়াই সংগ্রামের পরও যে রুপা জিতেছেন তাতেই খুশি নাজমিন। মা হিসেবে জিতেছি এটা অবশ্যই গর্বের একটা বিষয়। এটা আমার জন্য বড় সাফল্য।’
২০০৯ সালে আনসারের চাকরিতে যোগ দেন নাজমিন। অনেকে খেলাধুলার মাধ্যমে চাকরি পেলেও নাজমিন আগে চাকরির সুযোগ পান। এরপর যোগ দেন আরচারি খেলায়। প্রাথমিক বাছাইয়ে ৩০ জনের মধ্যে হয়েছেন সেরা। এরপর আর ফিরে তাকাতে হয়নি। ২০১৪ সালে আরচারির উন্নত প্রশিক্ষণের জন্য ফেডারেশন তাকে দিল্লি পাঠিয়েছিল। জাতীয় দলের হয়ে খেলতে গেছেন ইন্দোনেশিয়া, চীন, ইতালি, ইরান থাইল্যান্ড ও ভারতে। ২০১৮ সালে পারিবারিকভাবে বিয়ে হয় জুয়েল রানার সঙ্গে। খেলাধুলার পাশপাশি ২০১৬ সালে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ¯œাতকোত্তর পাশ করেছেন।
খেলাধুলা, ঘরকন্না ও চাকরি এক সাথে এতো কিছু সামলান কীভাবে? প্রশ্নটা করতেই হেসে বললেন,‘ আমি যেটাই করি খুব মনযোগ দিয়ে করার চেষ্টা করি। নিজের পরিবার, শ্বশুরবাড়ি, স্বামী সবাই আমাকে খুব সমর্থন ও সহযোহিতা করে। মেয়ে বলে কেউ কখনো কিছুতে বাঁধা দেয়নি। এটা আমার সবচেয়ে বড় অনুপ্রেরণা।’