উন্নয়নের মূলস্রোতে তৃণমূলের নারীরা

2305

ঢাকা, ৮ জুন, ২০২১ (বাসস) : বাংলাদেশের মোট জনগোষ্ঠীর অর্ধেক নারী। এই অর্ধেক জনগোষ্ঠীকে দূরে রেখে সুষম উন্নয়ন কোনোদিনই সম্ভব নয়। সুষম উন্নয়নের অপরিহার্য পূর্বশর্ত জাতীয় উন্নয়নের মূল স্রোতধারায় নারীর সম্পৃক্ততা ও সার্বিক ক্ষমতায়ন নিশ্চিত করা। আর এ বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে দেশের সর্বক্ষেত্রে নারীর অংশগ্রহণ নিশ্চিত করার উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। ফলে উন্নয়নের মূলস্রোতে যুক্ত হচ্ছেন তৃণমূলের নারীরা।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, নারীর উন্নয়নের বিষয়টি বিবেচনায় নিয়েই জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশের সংবিধানে নারী-পুরুষের সমঅধিকার নিশ্চিতের পাশাপাশি স্বাধীনতা যুদ্ধে নির্যাতনের শিকার ও ক্ষতিগ্রস্ত নারীদের পুনর্বাসনের জন্য গঠন করেন বাংলাদেশ নারী পুনর্বাসন বোর্ড।
পরবর্তীতে জাতীয় সংসদে আইন পাসের মাধ্যমে নারী পুনর্বাসন বোর্ডকে বাংলাদেশ নারী পুনর্বাসন ও কল্যাণ ফাউন্ডেশন করা হয়। বিভিন্ন ধাপ অতিক্রম করে আজ তা মহিলা বিষয়ক অধিদপ্তর। সমাজে নারীর কল্যাণে এই অধিদপ্তরের উদ্যোগে নানা পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে।
১৯৯০ সালে প্রতিষ্ঠার পর থেকেই মহিলা বিষয়ক অধিদপ্তর জেন্ডার সমতাভিত্তিক সমাজ প্রতিষ্ঠা ও সুরক্ষার রূপকল্প আর নারী ও শিশুর অধিকার প্রতিষ্ঠা এবং ক্ষমতায়নসহ উন্নয়নের মূলধারায় নারীদের সম্পৃক্তকরণের অভীষ্ট নিয়ে কাজ করে চলেছে।
মহিলা বিষয়ক অধিদপ্তরের মহাপরিচালক রাম চন্দ্র দাশ বলেন, নারীর আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন, সামাজিক সুরক্ষা ও স্বাস্থ্য সচেতনতা বৃদ্ধি ও লিঙ্গ সমতামূলক কার্যক্রম, মানবসম্পদ উন্নয়ন ও আত্মকর্মসংস্থান, দারিদ্র্যবিমোচন ও কর্মসংস্থান সৃষ্টি, নারী ও শিশু নির্যাতন প্রতিরোধসহ প্রাতিষ্ঠানিক সুবিধাদি ও সেবা প্রদানের বহুমুখী কর্মসূচি হাতে নেয়া হয়েছে।
এছাড়া তৃণমূলে সুবিধাবঞ্চিত নারীদের কর্মসংস্থান সৃষ্টির মাধ্যমে স্বাবলম্বী করার লক্ষ্যে প্রশিক্ষণ, আর্থিক সহায়তা, সেলাই মেশিন প্রদান ও বিভিন্ন ধরনের ভাতা দেয়া হচ্ছে বলে জানান তিনি।
ছয়টি গুচ্ছে তৃৃণমূলের নারীদের উন্নয়নের মূল ¯্রােতে সম্পৃক্ত করতে কাজ করছে অধিদপ্তর। এর মধ্যে ভিজিডি কর্মসূচি অন্যতম। দেশের দারিদ্র্যপীড়িত এবং দুস্থ গ্রামীণ নারীদের আর্থ-সামাজিক, উন্নয়ন, বিদ্যমান খাদ্য নিরাপত্তাহীনতা এবং নিম্ন সামাজিক মর্যাদার অবস্থানকে সফলভাবে অতিক্রম করে যেন চরম দারিদ্র্য স্তরের উপরের স্তরে টিকে থাকার সক্ষমতা অর্জন করতে পারে- সেজন্য ভিজিডি কর্মসূচি বাস্তবায়িত হচ্ছে।
এ কর্মসূচির উদ্দেশ্য প্রসঙ্গে অধিদপ্তরের ডিজি রাম চন্দ্র দাশ বলেন, গ্রামীণ দুস্থ পরিবারসমূহের দৈনন্দিন খাদ্য চাহিদা পূরণে সহায়তা এবং বিপণনযোগ্য দক্ষতা বৃদ্ধিকল্পে প্রশিক্ষণের সুযোগ সৃষ্টি করতে এ উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। এছাড়া সঞ্চয়ের মাধ্যমে বিনিয়োগের প্রারম্ভিক মূলধন সংগ্রহের জন্য উৎসাহিত এবং ঋণ প্রাপ্তিতে সুযোগ-প্রদানের মাধ্যমে তাদের উপার্জনক্ষম করে গড়ে তোলাই এ কর্মসূচির উদ্দেশ্য।
জানা যায়, গত অর্থবছরে এ প্রকল্পের জন্য এক হাজার ৭১৯ কোটি ৮৪ লাখ ১৭ হাজার টাকা বরাদ্দ দেয়া হয়। এর মাধ্যমে খাদ্য সহায়তার আওতায় ১০ লাখ ৪০ হাজার জন ভিজিডি উপকারভোগী মহিলাকে মাসিক ৩০ কেজি হারে তিন লাখ ৭৪ হাজার ৪০০ টন চাল বিতরণ করা হয়েছে। আর নির্বাচিত ৪৫৬টি এনজিওর মাধ্যমে নারীদের আয়বর্ধক ও দক্ষতা উন্নয়নমূলক প্রশিক্ষণ দেয়া হয়েছে।
ভিজিডি কর্মসূচির আওতায় গ্রামীণ দরিদ্র মহিলাদের নয়টি মডিউলের মাধ্যমে জীবন দক্ষতা ও জীবিকা নির্বাহভিত্তিক প্রশিক্ষণ দেয়া হয়েছে। এর মাধ্যমে উপকারভোগীদের একদিকে যেমন সামাজিকভাবে সচেতন করছে অন্যদিকে এসব নারীকে ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা হিসেবে গড়ে তোলার জন্যও উৎপাদনমুখী কর্মকা-ে সম্পৃক্ত করা হচ্ছে।
নেত্রকোণা জেলার সাতপাই এলাকার উপকারভোগী নারী সালেহা বেগম বলেন, আমি প্রশিক্ষণ নিয়েছি। এখন নিজে টেইলার্সের কাজ করছি। এতে আমার পরিবার স্বচ্ছল হয়েছে।
ভিজিডি উপকারভোগী মহিলারা সঞ্চয় ব্যবস্থাপনা কার্যক্রমের আওতায় মাসে দুইশ টাকা হারে তাদের নিজস্ব হিসাবে জমা রাখছেন, যা ক্ষুদ্র ব্যবসা পরিচালনায় প্রারম্ভিক মূলধন হিসেবে কাজ করে। এছাড়া সর্বপ্রথম কুড়িগ্রাম জেলার সদর উপজেলায় পাইলট কার্যক্রম হিসেবে ভিজিডি উপকারভোগী মহিলাদের অনুকূলে রাইস ফর্টিফিকেশন কার্যক্রম শুরু হয়, যা ধাপে ধাপে বৃদ্ধি পেয়ে বর্তমানে সারা দেশে ১১০টি উপজেলায় সম্প্রসারিত হয়েছে। এ প্রকল্পের কারিগরি সহযোগিতা দিয়েছে বিশ্বখাদ্য কর্মসূচি।
ভিজিডি উপকারভোগী মহিলাদের পুষ্টির অভাব দূর করতে বর্তমানে সাধারণ চালের সাথে ছয়টি মাইক্রো নিউট্রেন্ট (ভিটামিন এ, বি১, বি১২, আয়রন, ফলিক এসিড, জিংক) মিশ্রণপূর্বক পুষ্টি চাল প্রস্তুত করে (ফর্টিফাইড রাইস) বিতরণ করা হচ্ছে। অবশ্য এটি পাইলট প্রকল্প। এতে উপকারভোগীদের পরিবারের সদস্য তথা মহিলা, শিশু ও বয়স্কদের অভাবজনিত অপুষ্টির উপাদানের পরিমাণ কমে আসবে।
রাম চন্দ্র দাশ বলেন, নারীর আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন ও সামাজিক সুরক্ষা এবং স্বাস্থ্য সচেতনতা কর্মসূচির অংশ হিসেবে কর্মজীবী ল্যাকটেটিং মাদার সহায়তা তহবিল, জয়িতা অন্বেষণে বাংলাদেশ কার্যক্রম, বিক্রয় ও প্রদর্শনীকেন্দ্র, অঙ্গনা, সেলাই মেশিন বিতরণ, স্বেচ্ছাসেবী মহিলা সমিতি নিবন্ধন, নিয়ন্ত্রণ ও অনুদান বিতরণ, দরিদ্র মায়ের জন্য মাতৃত্বকাল ভাতা, মা ও শিশু সহায়তা কর্মসূচি বাস্তবায়নের মাধ্যমে নারীদের উন্নয়নের স্রোতধারায় সম্পৃক্তকরণে নানা কর্মসূচি চলমান রয়েছে।
এ বিষয়ে মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সাবেক প্রতিমন্ত্রী মেহের আফরোজ চুমকি বলেন, নারীর উন্নয়নে সরকারের পক্ষ থেকে বিভিন্ন উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। তবে জাতীয়ভাবে নারীর সুষম অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে হলে অবশ্যই পুরুষদেরও মনোভাবের পরিবর্তন করতে হবে। ধর্মের অপব্যাখ্যা দিয়েও নারীদের পেছনে ঠেলে দেয়া হয়। এসব অপব্যাখ্যা পরিহার করতে হবে। তবেই এগিয়ে যাবে বাংলাদেশ।