জীবন সংগ্রামে জয়ী স্বাবলম্বী নারী সুমনার গল্প

2256

ঢাকা, ১৯ এপ্রিল, ২০২১ (বাসস) : রোকেয়া পারভীন সুমনা নারী উদ্যোক্তা ও কুটির শিল্পের প্রশিক্ষক। ছোটবেলা থেকেই মায়ের কাছে দেখেছেন কীভাবে সংগ্রাম করতে হয়। তিনিও সংগ্রাম করে নিজের জীবন বদলে দিচ্ছেন। পাশাপাশি প্রশিক্ষণের মাধ্যমে বদলে দিচ্ছেন রাজশাহী শহরের হাজারো মেয়ের জীবন।
সম্প্রতি নিজেই জানালেন তার এই উদ্যোক্তা তৈরির গল্পের কথা। তার ভাষ্য, রাজশাহী শহরেই বেড়ে উঠেছি। এই শহরে কোনো শব্দ দূষণ নেই, নেই যানজট। একটি পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন শহর। ‘এই শহরে যাতে নারীরাও স্বাচ্ছন্দ্যে জীবন-যাপন করতে পারে, স্বাবলম্বী হতে পারে সেজন্য তাদের নানা উদ্যোগ ও পণ্য তৈরির বিষয়ে প্রশিক্ষণ দিই আমি।’
পাটপণ্য তৈরির বিষয়ে সাধারণত প্রশিক্ষণ দেন সুমনা। আর তা শুধু রাজশাহীই নয়, দেশের বিভিন্ন এলাকায় নারীদের দক্ষতা উন্নয়নে প্রশিক্ষণ কর্মকান্ড পরিচালনা করেন তিনি। তিনি বলেন, রাজশাহী শহরের নারীদের এগিয়ে নিতে ও স্বাবলম্বী করতে পাটপণ্যের বিষয়ে নানাধরনের দেয়া হয়। এ ট্রেনিং পেয়ে তারা নিজেকে দক্ষ ও যোগ্য উদ্যোক্তা হিসেবে গড়ে তুলতে পারবে। নিজের পরিচয়ে পরিচিত হতে পারবে সবার সামনে। পাট ও পাট জাত পণ্যের উপর হাতেকলমে প্রশিক্ষণ দেয়া হয়।
সুমনার বাড়ি রাজশাহী শহরে। তার বাবা মৃত মো. লুৎফুল বারী। তিনি বলেন, এক সময় আমার বাবাসহ পরিবারের লোকজনকে সবাই চিনতো। অথচ আমি তার মেয়ে হলেও আমাকে অনেকেই চিনে না।
‘আমিও চাই বাবার মেয়ে ও স্বাবলম্বী হিসেবে এবং সফল উদ্যোক্তা হিসেবে আমাকে সবাই চিনুক। এবার আমার সেই আশা পূর্ণ হলো। আমরা নারীরা শত কষ্টের মাঝেও হাসতে এবং নিজের পরিবারকে ভালো রাখতে জানি। এরপরও নিজের একটা পরিচয় চাই।’
সুমনা বলেন, আমি সব সময় ট্রেনিংয়ে নারীদের কষ্টের জীবনের গল্প শুনি। একজন নারী জীবনে কত পরিশ্রম করে নিজের একটা পরিচয়ের জন্য তা আমি অনেকের কাছ থেকেই শুনেছি।
তিনি বলেন,‘দু’জন নারীর কাছ থেকে শুনেছি যাদের সাজানো গুছানো সংসার ভেঙে যায়। খালি হাতে তাদের স্বামীর ঘর থেকে বেরিয়ে আসতে হয়। তারা জীবনে ঘুরে দাঁড়াতে অনেক সংগ্রাম করেছেন। এক পর্যায়ে আমাদের একটি ট্রেনিংয়ে অংশ নিয়ে পাটপণ্য তৈরির প্রক্রিয়া শেখেন। এখন নিজেরা পাটের বিভিন্ন পণ্য তৈরি করে আয় করছেন। ভালোভাবে জীবন-যাপন করছেন। এতে আমার অনেক আনন্দ ও গর্ব হয়’।
সাধারণত কারা প্রশিক্ষণ নিতে আসেন প্রশ্ন করা হলে প্রশিক্ষক ও উদ্যোক্তা সুমনা বলেন, এখানে কেউ ছাত্রী আবার কেউ চাকরির পাশাপাশি পাটের নানা পণ্য তৈরির কাজ শিখছে। অনেকে আছে যারা স্বামী পরিত্যক্তা। তারা সংগ্রাম করছেন একটু বেঁচে থাকার জন্য, ছেলে-মেয়ের মুখে একটু খাবার তুলে দেয়ার জন্য।
প্রশিক্ষক সুমনা বলেন,‘আমি যখন তাদের চোখের দিকে তাকাই তখন দেখি কতটা অসহায় তারা। আমার দিকে অনেক স্বপ্ন নিয়ে তাকিয়ে থাকে এই নারীরা। তাদের কিছু শেখাতে পারলেই ভালো লাগে’।
মোহনপুরের মৌগাছির সুফিয়া আক্তার, উপশহরের আফিয়া এবং নগরীর ঝর্না খাতুন সুমনার কাছ থেকে প্রশিক্ষণ নিয়েছেন। শুধু ঝর্না কিংবা সুফিয়াই নয়, পাটসহ বিভিন্ন বিষয়ে প্রশিক্ষণ নিয়ে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র উদ্যোগে ভাগ্য ঘুরিয়েছেন রাজশাহীর শত শত নারী।
জীবন সংগ্রামে জয়ী হয়ে নিজেরা যেমন স্বাবলম্বী হচ্ছেন, পাশাপাশি অন্যদের পরিবারেও স্বচ্ছলতা আনতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছেন তারা।
ঝর্না বলেন, স্বামীর সঙ্গে বনিবনা না হওয়ায় সংসার টেকেনি। বাবার বাড়ি চলে আসি। কিন্তু দরিদ্র বাবার পরিবারে আমি ছিলাম বোঝা। এখন পাটের ব্যাগ তৈরি করে নিজের ভাগ্য ঘুরিয়েছি। আমার এখানে তিনজন বিধাবা নারীর কর্মসংস্থানও করেছি।
রাজশাহী উইমেন চেম্বার অব কর্মাস অ্যাসোসিয়েশনের সাবেক সভাপতি রোজিটি নাজনীন বলেন, রাজশাহীর নারীরা অনেক পিছিয়ে রয়েছেন। তবে আশার কথা তারা এখন বিভিন্ন ধরনের প্রশিক্ষণ নিয়ে ছোট আকারে হলেও নানা উদ্যোগ নিচ্ছেন। এটা ভালো দিক। এক্ষেত্রে সুমনার উদ্যোগও বেশ প্রশংসার।
নারীদের ক্ষমতায়ন নিশ্চিত করতে বর্তমান সরকারের যে বহুমুখী উদ্যোগ বাস্তবায়ন অব্যাহত রয়েছে, তা আরো বাড়ানো ও কার্যকর করার জন্য সরকারের প্রতি অনুরোধ জানান তিনি।
জেলা মহিলা বিষয়ক কর্মকর্তা সাহানাজ বেগম বলেন, রাজশাহীতে প্রতিবছর ২শ’ নারীকে পাঁচটি ক্যাটাগরিতে প্রশিক্ষণ দেয়া হয়। এগুলো হচ্ছে আধুনিক দর্জি বিজ্ঞান ও এমব্রয়ডারি, মোবাইল ফোন সার্ভিসিং, খাদ্যদ্রব্য প্রক্রিয়াজতকরণ এবং কাগজের ঠোঙ্গা তৈরি। এছাড়া বেসরকারি ও ব্যক্তি উদ্যোগেও পাটপণ্য তৈরিসহ নানা প্রশিক্ষণ দেয়া হচ্ছে। এসব প্রশিক্ষণ নিয়ে নারীরা এগিয়ে যাচ্ছেন বলে জানান তিনি। সাহানাজ আরো বলেন, নারীর কল্যাণ ও উন্নয়নে যেকোনো ধরনের সহযোগিতা করা হবে।