নেত্রকোনায় বাল্য বিবাহ রুখে দিচ্ছে ‘নারী উন্নয়ন ফোরাম’

1387

ঢাকা, ১৮ এপ্রিল, ২০২১ (বাসস) : নেত্রকোনা জেলার কলমাকান্দা উপজেলার রাংছাতি ইউনিয়ন পরিষদের মহিলা মেম্বার মোমেনা খাতুন। একদিন হঠাৎ করেই জানতে পারেন, তার গ্রাম চৈতন্যপুর থেকে মাত্র দুই কিলোমিটার দূরে রামনাথপুর গ্রামে বাল্য বিয়ের আয়োজন চলছে। খবরটি শুনেই বসে থাকতে পারলেন না মোমেনা।
তিনি বলেন, গত বছরের ১৯ সেপ্টেম্বর আমার এক শুভাকাক্সক্ষী জানান, রামনাথপুর গ্রামে মাত্র ১৬ বছর বয়সী কলি আক্তার নামের এক মেয়ের বিয়ে ঠিক হয়েছে। এক প্রকার জোর করেই বিয়ে দেয়া হচ্ছে তাকে। আর বিয়ের অনুষ্ঠানের জন্য সবকিছুই প্রস্তুত। আমি খবরটি শোনার পর দ্রুত সেই এলকায় যাই এবং স্থানীয় পুলিশের সহায়তায় বিয়েটি বন্ধ করি।
ওই বাল্য বিয়ে বন্ধের অভিজ্ঞতার বর্ণনা করতে গিয়ে মোমেনা বলেন, বিষয়টি খুব একটা সহজ ছিল না। আমি গেলাম আর তারা আমার কথা শুনে বিয়ে বন্ধ করে দিল-এমন ভাবার কোন কারণ নেই। সে সময় আমি প্রথমে স্থানীয় নেতা এবং মেয়ের পরিবারের অভিভাবকদের সঙ্গে কথা বলি। তাদেরকে অনুরোধ করি বিয়ে বন্ধ করার জন্য। তাদেরকে বুঝাই যে, বাল্য বিয়ে একটি অপরাধ। আর এতে মেয়েটিরই সমস্যা বেশি হবে। সে শারীরিক এবং মানসিক দুই ভাবেই ক্ষতিগ্রস্থ হবে। কিন্তু, তারা আমার কোন কথাই শোনেননি। উপরন্তু আমাকে অপমান করে। তারা আমাকে চোখ বন্ধ রাখার পরামর্শ দেয় আর নিজের কাজ করতে বলে।
মোমেনা বলেন, কিন্তু, আমি দমে যাইনি। এরপর আমি রাংছাতি ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যানের সাথে দেখা করি। তিনি আমাকে বেশ কিছু পরামর্শ দেন। তার পরামর্শ অনুযায়ী আমি স্থানীয় নারী ও শিশু অধিদপ্তরের অফিসে ফোন দিই। তাদেরকে বিষয়টি খুলে বলি এবং বাল্য বিয়েটি বন্ধে সহযোগিতা চাই। অবশেষে স্থানীয় থানা থেকে পুলিশ পাঠানো হয়। পরে তারাই বিয়েটি বন্ধ করে।
তিনি জানান, গত দু’মাসে দুটি বাল্য বিয়ে বন্ধ করেছেন তার একক প্রচেষ্ঠায়।
মোমেনা খাতুনের বাল্য বিয়ে বন্ধের এই উদ্যোগ দেখেই অনেকটা উৎসাহ পান কলমাকান্দা ইউনিয়ন পরিষদের আরেক মহিলা মেম্বার পারুল আক্তার। এক মাস আগে তিনি জানতে পারেন পেঁচামারি গ্রামে অষ্টম শ্রেনীতে পড়–য়া এক ছাত্রীর বিয়ে ঠিক হয়েছে। অপ্রাপ্ত বয়স্ক জহুরা খাতুনকে এক প্রকার জোর করেই ফোনের মাধ্যমে বিয়ে দেওয়া হয় চান্দাইল গ্রামের বাবুল মিঞার সাথে।
পারুল বিষয়টি উপজেলা নির্বাহী অফিসারকে (ইউএনও) জানান। ইউএনও বিষয়টি জানার পর বিয়ের দিন তার নেতৃত্বে একটি মোবাইল কোর্ট পরিচালনা করা হয়। তিনি বিয়েটি বন্ধ করেন এবং মোবাইল কোর্টের মাধ্যমে তিন ব্যক্তিকে এই ঘটনার সাথে জড়িত থাকার অপরাধে শাস্তি প্রদান করেন ।
পারুল বলেন, এ সময় বিয়ে রেজিষ্ট্রার খায়রুল কবিরকে ৩০ হাজার টাকা এবং বর এবং কনের অভিভাবককে ৫০ হাজার টাকা করে জরিমানা করা হয়।
কলমাকান্দা উপজেলার মহিলা ভাইস চেয়ারম্যান আফরোজা বেগম শিমু বলেন, এলাকার সকল নারী জন প্রতিনিধিকে নিয়ে ‘নারী উন্নয়ন ফোরাম’ নামের একটি সংগঠন করা হয়েছে এখানে। এতে টেকনিক্যাল সাপোর্ট দিচ্ছে ইউএনডিপি’র এফিসিয়েন্ট এন্ড একাউন্টেবল এন্ড লোকাল গভর্নেন্স (ইএলজি) প্রোজেক্ট। বর্তমানে এই সংগঠনের সবাই এই এলাকায় বাল্য বিয়ে বন্ধ এবং নারী নির্যাতন প্রতিরোধে কাজ করছেন।
তিনি বলেন, অন্যান্য জায়গার তুলনায় এখানে বাল্য বিয়ে এবং নারী নির্যাতনের হার একটু বেশি। মূলত শিক্ষার অভাব এবং অজ্ঞতার কারণেই এসব সমস্যা এখানে বেশি।
তবে, গত বছরের প্রথম দিকে নারী উন্নয়ন ফোরাম গঠনের পর থেকে এই উপজেলায় বাল্য বিয়ে এবং নারী নির্যাতন অনেকাংশে কমে এসেছে। আমার নিজেরাই অনেক বাল্য বিয়ে বন্ধ করতে সফল হয়েছি।
ইউএনপিপি’র কর্মকর্তা মো. আব্দুর রাজ্জাক বলেন, কলমাকান্দায় এমন অনেক এলাকা রয়েছে যেখানে অনেক নি¤œ আয়ের মানুষ বসবাস করেন। মূলত, কম শিক্ষার হার, কর্মসংস্থানের অভাব এবং স্থানীয়দের মধ্যে সচেতনতার অভাবই এই বাল্য বিয়ে এবং নারী নির্যাতনের হার কিছুটা বেশি এই অঞ্চলে।
তিনি বলেন, তবে, বর্তমানে স্থানীয় অনেক সরকারি প্রতিষ্ঠান এবং প্রশাসন এই বাল্য বিয়ে এবং নারী নির্যাতন বন্ধে কাজ করে চলছে। তবে, আরো বেশি পরিমাণ সচেতনতামূলক কার্যক্রম চালানোর ওপর তিনি জোর দেন।