বাসস দেশ-২ : মুক্তিযুদ্ধে প্রথম প্রতিরোধে বরিশাল

169

বাসস দেশ-২
বরিশাল-প্রথম-প্রতিরোধ
মুক্তিযুদ্ধে প্রথম প্রতিরোধে বরিশাল
॥ শুভব্রত দত্ত ॥
বরিশাল, ১ এপ্রিল, ২০২১ (বাসস) : যে কোন মুহূর্তে পাকবাহিনী আক্রমণ করতে পারে এমন সংবাদের ভিত্তিতে বরিশালের মুক্তিযোদ্ধারা সচেতন হয়ে উঠে। ৯নং সেক্টরের অকুতোভয় বীর মুক্তিযোদ্ধারা প্রতিরোধ গড়ে তোলে। সেই প্রতিরোধের বিরুদ্ধে প্রাথমিকভাবে দু’টো যুদ্ধ হয়। এ দু’টি যুদ্ধ ‘জুনাহার যুদ্ধ’ ও ‘চরবাড়িয়া যুদ্ধ’ নামে পরিচিত।
এ প্রসঙ্গে মুক্তিযুদ্ধকালীন শহর ছাত্রলীগ সভাপতি বীর মুক্তিযোদ্ধা এনায়েত হোসেন চৌধুরী, বিভাগীয় সেক্টর কমান্ডার ফোরামের আহ্বায়ক বীর মুক্তিযোদ্ধা প্রদীপ কুমার ঘোষ পুতুল ও মহানগর আওয়ামী লীগের মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক সম্পাদক ও যুদ্ধাহত বীর মুক্তিযোদ্ধা এ.এম.জি. কবির ভুলু জানান, ২৫ এপ্রিল ১৯৭১ পাকবাহিনী জলে-স্থলে ও আকাশ পথে বরিশালের ওপর ত্রিমুখী আক্রমণ চালায়। পাকবাহিনীর ধারণা ছিল বরিশাল, পটুয়াখালী মুক্তিযোদ্ধাদের শক্ত ঘাঁটি। তাই, তারা শক্তিশালী বাহিনী নিয়ে বরিশালে আক্রমণ চালায়।
পাকিস্তানের নৌবাহিনী ২৫ এপ্রিল বেলা ১১ টা ৪৫ মিনিটে জুনাহার আক্রমণ করে। সায়েস্তাবাদ নদী হতে জুনাহার হয়ে কীর্তনখোলা নদীতে যেতে হয়। জুনাহারের পশ্চিমে সায়েস্তাবাদ এবং পূর্ব দিকে চরমোনাই ইউনিয়ন এবং দক্ষিণ-পশ্চিমে চরবাড়িয়া ইউনিয়ন ও তালতলী। জুনাহারের পশ্চিম পাড়ে হবিনগর, পূর্ব পাড়ে রাজাপুর এবং দক্ষিণ পাড়ে ফোটকার চরে বীর মুক্তিযোদ্ধারা অবস্থান নেয় জুনাহার নদীর দু’পারে ইরানী ও মাজভী স্টিমারে। পৃথকভাবে বীর মুক্তিযোদ্ধারা হবিনগর ওয়াজেদ হাওলাদারের বাড়ি, তালতলীর কাছে নাজির বাড়ির স্কুল ও একদল বেলতলায় অবস্থান নেয়। লে. ইমাম আলী মেহেদী, লে. নাসির ও ফ্লাইট সার্জেন্ট মুহাম্মদ ফজলুল হক মুক্তিযোদ্ধাদের এই দলগুলোকে পরিচালনা করেন।
সার্বিক দায়িত্বে ছিলেন তৎকালীন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও ৯নং সেক্টরের এমএনএ নূরুল ইসলাম মঞ্জুর। তিনি তালতলী অবস্থান করছিলেন। প্রথমে গানবোট হতে সায়েস্তাবাদ ইউনিয়নের হবিনগর ও পার্শ্ববর্তী গ্রামে গোলা বর্ষণ শুরু হয়। মুক্তিযোদ্ধারা তাদের ৩ নট ৩ রাইফেল দিয়ে পাল্টা আক্রমণ চালায়। গানবোট ঘায়েল করার জন্য তাদের কোন অস্ত্র ছিল না। কিছুক্ষণের মধ্যে গোলার আঘাতে স্টিমার ইরানী ও মাজভী ডুবে যায়। আজও স্টীমার দুটো জুনাহারের দু’পারে ডুবে আছে।
বীর মুক্তিযোদ্ধারা আরো জানান, নৌবাহিনীর ভারী অস্ত্রের আক্রমণে মুক্তিবাহিনীর বাংকার ধ্বংস হয়ে যায় এবং অনেকে নিহত ও আহত হয়। জুনাহার ইছাকাটির আবদুল মোতালেব আকন্দ, গৌরনদী থানার স্যারালের সিপাহী সিরাজুল ইসলাম প্রমুখ সম্মুখ যুদ্ধে শহীদ হন। মুক্তিযোদ্ধারা ভারী অস্ত্রের সাথে টিকতে না পেরে পিছু হটে যায়। ৩ ঘন্টা যুদ্ধের পর জুনাহারে মুক্তিবাহিনীর ঘাঁটির পতন হয়। মুক্তিবাহিনী জুনাহার ত্যাগ করার পরও পাকিস্তানী নৌবাহিনী জুনাহার অতিক্রম করার সাহস পায়নি। ২৬ এপ্রিল ভোরে তারা বরিশাল আইডব্লিউটি ঘাটে পৌঁছে।
অপরদিকে, বরিশাল সদর থানার লামচরী, তালতলী, চরবাড়িয়া, মহাবাজ, উলানঘুনী, মতাসার, কাগাশুরা, বাটনা, আমীরগঞ্জ, প্রভৃতি গ্রাম নিয়ে চরবাড়িয়া ইউনিয়ন। পাকবাহিনীর আক্রমণ প্রতিরোধে মেজর এমএ জলিলের রণকৌশল অনুযায়ী বরিশাল শহরতলিতে অবস্থিত চরবাড়িয়া ইউনিয়নের মহাবাজ বিদ্যালয়ে মুক্তিবাহিনীর ক্যাম্প প্রতিষ্ঠা করা হয়। প্রায় ২’শ ৫০ জন মুক্তিযোদ্ধা এ ক্যাম্পে অবস্থান করছিল। ক্যাম্প পরিচালনায় ছিলেন ফ্লাইট সার্জেন্ট ফজলুল হক এমপিএ, ক্যাপ্টেন মেহেদী আলী ইমাম, সুবেদার পঞ্চম আলী।
সায়েস্তাবাদ হাইস্কুলে ট্রেনিংয়ের দায়িত্বে ছিলেন আনসার কমান্ডার আবদুল ওয়াজেদ হাওলাদার। আক্রমণ প্রতিরোধে আরও ছিল ৫ মাইল উত্তর-পূর্ব কোনে জুনাহার ঘাঁটি। ২৫ এপ্রিল দুপুরে জুনাহার ঘাঁটি আক্রমণের অল্প সময়ের মধ্যে পাকবাহিনী চরবাড়িয়া আক্রমণের জন্য দুটি হেলিকপ্টারে ছত্রী সেনা আসে। জুনাহারে আক্রমণের আধ ঘন্টার মধ্যে তালতলীর পূর্ব পাশে মাঠে ছত্রী সেনা নামানো হয়। এবার পাকবাহিনী নৌ, বিমান ও স্থল বাহিনীর সমন্বয়ে বরিশাল আক্রমণ করতে থাকে। তালতলীর পশ্চিমে গানবোট নোঙর করা হয়। পাকবাহিনী গানবোট থেকে ভারী অস্ত্র নামিয়ে আনে। পাকবাহিনী প্রচন্ড ভাবে গুলিবর্ষণ করে। তখন সমগ্র এলাকায় ভয়ঙ্কর ভীতি ও আতঙ্ক সৃষ্টি হয়। পাকসেনারা যাকে সামনে পেয়েছে তাকেই গুলি করে হত্যা করে। ৯০ বছরের বৃদ্ধাকেও বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে হত্যা করেছে। পাকবাহিনী মহাবাজে নাজির বাড়ির মুক্তিবাহিনীর ক্যাম্প আক্রমণ করে। ৩ ঘন্টা যুদ্ধ করে মুক্তিবাহিনী পিছু হটে যায়।
আলাপকালে নবম সেক্টরের সাব সেক্টর কমান্ডার বীর মুক্তিযোদ্ধা লে. মাহফুজ আলম বেগ বাসস’কে বলেন, পাকসেনারা চরবাড়িয়া, কাগাশুরা, সাপানিয়া, পুরান পাড়ায় গণহত্যা, ঘর বাড়িতে অগ্নি-সংযোগ করে বরিশাল শহরের দিকে অগ্রসর হতে থাকে। চরবাড়িয়া ইউনিয়ন জনশূন্য হয়ে পরে। তাৎক্ষণিকভাবে বরিশাল শহর থেকে মুক্তিযোদ্ধারা নিরাপদ স্থানে অবস্থান নেয়। ইতিহাসের পাতায় ২৫ এপ্রিল ১৯৭১ ছিল চরবাড়িয়ার জন্য একটি ভয়ঙ্কর দিন। ২৫ ও ২৬ এপ্রিল রাতে শুধু মৃতদেহ ছাড়া আর কিছুই ছিল না চরবাড়িয়া ইউনিয়নে।
বাসস/এনডি/বি.প্র/কেজিএ/০৯২৫/আরজি