কুষ্টিয়ায় মুক্তিযুদ্ধে প্রথম প্রতিরোধ ৩১ মার্চ

429

কুষ্টিয়া, ২৯ মার্চ, ২০২১ (বাসস) : হানাদার পাকসেনাদের বিরুদ্ধে সাহসী বাঙ্গালী তরুণ মুক্তিযোদ্ধারা অমিত তেজে অসীম সাহসিকতার সাথে যুদ্ধ করে ১৯৭১ সালের ৩০ মার্চ কুষ্টিয়ার পবিত্র মাটি পাক হানাদার সেনাদের হটিয়ে মুক্ত করতে সক্ষম হয়েছিল। হাজার হাজার মুক্তিকামী মানুষের গগণবিদারী ‘জয় বাংলা’ শ্লোগানে সেদিন কুষ্টিয়ার আকাশ-বাতাস মুখোরিত হয়ে উঠেছিল। পথে প্রান্তরে গড়ে তোলা হয়েছিল বেরিকেড। লাঠি-সড়কি, ঢাল-তলোয়ার নিয়ে হরিপুর-বারখাদা, জুগিয়া, আলামপুর, দহকোলা, জিয়ারুখী, কয়া, সুলতানপুর, পোড়াদহ, বাড়াদিসহ বিভিন্ন গ্রাম থেকে মানুষ ছুটে এসেছিল কুষ্টিয়া শহরে।
বঙ্গবন্ধুর ভাষণের পর মেজর আবু ওসমান পাকিস্তান সেনাবাহিনীর বিপক্ষে অবস্থান নেয়। ওই সময় ১ম বেঙ্গল রেজিমেন্টে লে. ক. রেজাউল করিমের নেতৃত্বে পাকিস্তান সেনাবাহিনী নিয়মিত শীতকালীন মহড়ায় যশোর ঝিকরগাছায় অবস্থান করছিল। স্বাধীন বাংলা ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের কেন্দ্রীয় কর্মসুচি অনুযায়ী ২৩ মার্চ কুষ্টিয়া ইসলামীয়া কলেজের মাঠে স্বতঃস্ফুর্ত জনতার উপস্থিতিতে স্বাধীন বাংলা ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের কুষ্টিয়া জেলা শাখার আহ্বায়ক, আ. জলিল পতাকা উত্তোলন করেন।
বেলুচ রেজিমেন্টের এক কোম্পানী সৈন্য ২৫ মার্চ রাতে যশোর সেনানিবাস থেকে কুষ্টিয়া এসে অবস্থান গ্রহণ করে। এক নাগাড়ে ৩০ ঘন্টার জন্য সান্ধ্য আইন জারি করে সশস্ত্র অবস্থায় টহল দিতে থাকে। সান্ধ্য আইন ভেঙ্গে জনতা বেরিয়ে পড়ে রাস্তায়। তৈরি করে বেরিকেড। মজমপুর, থানাপাড়া, আমলাপাড়া, বড় বাজার গেটের কাছে জনসাধারণ রাস্তার ওপর ইট-পাটকেল, কাটা গাছের গুড়ি, এমনকি ঘরের চাল নিয়ে এসে সেনাবাহিনীর চলাচল বিঘœ করার উদ্দেশ্যে বেরিকেড তৈরি করে। সেনাবাহিনী সেগুলো সরিয়ে ফেলে যেন আরো মারমুখী হয়ে যায়। শুরু হয়ে যায় তুমুল যুদ্ধ। ২৭ মার্চ রনি রেহমান নামে এক তরুণ পাকসেনাদের গাড়ীর ওপর হাতবোমা নিক্ষেপের সময় গুলিতে প্রাণ হারায়। রনি রেহমানই মুক্তিযুদ্ধে কুষ্টিয়ার প্রথম শহীদ। এ দিনই পাকবাহিনী শহরের বিভিন্ন এলাকায় সাধারণ মানুষের ওপর নির্বিচারে গুলিবর্ষণ শুরু করে। এতে তাৎক্ষণিকভাবেই ৭ জন মারা যায়। তাদের মধ্যে কোর্ট স্টেশনের জ্ঞানা সেন, কোর্টপাড়ার হাসেমের নাম জানা যায়। পাক বাহিনীর অত্যাচার আর গণহত্যায় কুষ্টিয়ার জনগণ বিদ্রোহী হয়ে উঠে।
২৮ মার্চ দুপুর ১২ টার মধ্যে সীমান্তের সমস্ত কোম্পানী আদেশক্রমে চুয়াডাঙ্গায় সমবেত হয়। পূর্ব পরিকল্পনা অনুযায়ী এক কোম্পানী সৈন্য ঝিনেদা পাঠানো হয় এবং সেখানে তারা যশোর-ঝিনেদা সড়ক অবরোধ করে যেন যশোর সেনানিবাস থেকে কোন সৈন্য বা অস্ত্র কুষ্টিয়াকে সরবরাহ করতে না পারে। অন্য আর এক কোম্পানী সৈন্য ক্যাপ্টেন আযম চৌধুরীর নেতৃত্বে চুয়াডাঙ্গা পোড়াদহ কাঁচা রাস্তা দিয়ে পোড়াদহে পাঠানো হয়। পরিকল্পনা ছিল ক্যাপ্টেন আযমের কোম্পানী শহরের দক্ষিণ-পশ্চিম কোণে অর্থাৎ সার্কিট হাউসে আক্রমণ করবে এবং সুবেদার মোজাফফরের কোম্পানী পুলিশ লাইন ও এক প্লাটুন সৈন্য এবং স্বেচ্ছাসেবক বাহিনীর কিছু লোক পূর্বদিক থেকে নায়েব সুবেদার মনিরুজ্জামানের নেতৃত্বে মোহিনী মিল সংলগ্ন ওয়ারলেস স্টেশনের ওপর আক্রমণ চালাবে এবং ঐক্যবদ্ধ আক্রমণ হবে একই সময়ে তিনদিক থেকে। আক্রমণের তারিখ নির্ধারণ হয় ৩০ মার্চ ভোর ৪টা। সমস্ত আয়োজন সম্পন্ন। কিন্ত যোগাযোগ ব্যবস্থার অসুবিধার কারণে এবং ১টা গাড়ী দুর্ঘটনার কারণে সুবেদার মোজাফফরের সৈন্য নির্দিষ্ট স্থানে পৌঁছাতে পারেনি। ফলে, পরের দিন অর্থাৎ ৩১ মার্চ ভোর ৪ টার সময় নির্ধারিত হয়। ৩১ মার্চ ভোর ৪টায় তিনদিক থেকে অতর্কিতভাবে কুষ্টিয়ায় আক্রমণ শুরু হয়। পরিকল্পনা অনুযায়ী আক্রমণের সাথে সাথে স্থানীয় হাজার হাজার জনগণ গগণবিদারী ‘জয় বাংলা’ জয়ধ্বনিতে কুষ্টিয়ার আকাশ বাতাস মুখোরিত করে তোলে। এতে শত্রু পক্ষের মনোবল মারাত্মক ভাবে ভেঙ্গে পড়ে। মাত্র এক ঘন্টা তুমূল যুদ্ধের পর মুক্তিযোদ্ধা ও সৈন্যরা পুলিশ লাইন ও ওয়ারলেস কেন্দ্রের ভেতর ঢুকে শত্রু খতম করতে থাকে। উপায়ান্তর না দেখে সামান্য সংখ্যক পাকিস্তানি সৈন্য ভীত হয়ে তাদের অস্ত্রশস্ত্র ফেলে দিয়ে সদর দপ্তর জিলা স্কুলের দিকে পালিয়ে যেতে থাকে। পালাবার সময় অনেক পাক সৈন্য নিহত হয়। পুরোদিনের যুদ্ধে একমাত্র জিলা স্কুল ছাড়া সমস্ত শহর মুক্তিবাহিনীর দখলে চলে যায়। বিজয় উল্লাসে মুক্তিযোদ্ধারা প্রবল শক্তিতে জিলা স্কুলের চারদিকে অবস্থান নিয়ে যুদ্ধ অব্যাহত রাখে। শত্রুমুক্ত কুষ্টিয়াতে তৎকালীন প্রাদেশিক পরিষদের জোনাল চেয়ারম্যান আব্দুর রউফ চৌধুরী কুষ্টিয়া কালেক্টরেট চত্বরে অফিসিয়ালি বাংলাদেশের জাতীয় পতাকা উত্তোলন করেন জোনাল কাউন্সিলের সেক্রেটারি এম শামসুল হককে জেলা প্রশাসক হিসেবে দায়িত্বভার দেন। মুক্তিযুদ্ধে কুষ্টিয়ার কবি, ছাত্র, সাহিত্যিক, শিল্পী, লেখকের ভুমিকা ছিল উল্লেখযোগ্য। এ ব্যাপারে কথা হয়, তৎকালীন স্বাধীন বাংলা ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের আহ্বায়ক এডভোকেট আব্দুল জলিলের সঙ্গে। তিনি সেই দিনের তার স্মৃতি চারণ করে বলেন, সেদিনের কথা আজও ভুলেনি। মানুষের কি দেশ প্রেম। মাত্র এক সপ্তাহ আগে যে শহরে মানুষতো দূরের কথা, একটি কাক-পক্ষীও দেখা যায়নি। ৩০ মার্চ সকাল থেকে কোথা থেকে এত মানুষ শহরে হাজির হলো। কিন্তু ওই দিন যুদ্ধ হলো না। পরের দিন ৩১ মার্চ আমরা পাকবাহিনীর অবস্থান নেয়া জিলা স্কুল, পুলিশ লাইন ও শহরের আড়–য়াড়া ছোট ওয়ারলেস সেন্টার ঘিরে চারিদিক থেকে আক্রমণ করে কুষ্টিয়াকে পাকবাহিনী মুক্ত করেছিলাম। সেদিন এ যুদ্ধ না হলে চড়–ান্ত বিজয় অর্জন হতো না বললেন, জেলা মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার হাজী রফিকুল আলম টুকু। তিনি জানান, ২৫ মার্চের পর থেকে মানুষের মধ্যে আতংক ছড়িয়ে পড়ে। পাকিস্তান বাহিনীর অত্যাচারে খুব অল্প সময়ে কুষ্টিয়ার মানুষ বিক্ষুদ্ধ হয়ে উঠে। ৩১ মার্চ কুষ্টিয়া প্রথম পাকিস্তান বাহিনীর সাথে মুক্তিবাহিনী আর সাধারণ মানুষের সাথে যুদ্ধে পরাজিত হয়। সেদিন কুষ্টিয়া মুক্ত হয়। প্রতি বছর ৩১ মার্চ এলে কুষ্টিয়ায় প্রথম শত্রু মুক্ত দিন হিসেবে বেছে নিয়ে নানা আয়োজন করা হয়ে থাকে।