মুক্তিযুদ্ধের পূর্ণাঙ্গ ইতিহাস রচনায় লোককবিদের অবদানের স্বীকৃতির আহ্বান লোক গবেষকদের

463

॥ মাহফুজা জেসমিন ॥
ঢাকা, ২৫ মার্চ, ২০২১ (বাসস) : মুক্তিযুদ্ধের পূর্ণাঙ্গ ইতিহাস রচনায় লোককবিদের অবদানকে স্বীকৃতি দেয়া উচিত বলে মনে করেন লোক গবেষকগণ।
তারা মনে করেন, মুক্তিযুদ্ধের সঠিক ও সুবিস্তৃত ইতিহাস রচনায় লোকসাহিত্যের গ্রহণযোগ্য উপাদানগুলো বিবেচনা নেওয়া জরুরি। এতে করে লোকায়ত পরিমন্ডলে মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকেও পর্যবেক্ষণ করা সম্ভব হবে।
বাংলাদেশের ফোকলোর গবেষণার পথিকৃত বাংলা একাডেমির সভাপতি বঙ্গবন্ধু অধ্যাপক শামসুজ্জামান খান বলেছেন, লোকজ সংস্কৃতির প্রতিটি ধারায় মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে কাজ হয়েছে। আমাদের লোকজ সংস্কৃতি এতোটাই সমৃদ্ধ যে তা মুক্তিযুদ্ধে প্রভাবক হিসেবেও কাজ করেছে। তিনি লোকসাহিত্য নিয়ে গবেষণা ও স্বীকৃতির মাধ্যমে লোকসংস্কৃতির চর্চাকে বৈশ্বিক করে তোলার প্রয়োজনীয়তার কথা উল্লেখ করেন।
স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীকে সামনে রেখে লোক গবেষক সাইমন জাকারিয়া বাসসকে বলেন, ‘আমি মনে করি, মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস রচনায় লোক কবিদের অবদানকে স্বীকৃতি দেয়া উচিত। কারণ, মুক্তিযুদ্ধের অলিখিত ইতিহাসকে গ্রন্থনার মাধ্যমে লোক কবিরা মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের পূর্ণাঙ্গতা বিধানে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখে চলেছেন।’
তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশের লোকায়ত পরিমন্ডলের সাধারণ মানুষ সাধারণত ইতিহাসের পাঠ্য বইয়ের পৃষ্ঠা থেকে নিতে অভ্যস্ত নন। মূলতঃ লোকসংগীতের বিভিন্ন আঙ্গিকে প্রচলিত মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস নির্ভর গান, জারি শুনে এবং লোকনাট্য বা পালাগান প্রত্যক্ষ করে, পুথিকাব্য পাঠ বা শ্রবণের মাধ্যমে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসকে জেনে ও বুঝে এসেছে। এখনও গ্রামের মানুষ লোকসাহিত্যের মাধ্যমেই মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস সম্পর্কে জানতে পারে। এক্ষেত্রে লোকসংগীতই প্রধান অবলম্বন।’
তার মতে, মুক্তিযুদ্ধের সময় রচিত পুথিকাব্য পাঠের মাধ্যমে সাধারণ মানুষ মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস সম্পর্কে জ্ঞান লাভ করে থাকে। এমনকি বর্তমান সময়ের লোকায়ত পরিমন্ডলের অনেক কবি মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের নানা দিক নিয়ে লোকায়ত সাহিত্য সৃষ্টির মাধ্যমে জনগণের মধ্যে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ছড়িয়ে দিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছেন।
পুথিকবি মাস্টার শাহ আলম রচিত ‘জাতির পিতা শেখ মুজিবুর রহমান’ শীর্ষক পুথির ‘মুক্তিযুদ্ধ ও বঙ্গবন্ধুর বয়ান’ পর্বে তারই প্রতিফলন দেখা যায়। কবি লিখেছেন, ‘শেখ মুজিব স্মরিয়া গাহি স্বাধীনতার পুথি।/স্বাধীনতা শেখ মুজিব একসাথে গাঁথি॥/স্বাধীনতার স্বপ্নদ্রষ্টা শেখ মুজিবর।/ছাব্বিশে মার্চ ঘোষিয়াছেন জানিও খবর।/.. (উৎস্য. সাধক কবিদের রচনায় বঙ্গবন্ধুর জীবন ও রাজনীতি, সাইমন জাকারিয়া)।
১৯৭০ সালের সাধারণ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের বিপুল বিজয়ের পর ১৯৭১ সালের ৩ মার্চ জাতীয় পরিষদের অধিবেশন ছিল বাঙালি জাতির কাঙ্খিত বিজয়ের বাস্তব প্রতিফলন। কিন্তু, পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান ১ মার্চ আকস্মিকভাবে বেলা ১টা ৫ মিনিটে রেডিওর মাধ্যমে ৩ মার্চ অনুষ্ঠেয় জাতীয় পরিষদের অধিবেশন অনির্দিষ্টকালের জন্য স্থগিত ঘোষণা করেন। প্রতিবাদে উত্তাল হয়ে ওঠে পূর্ব পাকিস্তান। বাঙালি জাতির স্বাধীনতা যুদ্ধের রূপরেখা তৈরি করতেই ৭ মার্চ ঢাকার রেসকোর্সে জমায়েত হয় বাংলার আপামর জনতা।
“…মুক্তিযুদ্ধ শুরুর পূর্বে ৭ তারিখ মার্চ।/ ঐতিহাসিক ভাষণ দিলেন পূর্ব বাংলার রাজ॥/বজ্রকন্ঠে কহিলেন সংগ্রাম স্বাধীনতার/বজ্রকন্ঠে কহিলেন মুক্তি চাই এবার॥/ যার যাহা আছে নিয়ে করো মোকাবেলা।/পশ্চিমারে ভাতে মারো নাহি করে হেলা॥/… মাস্টার শাহ আলমের পুথিকাব্যে ৭ মার্চের ভাষণকে এভাবেই গ্রন্থিত করা হয়েছে।
৭ মার্চ রেসকোর্স ময়দানে ঐতিহাসিক ভাষণের পর ঘরে ঘরে পৌঁছে যায় স্বাধীনতার ডাক। ১৬ থেকে ২৪ মার্চ প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান এর প্রহসনমূলক আলোচনার আড়ালে চলে বাঙালি জাতিকে চিরতরে নিস্তব্ধ করে দেয়ার ষড়যন্ত্র। ২৫ মার্চের মধ্যরাতে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর ‘অপারেশন সার্চলাইট’ নির্বিচারে হত্য করে বাঙলার মানুষকে। এর প্রেক্ষিতে সেদিন মধ্যরাতে বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতার ঘোষণা দেন। ২৬ মার্চ প্রথম প্রহরে স্বাধীনতার ঘোষণা দেশে এবং বিশ্বেও ছড়িয়ে পড়ে। বঙ্গবন্ধুর আহ্বানে সব শ্রেণী-পেশার মানুষ মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে। এ সময়কে ধারণ করে গ্রামে-গঞ্জে রচিত ও গীত হয় মুক্তিযুদ্ধ ও বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে লোকগান।
“…ওইদিকে ২৫শে মার্চ পশ্চিমা শয়তান।/ঝাঁপাইয়া পড়ে তারা নিশীথ নিদান॥/কামানের লেলিহান গোলা ঝাঁকে ঝাঁকে।/ঢাকা শহর রক্তে লাল পড়িল বিপাকে॥/ পশ্চিমা হায়েনা ছুঁড়ে কামানের গোলা।/ব্রাশফায়ার করে তারা রাত্রি হয় উজালা॥/ঘুমন্ত বাঙালি যত ঢাকাতে আছিল।/পশ্চিমা সামরিক জান্তা মারিতে লাগিল॥/ কেয়ামত হইলো যেন ঢাকার শহর।/নিশিরাতে হয়ে যায় রক্তের নহর॥/ ্েসই রাতে ইয়াহিয়া শেখ মুজিবরে।/গ্রেফতার করে নিল পিন্ডির শহরে॥/ গ্রেফতার হওয়ার আগে শেখ মুজিবর।/ ঘোষিলেন স্বাধীনতা ২৬ শে মার্চ প্রথম প্রহর॥/…”
লোকগানে ও কবিতায় মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস লোক ভাষায় সাধারণ মানুষের উপজীব্য করে রচিত হওয়ায় এসব বাণী ও সুর লোকে লোকে দেশে দেশে ছড়িয়ে পড়েছে। মানুষ এর সাথে একাত্ম হয়েছে। আজো লোক কবিদের রচনা সাধারণ মানুষকে উজ্জীবিত করতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখছে। বাঙালির মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস নানা সময়ে নানাভাবে বিকৃত করার চেষ্টা হয়েছে। কিন্তু লোকমুখে প্রচলিত ছড়া বা গানগুলোকে কোন শাসকের কালো হাত স্তব্ধ করতে পারে নি।
বাংলা একাডেমির সহকারী পরিচালক সাইমন জাকারিয়া বলেন, ‘বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ চলার সময় প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতার আলোকে অনেক লোক কবি বা সাধক কবি, গ্রামীণ পালাকার, গায়ক-শিল্পী, জারিয়াল, পুথিকার অনেক গান, কবিতা, নাট্যপালা, জারি, পুথি প্রভৃতি রচনা, প্রচার ও প্রকাশ করেছেন। সে সকল রচনাকর্মে যথার্থভাবে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস লিপিবদ্ধ রয়েছে। কারণ, রচয়িতাগণ প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতার মাধ্যমে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের নানা দিক তাঁদের রচনা কর্মে স্থান দিয়েছেন।’
তিনি বলেন, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান প্রদত্ত স্বাধীনতার ঘোষণা এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জনে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর ভূমিকা ও অবদানের পাশাপাশি এদেশের সর্বস্তরের মানুষের অংশগ্রহণে বিজয় লাভের ইতিহাস রচনায় লোককবিদের রচনা মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস রচনার গুরুত্বপূর্ণ দলিল। মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতাকারী রাজাকার-আলবদরদের কথাও সাহসিকতার সাথে লোকায়ত পর্বের কবি, পালাকার, পুথিকারগণ লিপিবদ্ধ করেছেন।
সাইমন জাকারিয়া বাংলাদেশের ৫০তম স্বাধীনতা দিবসের প্রাক্কালে মুক্তিযুদ্ধে লোককবিদের অবদানকে সামনে নিয়ে আসার পাশাপাশি মুক্তিযুদ্ধের সঠিক ও সুবিস্তৃত ইতিহাস রচনায় লোকসাহিত্যের গ্রহণযোগ্য উপাদানগুলো বিবেচনা নেওয়ার আহ্বান জানান।