প্রজনন স্বাস্থ্য বিষয়ে কিশোরীদের সচেতনতা বাড়ছে

826

॥ মাহবুব আলম ॥
ঢাকা, ২৪ আগস্ট, ২০১৮ (বাসস) : জন্মের পর একটা মানুষ শিশুকাল পেড়িয়ে কৈশোরে প্রবেশ করে। শিশুকালটা ঘরের গন্ডিতে কাটলেও কৈশোরেই একটা মানুষের গন্ডি বাড়তে থাকে। আসে তার শারিরীক পরিবর্তন। কৈশোর বয়সটা প্রতিটি মানুষের জন্যই অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বিশেষ করে শারীরিক পরিবর্তনের কারণে এ সময়টা মেয়েরদের জন্য আরো বেশি গুরুত্বপূর্ণ। এ সময়টাতেই একজন কিশোরী প্রজনন ক্ষমতা লাভ করে। তাই প্রজনন বিষয়ে কিশোরীদের সাম্যত জ্ঞান থাকা বিশেষ প্রয়োজন। একটা সময় ছিল যখন প্রজনন বিষয়ে কথা বলতে নারীরা লজ্জা পেত। কিন্তু সরকারের বিভিন্ন উদ্যোগ ও প্রচারণার কারণে বর্তমানে আজকাল দেশের নারীরা অনেক বেশি সচেতন। যেহেতু কিশোরী বয়সে একজন নারী প্রজনন ক্ষমতা লাভ করে তাই এ সময়ে তাদেরকে এ বিষয়ে সচেতনতা বাড়ানো বিশেষ প্রয়োজন। আজকাল প্রজনন বিষয়ে স্কুলেও কিশোরীদের সচেতনতা বাড়াতে পদক্ষেপ নেয়া হচ্ছে। তেমনই একটা ঘোড়াচড়া উচ্চ বিদ্যালয়। মফস্বল শহর সিরাজগঞ্জের ফুলকুচা গ্রামের ঘোড়াচড়া উচ্চ বিদ্যালয়- এই স্কুলে প্রায় দেড় হাজারের বেশি শিক্ষার্থীর মধ্যে অর্ধেকেই ছাত্রী। প্রত্যন্ত এলাকা হলেও স্বাস্থ্য সচেতনতায় রীতিমতো বিপ্লব ঘটেছে এখানে। পিরিয়ডের সময় মেয়েদের এ স্কুল থেকেই সরবরাহ করা হচ্ছে স্যানিটারি ন্যাপকিন!
অথচ মাত্র পাঁচবছর আগেও এ বিদ্যালয়ের চিত্রটা ছিল ভিন্ন। ওই সময়টায় মেয়েরা স্কুলে আসতো না। তারা ভয় পেত, লজ্জা পেত। ব্যবহার করতো পুরনো কাপড় বা ন্যাকড়া। এখন অবশ্য তারা শুধু স্যানিটারি ন্যাপকিনই ব্যবহার করে না, তাদের জন্য সার্বক্ষণিক পানি এবং আলাদা ওয়াশরুমের ব্যবস্থাও করেছে স্কুল কর্তৃপক্ষ। এমনকি কয়েকজন প্রশিক্ষিত নারী শিক্ষকও রয়েছেন তাদের সহায়তা করার জন্য, কথা শোনার জন্য।
জানা যায়, মেয়েদের পিরিয়ডের বিষয়ে সচেতন করতে, স্বাস্থ্যসম্মত স্যানিটারি ন্যাপকিন ব্যবহারে উৎসাহী করতে চলন বিলের ওই এলকায় ২০১১ সালে অ্যাডভোকেসি প্রোগ্রাম চালু করে ডেভেলপমেন্ট অর্গানাইজেশন অব দ্য রুরাল পুওর বা ডর্প ডিওআরপি নামে একটি এনজিও।
সংস্থাটির প্রোগ্রাম কো-অর্ডিনেটর আমির খসরু এই প্রতিবেদককে বলেন, আমরা শুধু স্কুলের শিক্ষক এবং ম্যানেজিং কমিটি নয়, স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদ ও উপজেলা পরিষদকে সঙ্গে নিয়ে কাজটি শুরু করি। এরপর স্কুলের ছাত্রী ও তাদের অভিভাকদের বোঝাতে সক্ষম হয়েছি, স্বাস্থ্যসম্মত স্যানিটারি প্যাড কেন প্রয়োজন। এখন তারা বুঝতে পেরেছেন, ব্যবহারও করছেন।
তিনি বলেন, প্রথমে ন্যাপকিনের দামটা একটা বড় বিষয় ছিলো। তাই কম দামে স্বাস্থ্যসম্মত প্যাড উৎপাদন করে তা তাদের কাছে সরবরাহ করছি। এখন পর্যন্ত প্রায় অর্ধশতাধিক স্কুলে এই কর্মসূচি চালু রয়েছে। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ও এই কাজের সহায়ক নীতিমালা তৈরি করেছে।
আইসিডিডিআর,বি-এর জরিপে দেখা যায়, দেশের শতকরা ৮৬ শতাংশ নারী পিরিয়িডের সময় স্যানিটারি প্যাড ব্যবহার করেন না। এ সময় তারা পুরনো কাপড় বা ন্যাকড়া ব্যবহার করেন।
আর প্রতিবেদন অনুযায়ী, ছাত্রীদের ৬৮ শতাংশ প্রথমবার পিরিয়ড হওয়ার আগে তারা এ বিষয়ে জানতেন না। আর প্রায় ৮২ শতাংশ ছাত্রী ওই সময় পুরনো কাপড় ব্যবহার করেন। দেখা যায়, বাংলাদেশের মাত্র এক শতাংশ স্কুলে ব্যবহার করা প্যাড ফেলার ব্যবস্থা আছে।
ঘোড়াচড়া উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষক ফিরোজ উদ্দিন ভূঁইয়া বলেন, এখন ছাত্রীদের উপস্থিতি বেশি। তারা এ ধরনের কোনো বিষয়ে স্কুলে আসা বন্ধ করে না। ভয় বা লজ্জাও পায় না। তারা জানে যে, এটা একটা স্বাভাবিক বিষয়।
‘তাছাড়া প্রতিমাসে রুটিন অনুযায়ী দায়িত্বরত নারী শিক্ষকরা ছাত্রীদের সঙ্গে কথা বলেন। তাদের পাশে থেকে সমস্যার সমাধান করেন।’
বিষয়টি নিয়ে বেশ আশাবাদী ডর্প-এর কর্মকর্তা আমির খসরু। তার মতে, পরিস্থিতি বদলাচ্ছে, দৃষ্টিভঙ্গি পাল্টাচ্ছে। তাই অনেক শিক্ষা-প্রতিষ্ঠান এ নিয়ে কাজও করছে। তবে আমাদের সমাজের সবখানে পিরিয়ড নিয়ে যে ট্যাবু (নিষিদ্ধাদেশ) বিরাজ করছে তা ভাঙতে সময় লাগবে।
ওই জরিপে ৪০ শতাংশ ছাত্রী জানিয়েছেন, পিরিয়ডের কারণে গড়ে প্রতি মাসে তারা তিনদিন স্কুলে যেতে পারে না। আর ৩৮ শতাংশ কিশোরী ওই সময়টায় ধর্মীয় কাজ থেকে বিরত থাকেন; বয়স্ক নারীদের ক্ষেত্রে এ সংখ্যা ৪৮ শতাংশ।
বেসরকারি সংস্থা ব্র্যাক-এর সিনিয়র সাপোর্ট স্পেশালিস্ট বিথী রায় বলেন, পিরিয়ড নিয়ে যে কুসংস্কার, সেটা ভাঙতে হবে। ভাইকে বুঝতে হবে বোনের প্রয়োজন। স্বামীকে বুঝতে হবে স্ত্রীর প্রয়োজন। এ বিষয়টি শুধু নারী বুঝলেই হবে না। পরিবারের সদস্য ও সমাজকেও বুঝতে হবে।
‘এটাকে একটি স্বাভাবিক শারীরিক বিষয় হিসেবেই মেনে নিতে হবে। এতে কোনো লজ্জা বা সংকোচ থাকতে পারে না।’
এদিকে ব্র্যাক তার কর্মীদের কর্মস্থল ও কর্ম এলাকায় এ বিষয়ে সচেতনতামূলক ক্যাম্পেইনও করেছে। পুরুষ সহকর্মীও যাতে নারী সহকর্মীকে বুঝতে পারেন, ঘরের মানুষ যেন ঘরের নারী সদস্যের প্রয়োজনটা উপলব্ধি করে, সেই টার্গেটকে সামনে রেখেই ব্র্যাকের এই ক্যাম্পেইন।
এ বিষয়ে বিথী রায় বলেন, এ নিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে পেজ খুলে কাজ করা হয়েছে। সেখানে সাড়া ছিল বেশ লক্ষ্যণীয়।
নারী ও শিশু স্বাস্থ্য নিয়ে কাজ করা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক ডা. নাজনীন আক্তার বলেন, পিরিয়ডের সময় পুরানো কাপড় বা ন্যাকড়া ব্যবহার করা অনুচিত। এতে নারী ও কিশোরীরা নানা ধরনের সংক্রমণের শিকার হতে পারে। আর সংক্রমণ দীর্ঘদিনের হলে প্রজনন অঙ্গ ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে, যা থেকে দেখা দিতে পারে বন্ধ্যাত্ব।
‘এর ফলে সাদা¯্রাব বা লিকোরিয়া নামের একটা রোগ হতে পারে, যা নারীর মনোবল ভেঙে দেয়, এতে তারা হতাশ হয়ে যায়।’
তিনি বলেন, আমরা বিভিন্ন সভা-সেমিনারে স্যানিটারি প্যাডকে পাবলিক গুডস হিসেবে ঘোষণা করার কথা বলেছি। এতে গ্রামে-গঞ্জে সবার কাছে এটি সহজলভ্য হবে।