দেশজুড়ে বাড়ছে সূর্যমুখীর আবাদ : চলতি মৌসুমে সূর্যমুখী চাষের অভিষেক হলো নাটোরে

385

ঢাকা, ২০ মার্চ, ২০২১ (বাসস) : হলুদ রঙের নান্দনিক একটি ফুল সূর্যমুখী। দেখতে সূর্যের মত এবং সূর্যের দিকে মুখ করে থাকে, তাই ফুলকে সূর্যমুখী বলে। সূর্যমুখী থেকে তৈরি তেলও পুষ্টিগুণ সম্পূর্ণ। বিশ্বেজুড়েই সূর্যমুখী তেলের চাহিদা এখন ব্যাপক। আমাদের দেশেও ক্রমশ চাহিদা বৃদ্ধির কারণে বিভিন্ন জেলায় বাণিজ্যিকভাবে সূর্যমুখীর চাষ শুরু হয়েছে। পুষ্টিবিদদের মতে, সূর্যমুখীর তেলে কোলেস্টেরলের মাত্রা খুবই কম এবং হৃদরোগীদের জন্য বেশ কার্যকর। এতে রয়েছে ভিটামিন এ, ডি এবং ই। এই তেল শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায় এবং ক্যান্সার প্রতিরোধে সাহায্য করে।
বাসস জেলা প্রতিনিধিদের সহযোগিতায় দেশের বিভিন্ন স্থানে সূর্যমুখী চাষের চিত্রটুকু তুলে ধরার প্রয়াসে ‘দেশজুড়ে বাড়ছে সূর্যমুখীর আবাদ’ শীর্ষক ধারাবাহিক প্রতিবেদন তুলে ধরা হচ্ছে। আজ থাকছে নাটোর জেলায় সূর্যমুখী চাষের চিত্র-
চলতি রবি মৌসুমে তেল জাতীয় শস্য সূর্যমুখীর চাষের অভিষেক হয়েছে নাটোরে। এই চাষাবাদের মাধ্যমে সূর্যমুখী তেল উৎপাদনের সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে। স্বাস্থ্য সচেতন ব্যক্তিরা নিরাপদ ভোজ্য তেল পাওয়ার প্রত্যাশা করছেন।
নাটোর কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগ সূত্রে জানা যায়, চলতি মৌসুমে জেলায় মোট ৭৩ হেক্টর আবাদী জমির মধ্যে নাটোর সদর উপজেলায় ২০ হেক্টর, লালপুর উপজেলায় ২৫ হেক্টর, সিংড়া ও বাগাতিপাড়া উপজেলায় ১০ হেক্টর করে এবং নলডাঙ্গা উপজেলায় আট হেক্টর জমিতে প্রথমবারের মত সূর্যমুখী চাষ করা হচ্ছে। জেলায় প্রায় ১১৫ টন সূর্যমুখীর বীজ উৎপাদন হবে বলে আশা করা হচ্ছে। সমূদয় বীজ থেকে তেল উৎপাদন হলে আহরিত তেলের পরিমাণ হবে অন্তত ৫২ টন।
সরকার কৃষি প্রণোদনার আওতায় মৌসুমে জেলার দুই হাজার কৃষককে বিনামূল্যে এক কেজি করে সূর্যমুখীর বীজ প্রদান করেছে। প্রত্যেকেই এই পরিমাণ বীজে এক বিঘা জমি চাষ করতে পারছেন। জেলায় সূর্যমুখীর চাষাবাদের প্রচলন ঘটাতে সরকারের এই উদ্যোগের পাশাপাশি কৃষকদের উৎসাহিত করতে নাটোর সদর উপজেলা কৃষি বিভাগ ‘আধুনিক প্রযুক্তি সম্প্রসারণের মাধ্যমে রাজশাহী বিভাগের কৃষি উন্নয়ন প্রকল্প’ এর আওতায় সূর্যমুখীর তিনটি প্রদর্শনী খামার স্থাপন করেছে। এসব খামারে সূর্যমুখী চাষাবাদে প্রয়োজনীয় বীজ ও সার প্রদান করা হচ্ছে। পরবর্ত্তীতে এসব খামারে মাঠ দিবস আয়োজনের মাধ্যমে কৃষক সমাবেশে উপস্থিত কৃষকদের সূর্যমুখী চাষাবাদ পদ্ধতি এবং এর সুবিধাসমূহ অবহিত করা হচ্ছে। প্রদর্শনী খামার স্থাপনকারী কৃষক মো. দেদার বক্স জানান, অনেকে সূর্যমুখী চাষ সম্পর্কে জানতে আসছেন।
অনেক কৃষক তাদের আবাদী জমিতে সাথী ফসল হিসেবে, আবার কেউ কেউ জমির আইলের চারপাশ দিয়ে সূর্যমুখী চাষ করছেন। লালপুর উপজেলার পদ্মার চরেও সূর্যমুখীর আবাদ শুরু হয়েছে। কৃষি বিভাগের উদ্বুদ্ধকরণ কর্মসূচি এবং কৃষকদের এসব উদ্যোগের মধ্য দিয়ে নাটোরে সূর্যমুখী চাষের সম্প্রসারণ ঘটবে বলে আশা করা হচ্ছে।
সূর্যমুখী চাষাবাদ তুলনামূলকভাবে সহজ। একবিঘা জমি চাষে ২৪ কেজি ইউরিয়া, ২০ কেজি টিএসপি, ১৬ কেজি করে পটাশ ও জিপসাম, এক কেজি করে জিংক ও বোরন এবং কিছু ম্যাগনেশিয়াম প্রয়োজন হয়।
সরকারের কৃষি প্রণোদনার আওতায় একবিঘা জমি চাষে সূর্যমুখীর বীজ পেলেও নাটোর সদর উপজেলার ইব্রাহীমপুর গ্রামের কৃষক আজিবার মন্ডল দেড় বিঘাতে সূর্যমুখী আবাদ করেছেন। নতুন শস্য চাষে আগ্রহের কারন সম্পর্কে বলেন, বাজারে সূর্যমুখীর তেলের চাহিদা অনেক, দামও বেশী। তাই আমি মনেকরি, এই শস্য অনেক সম্ভাবনাময়।
দিয়ার সাতুরিয়া গ্রামের কৃষক সাইদুর রহমান, কদিম সাতুরিয়া গ্রামের কৃষক সাইদুর রহমান, শংকরভাগের আব্দুল মজিদ সরকার, হাজরা নাটোরের রিপন পরীক্ষামূলকভাবে ছোট পরিসরে সূর্যমুখী চাষ করেছেন। তারা বলেন, এপ্রিলে ফসল কাটার পর এর বাজার পরিস্থিতি বিবেচনা করে পরবর্ত্তীতে চাষের পরিসর বাড়াবো।
উপ সহকারী কৃষি কর্মকর্তা মোস্তাক আহমেদ জানান, সাধারণত জমিতে আমন ধান কাটার পরে সূর্যমুখী চাষ করা হয়। তিন ফসলী এসব জমিতে সূর্যমুখী ওঠার পরে আউশ বা তিল বা মুগ চাষ করা হবে। রবি মৌসুম ছাড়াও খরিপ মৌসুমেও সূর্যমুখী আবাদ যায়।
নাটোর সদর উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মো. মেহেদুল ইসলাম বলেন, সূর্যমুখীর বীজ থেকে তেল আহরণের হার তুলনামূলকভাবে অনেক বেশী। এই তেল হৃদরোগ, স্ট্রোক, উচ্চ রক্তচাপ, কোলেস্টেরল এর ক্ষেত্রে ক্ষতিকর নয়। দামেও কৃষকরা লাভবান হবেন। তাই ভবিষ্যতের শস্য হবে সূর্যমুখী।
যেসব কৃষক আমাদের আহ্বানে সাড়া দিয়ে প্রথমবারের মত সূর্যমুখী চাষে এগিয়ে এসেছেন, সাহসী ঐসব কৃষকদের ধন্যবাদ জানিয়ে এই কর্মকর্তা আরো জানান, কৃষকদের উৎপাদিত সূর্যমুখীর বীজ পরবর্ত্তী মৌসুমের বীজ হিসেবে ব্যবহারের জন্যে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। তাদের উৎপাদিত বীজ সংগ্রহ করে কৃষি বিভাগের কর্মকর্তা-কর্মচারীসহ স্বাস্থ্য সচেতন ব্যক্তিদের চাহিদা নিরুপন করে তাদের জন্যে তেল উৎপাদনের ব্যবস্থা গ্রহণের কথাও আমরা ভাবছি বলে জানান এই কৃষি কর্মকর্তা।
নাটোর কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগের উপ-পরিচালক সুব্রত কুমার সরকার বাসস’কে বলেন, পরবর্ত্তী মৌসুমগুলোতে সূর্যমুখী চাষে জেলার কৃষকদের উৎসাহিত করতে প্রশিক্ষণ ও প্রযুক্তি হস্তান্তরসহ কার্যকর সকল পদক্ষেপ গ্রহণ করা হবে।