বাসস ইউনিসেফ ফিচার-১ : শিশুদের মানসিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করছে করোনা

135

বাসস ইউনিসেফ ফিচার-১
করোনা- শিশু
শিশুদের মানসিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করছে করোনা
ঢাকা, ১৪ মার্চ, ২০২১ (বাসস) : মহামারি করোনা পুরো বিশ্বকেই ওলট-পালট করে দিয়েছে। এ ভাইরাস বিভিন্ন ক্ষেত্রে এমন ধরনের অনেক ক্ষতি করেছে যা কেউ কেউ কোন দিন কাটিয়ে উঠতে পারবেনা। বাংলাদেশে প্রথম করোনা রোগি শনাক্ত হয় ২০২০ সালের ৮ মার্চ। করোনার কারণে ব্যাহত হচ্ছে শিক্ষার্থীদের শিক্ষা জীবন। তবে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে শিশুরা।
গত বছরের শুরুতে শিক্ষা জীবনে পা রেখেছিল বরিশালেল আগৈলঝড়া উপজেলার রাজিহার সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ক্ষুদে শিক্ষার্থী কবিতা (৪)। বড় বোনের সঙ্গে যে আড়াই মাস স্কুলে যাওয়ার সময় পেয়েছিল, তাতে রীতিমত পড়াশোনা অভ্যাসে পরিণত হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু করোনাভাইরাস সংক্রমণ শুরু হওয়ায় সব কিছু ভেস্তে গেছে। পড়াশুনা করাটাই যেন ভুলে গেছে কবিতা। তার বাবা জানালেন করোনার কারণে স্কুল বন্ধ হয়ে যাওয়ায় এখন তাকে ঘরে পড়তে বসানো মুশকিল হয়ে পড়েছে।
একই বিদ্যালয়ের পঞ্চম শ্রেণির শিক্ষার্থী আদৃতা (১০)। প্রাথমিক পর্যায় শেষ করে মাধ্যমিকে উত্তীর্ণ হতে তার প্রস্তুতি ছিল বিগত বছরগুলোর চেয়ে অনেক বেশি ভালো। করোনার কারণে একদিকে স্কুল বন্ধ তারওপরে পিইসি পরীক্ষা না হওয়াতে পড়াশোনায় মেয়ের মনযোগ কমে গেছে বলে জানালেন তার বাবা। পাশাপাশি আচরণগত পরিবর্তনও এসেছে বলে উল্লেখ করেন তিনি।
গত বছরের শুরুতে নতুন বই হাতে পেলেও শিশুরা বেশিদিন বিদ্যালয়ে যাওয়ার সুযোগ পায়নি। এ বছরও সরকার স্বাস্থ্য বিধি মেনে বছরের শুরুতেই ছাত্র-ছাত্রীদের হাতে বই তুলে দিয়েছে।করোনাভাইরাস সংক্রমণের কারণে দীর্ঘদিন স্কুল বন্ধ থাকায় শিশুদের পড়াশোনা যেমন ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে তেমনি তারা মানসিকভাবেও ভালো নেই। অভিভাবক ও বিশে¬ষকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, করোনার কারণে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় সবচেয়ে বেশি নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পড়ুয়া শিক্ষার্থীদের ওপর।
এ প্রসঙ্গে শিক্ষাবিদ অধ্যাপক সৈয়দ মঞ্জুরুল ইসলাম বলেন, ‘প্রাথমিক বিদ্যালয়ে যে শিশুরা পড়াশোনা করে এই সময়টিতে শিক্ষাগ্রহণের পাশাপাশি তারা সামাজিক নানা আচরণও শেখে। এক্ষেত্রে স্কুলের গুরুত্ব অনেক বেশি। প্রতিটি স্কুলে শিশুদের পড়াশোনার পাশাপাশি সাংস্কৃতিক নানা আয়োজন থাকে।শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এ বছরের বেশী সময় যাবত বন্ধ থাকায় সেসব বিষয় থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। এই শিশুদের পড়াশুনা ক্ষতিগ্রস্থের পাশপাশি সবচেয়ে ভাবনার বিষয় যে তারা মানসিকভাবে ক্ষতির শিকার হচ্ছে।’
তিনি আশঙ্কা প্রকাশ করেন করোনায় শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে এই দীর্ঘ ছুটিতে শিশুশ্রম বেড়েছে এবং এ অীবস্থা দির্ঘায়িত হলে তা আরো বাড়বে। মেয়ে শিশু ঝরে পড়বে। কারন অনেক অসচ্ছল পরিবার তাদের সন্তানদের কাজে লাগিয়ে দেবে। অন্যদিকে মেয়ে শিশুদের বিয়ে দেবে।
রাজিহার সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে প্রধান শিক্ষক বলেন, ‘শিশুদের সঙ্গে দেখা হলেই তারা বলে স্কুল খুলবেন কবে স্যার। তাদের মনে হয় বাড়িতে ভালো লাগে না। যেখানে শিশুদের নিয়েই আমাদের সময় কাটে। এখন তা সম্ভব হচ্ছে না। অন্য দিকে তাদের পড়াশোনার ব্যাপক ঘাটতি হচ্ছে।’ দীর্ঘছুটির কারণে তাদের শিখনে দুর্বলতা বাড়বে বলে মনে করেন তিনি।
তিনি আরও বলেন, ‘প্রাকপ্রাথমিক শিশুরা যা শিখেছে তা সব ভুলে গেছে। এরপর তাদেরকে স্কুলমুখি করতেও অনেক সমস্যা হবে। তার জন্য বিভিন্ন প্রদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। তবে সর্বোপরী কথা হলো শিক্ষার মান অনেক পিছিয়ে গেছে তা ফিরিয়ে আনতে শিক্ষক অভিভাবক সবার দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন করতে হবে।’
তিনি বলেন, ‘সরকারের গাইডলাইন মেনে আমরা শিশুদেরকে টিভি মোবাইল এবং রেডিওতে পাঠ দেখার জন্য পরামর্শ দিয়ে যাচ্ছি প্রতিনিয়ত।’
এদিকে করোনাভাইরাস সংক্রমনের কারনে স্কুল বন্ধকালীন সময়ে গ্রামের শিশুরা প্রাকৃতিক পরিবেশ পেলেও শহরের শিশুরা একেবারেই গৃহবন্দি। রাজধানী গভর্নমেন্ট ল্যাবরেটরি স্কুলের শিক্ষক ড. শিশির মল্লিক বলেন, ‘এই পরিস্থিতিতে আমরা অনলাইনে যদিও ক্লাস নিচ্ছি কিন্তু মূল দায়িত্ব তাদের পরিবারের। অভিভাবকদের নজর রাখতে হবে তার শিশুর পড়াশুনা আচরনের প্রতি। কারন এ সময় শিশুদের মানসিক বিকাশ ঘটে।’
এ প্রসঙ্গে গণস্বাক্ষরতা অভিযানের নির্বাহী পরিচালক রাশেদা কে চৌধুরী বলেন, ‘বিদ্যালয়ে প্রাথমিক শিক্ষার পাশাপাশি শিশুরা সামাজিক শিক্ষা পেয়ে থাকে। পুঁথিগত বিদ্যার বাইরে শিক্ষার্থীদের বড় প্রত্যাশার জায়গা থাকে খেলাধুলা ও বন্ধুমহল।’
তিনি বলেন, ‘অনেক শিশু প্রথমে বিদ্যালয়ে যেতে চায় না। কিন্তু যেতে যেতে এক সময় বিদ্যালয়ো তার বন্ধু তৈরি হয়। যাদের সঙ্গে খেলাধুলা করতে পারে। যার ফলে বিদ্যালয় শিশুদের কাছে আনন্দের জায়গা হয়ে ওঠে। বিদ্যালয় থেকে সামাজিক আচরণেরও পরিচয় ঘটে।’
করোনার কারণে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান দীর্ঘ ছুটির কারণে এসব শিশুদের মানসিক বিকাশও বাধাগ্রস্থ হচ্ছে বলে মনে করেন তিনি।
বাংলাদেশে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ শুরু হওয়ার কিছুদিন পরেই গত ১৭ মার্চ থেকে সকল পর্যায়ের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ ঘোষণা করা হয়। বিভিন্ন সময়ে ছুটি বাড়িয়েছে সরকার। এরই মধ্যে সব ধরনের পরীক্ষা বাতিল করা হয়েছে। এমনকি গত বছরের এইচএসসি পরীক্ষা পর্যন্ত নেয়া সম্ভব হয়নি। ইতোমধ্যেই করোনার টিকা দেয়া শুরু করেছে সরকার। গত দুই মাস যাবত করোনাভাইরাসের কম থাকলেও গত এক সপ্তাহ যাবত তা আবার বাড়ছে। সংক্রমণ না কমলে আগামী রোজার ঈদেও পর ছাড়া শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খুলবে কিনা সন্দেহ আছে। তবে সরকার সব কিছু বিবেচনা করেই সিদ্ধান্ত নেবেন।
বাসস/ইউনিসেফ ফিচার/এসডিজি/মহ/১৯৪০/-কেজিএ