রংপুরে একাত্তরের ২৮ মার্চ থেকে চূড়ান্তভাবে স্বাধীনতা যুদ্ধ শুরু হয়

517

।। প্রকৌশলী মামুন ইসলাম ।।
রংপুর, ১২ মার্চ, ২০২১ (বাসস) : ১৯৭১ সালের উত্তাল মার্চের শুরুতে ৩ মার্চ রংপুরের স্কুলছাত্র শঙ্কু সমাজদারসহ তিনজন বীর সন্তান আবুল কালাম আজাদ ও ওমর আলী অবাঙ্গালী বিহারীদের গুলি ও ছুরিকাঘাতে শহীদ হন। এই খবরে তাৎক্ষণিক ভাবে রংপুর উত্তপ্ত হয়ে উঠে এবং জনগণ চূড়ান্ত স্বাধীনতার জন্য সংগ্রাম শুরু করে।
বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণ অনুযায়ী পাকিস্তানী আর্মির বিরুদ্ধে কঠোর প্রতিরোধ গড়ে তুলতে রংপুরবাসী তৎকালীন আওয়ামী লীগ নেতৃত্ব ও ছাত্র-নেতাদের অধীনে নিজেদের প্রস্তুতি শুরু করে।
সাবেক রংপুর জেলা মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার মোসাদ্দেক হোসেন বাবলু বলেন, ২৫ মার্চ নিরীহ বাঙালিদের ওপর পাকিস্তানি বাহিনীর নৃশংস অভিযান শুরুর তিন দিন পরে ২৮ মার্চ থেকে রংপুরবাসী চূড়ান্তভাবে স্বাধীনতা যুদ্ধ শুরু করে।
বাবলু বলেন, ১৯৭১ সালের ২৮ মার্চ ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে হাজার হাজার বাঙালি রংপুর ক্যান্টনমেন্ট দখলের জন্য ক্যান্টনমেন্ট ঘেরাও করে প্রাণ বিসর্জনের মাধ্যমে নজিরবিহীন দৃষ্টান্ত স্থাপন করে স্বাধীনতা অর্জনের চূড়ান্ত বার্তা ছড়িয়ে দেয়।
মেজর নাসিরউদ্দিনের লেখা ‘যুদ্ধে যুদ্ধে স্বাধীনতা’ এবং প্রয়াত মুক্তিযোদ্ধা মুকুল মোস্তাফিজুর রহমান লিখিত ‘মুক্তিযুদ্ধে রংপুর’ গ্রন্থে ওই দিনের বর্ণনা তুলে ধরে বলা হয়, ক্যান্টনমেন্ট দখলের জন্য ওইদিন হাজার হাজার বাঙালি ক্যান্টনমেন্টের কাছে নিশবেতগঞ্জে সমবেত হয়।
বাঙালি মুসলিম, হিন্দু, বৌদ্ধ, ওঁরাও, সাঁওতাল এবং অন্যান্য ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর লোকরা, দেশীয় অস্ত্র তীর, ধনুক, বর্শা নিয়ে ক্যান্টনমেন্ট দখলের পরিকল্পনা করে বলে এই বইয়ে উল্লেখ করা হয়।
পাকিস্তান আর্মির ২৩তম ব্রিগেড সদরদফতর ছিল রংপুর ক্যান্টনমেন্ট এবং তৃতীয় বেঙ্গল, সিলেটের ২৬তম এফএফ রেজিমেন্ট, ২৩তম ক্যাভালরি রেজিমেন্ট এবং এর সহযোগী বাহিনী ও ২৯তম ট্যাঙ্ক বাহিনী এই কমান্ডের অধীনে ছিল।
২৩তম ব্রিগেড সদর দফতরের ব্রিগেড কমান্ডার ছিলেন পাকিস্তানী ব্রিগেডিয়ার জেনারেল আবদুল্লাহ মালিক এবং বিপুল সংখ্যক পাকিস্তানী সৈন্য ও আধুনিক স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র, আর্টিলারি, ট্যাঙ্ক ও গোলাবারুদে, ক্যান্টনমেন্ট সর্জিত ছিল।
হাজার হাজার সাধারণ মানুষ দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পশ্চিম দিক থেকে ক্যান্টনমেন্টের দিকে অগ্রসর হয়। সেখানে পাকিস্তানী দখলদার বাহিনী গণ হত্যা চালানোর প্রস্তুতি নিচ্ছিলো। পাকিস্তানী আর্মির জীপ থেকে স্বয়ংক্রিয় অস্ত্রের মাধ্যমে ঘেরাওকারিদের ওপর গুলি চালাতে থাকে। পাঁচমিনিট ধরে গুলিবর্ষণে ৬০০ বাঙালির মৃত্যু হয় এবং আরো শত শত আহত হয়।
স্থানীয় অবাঙ্গালী বিহারীদের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষাকারী পাকিস্তানী কর্নেল সগীর পরে বলেছেন, তারা (বাঙালিরা) সকল সীমা অতিক্রম করায় অধীনস্থ কমান্ডকে তিনি উচিত শিক্ষা দেয়ার নির্দেশ দেন এতে অন্তত ৬০০ লোকের মৃত্যু হয়। তিনি মৃত দেহগুলো সংগ্রহের জন্য সৈন্যদেরকে নির্দেশ দেন। এসব শহীদদের মধ্যে এপর্যন্ত প্রায় ৪০০ জনকে শনাক্ত করা গেলেও বাকীদের এখনো শনাক্ত করা যায়নি।
এক পর্যায় এক বিহারি ক্যাপ্টেন নিকটবর্তী ঘাঘট ব্রিজের নিচ থেকে পলায়নরত এক বৃদ্ধ বাঙালিকে ধরে এনে নিজের পিস্তলের গুলিতে হত্যা করে।
কর্নেল সগির ও ক্যাপ্টেন সাজিদ মাহমুদের কমান্ড শহীদ বাঙালিদের বেশিরভাগ মৃতদেহ সংগ্রহ করে পেট্টোল ঢেলে আগুনে পুড়িয়ে দেয় এবং কিছু মৃতদেহ নিশবেতগঞ্জ গণকবরে মাটিচাপা দেয়।
মুক্তিযোদ্ধা আকবর হোসেন জানান, ২৮ মার্চ রংপুর ক্যান্টনমেন্ট ঘেরাওয়ে বীর সন্তানের আত্মত্যাগের পর রংপুরের জনগণ, বাঙালি আর্মি অফিসার, ইপিআর সদস্য, ছাত্র, কৃষক শিক্ষক, যুবক, আইনজীবী, সামাজিক-সাংস্কৃতিক কর্র্মী দেশকে স্বাধীন করার অঙ্গীকার করেন।
এই খবর দ্রুত অন্য সকল এলাকা কুড়িগ্রাম, লালমনিরহাট, গাইবান্ধা, নিলফামারী, ঠাকুরগাঁও, দিনাজপুর, পঞ্চগড় এবং আশপাশের এলাকায় ছড়িয়ে পড়লে হাজার হাজার ছাত্র, যুবক, পুলিশ ও আনসার বাড়ি থেকে পালিয়ে মুক্তিবাহিনীতে যোগ দেয়।
পরে রাজনৈতিক নেতৃত্ব ও ছাত্র নেতারা স্বাধীনতা যুদ্ধ সংগঠনে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন এবং রংপুর অঞ্চলে পাকিস্তানী দখলদার বাহিনীর বিরুদ্ধে প্রচন্ড প্রতিরোধ গড়ে তোলেন।