৭ মার্চের ভাষণ বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক মেধার পরিচয় : শিক্ষাবিদ

760

॥ মলয় কুমার দত্ত ও মহিউদ্দিন মাহী ॥
ঢাকা, ৭ মার্চ, ২০২১ (বাসস) : ১৯৭১ সালের ৭ মার্চের ভাষণে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সঠিক রাজনৈতিক প্রতিভা প্রকাশিত হয়েছে, যাতে তিনি সব প্রয়োজনীয় কথা উচ্চারণ করেন এবং পাকিস্তানি বাহিনিকে ফাঁকি না দিয়ে বুদ্ধিমত্তার সাথে মুক্তিযুদ্ধের তাৎক্ষণিক আক্রমণ শুরুর দিকনির্দেশনা দেন।
জাতীয় অধ্যাপক রফিকুল ইসলাম এক সাক্ষাৎকারে বাসসকে বলেন, ‘বঙ্গবন্ধু ৭ মার্চের ভাষণে সবকথা বলেন এবং কৌশলগতভাবে মুক্তিযুদ্ধের দিকনির্দেশনা দেন কিন্তু সরাসরি স্বাধীনতার ঘোষণা দেননি। সেদিন যদি তিনি সরাসরি স্বাধীনতা ঘোষণা দিতেন তবে একটি গণহত্যা ঘটতে পারত।’
তিনি বলেন, মার্চের ভাষণে তাঁর রাজনৈতিক প্রতিভা, প্রজ্ঞা ও বুদ্ধিমত্তার প্রতিফলন ঘটেছে। কারণ তিনি সরাসরি স্বাধীনতা ঘোষণা না করেই দেশকে মুক্ত করার জন্য সকলকে প্রয়োজনীয় নির্দেশনা দেন। তিনি বলেন, তখন অত্যন্ত কঠোর পরিস্থিতি এবং সঙ্কটজনিত প্রেক্ষাপট ছিল। বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ঐতিহাসিক সমাবেশের আগে ট্যাঙ্ক মোতায়েন করা হয় এবং সামরিক অস্ত্রশস্ত্র¿ জমায়েত করা হয়।
জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী উদযাপন জাতীয় বাস্তবায়ন কমিটির চেয়ারম্যান রফিকুল ইসলাম বলেন, পাকিস্তানের এক জেনারেল তার স্মৃতিচারণমূলক লেখায় বলেন, ‘আমরা সকলেই প্রস্তুত ছিলাম (আক্রমণ চালাতে) তবে শেখ মুজিব সব কিছু বলেছিলেন খুব কৌশলগত উপায়ে। সে জন্য আমরা কিছুই করতে পারিনি।’
রফিকুল ইসলাম বলেন, ‘এটি বঙ্গবন্ধুর বিচক্ষণতা ও নেতৃত্ব। তিনি দেশের স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধের আহ্বান জানান, কিন্তু তা এমনভাবে যাতে পাকিস্তানিরা আক্রমণ চালাতে না পারে।’
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) ইতিহাস বিভাগের সুপারনিউমারি প্রফেসর ড. সৈয়দ আনোয়ার হোসেন বলেন, ‘বঙ্গবন্ধুর যুগান্তকারী ৭ মার্চ ভাষণের আগে কী হতে চলেছে তা নিয়ে গোটা জাতি সন্দিহান ও উদ্বিগ্ন ছিল।’
তিনি বলেন, ‘৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণে বাঙালি জাতি আগামী দিনের জন্য স্পষ্ট নির্দেশনা পেয়েছিল। বঙ্গবন্ধু যদিও একটু ঘুরিয়ে স্বাধীনতার কথা বলেন, কিন্তু তিনি স্পষ্টতই স্বাধীনতার দিকনির্দেশনা দেন।’
বাংলাদেশ প্রফেশনালস ইউনিভার্সিটির (বিইউপি) বঙ্গবন্ধু চেয়ার আনোয়ার হোসেন বলেন, বঙ্গবন্ধু ১৮মিনিট ৩১মিনিটের মধ্যে ১,১০৮ শব্দের সমন্বয়ে তাঁর সংক্ষিপ্ততম, মহত্তম ও অলিখিত ভাষণ দেন। তিনি বলেন, ৭ মার্চের ভাষণ বিশ্বের অন্যতম কালজয়ী ভাষণের মর্যাদা অর্জন করেছে।
তিনি বলেন, ‘তাঁর বক্তৃতা বিদেশিদের কাছেও খুব স্পষ্ট হয়ে উঠেছিল কারণ তাঁর দেহভাষা এবং অঙ্গভঙ্গি বিশেষত তার তর্জনী উঁচানোর ভাষা খুব স্পষ্ট ছিল। সে কারণে ভাষণটি বিশ্বে একটি সম্পদে পরিণত হয়েছে।’
ঢাবির ইংরেজি বিভাগের প্রাক্তন অধ্যাপক সৈয়দ মনজুরুল ইসলামের একটি লেখার কথা উল্লেখ করে আনোয়ার হোসেন বলেন, বিদেশি সাংবাদিক মনজুরুল ইসলামকে বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ বুঝিয়ে দেয়ার জন্য তাকে রেসকোর্সে নিয়ে গিয়েছিলেন। মঞ্চের সামনে সাংবাদিকদের জন্য একটি সংরক্ষিত জায়গা ছিল। ওই সাংবাদিক মনজরুলকে সেখানে নিয়ে যান।
ভাষণের পর মনজুরুল বিদেশি সাংবাদিকটিকে ভাষণের বিবরণ দেওয়ার আগে সাংবাদিক বলেন, ‘আপনার শ্রম বাঁচান। আমি জানি তিনি কী বলেছেন।’ তারপরে তিনি কী বুঝেছেন তা বর্ণনা করলেন। যা মনজুরুলের কাছে মূল ভাষণের খুব কাছাকাছি মনে হয়। মনজুরুল অবাক হয়ে যান। সাংবাদিক হেসে বললেন, ‘এটি ছিল কেবল যাদু।’
মনজুরুলের নিবন্ধে বলা হয়, ‘এটা আসলেই ম্যাজিক ছিল। ইতিহাসে এমন কিছু মুহূর্ত রয়েছে যখন জাদু প্রয়োজন। যখন বাস্তবতা এত জটিল হয়ে যায় এবং পরিস্থিতি এতটাই চরম আকার ধারণ করে যে এই যাদুকরী মুহূর্ত ছাড়া লোকেরা নিজের পায়ে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পারে না।’
বিদেশি সাংবাদিক এবং মনজুরুল আলাদা হয়ে যাওয়ার আগে তিনি সাংবাদিককে জিজ্ঞাসা করেন এরপরে কী হতে পারে বলে তিনি মনে করেন। তিনি এক মুহূর্তের জন্য ভেবে বলেন, ৃপ্রস্তুত হয়ে যাও।’
ঢাবির প্রাক্তন উপাচার্য অধ্যাপক আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক ৭ ই মার্চের ভাষণকে বাংলাদেশের জন্মের প্রাক্কালে বাংলাদেশের জনগণ এবং তাদের অবিসংবাদিত নেতার মধ্যে সংলাপ বলে অভিহিত করেন। তিনি বলেন, ‘বঙ্গবন্ধু ভাষণ দেওয়ার সময় শ্রোতাদের আকৃষ্ট করতে বেশ দক্ষতার সাথে কথোপকথনের স্টাইল গ্রহণ করেন। এক স্বচ্ছ ভাষা ও স্টাইলে দেওয়া এই সাবলীল ও উপস্থিত ভাষণটি আমাদের স্বাধীনতার প্রধান দলিল।’
বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থার (বাসস) পরিচালনা পর্ষদের চেয়ারম্যান প্রফেসর আরেফিন বলেন, শ্রোতাদের সাথে সংযোগের জন্য বঙ্গবন্ধু ‘প্রশ্ন জিজ্ঞাসা, তারপরে উত্তর’ প্রেসক্রিপশনের যথাযথ প্রয়োগের বিভিন্ন পর্যায়ে প্রশ্ন উত্থাপন করেন। তিনি যোগ করেন, বর্তমান কালের যৌক্তিক ব্যবহার বক্তৃতাটিকে সতেজ করে তোলে এবং বঙ্গবন্ধু কথোপকথনের শৈলীর জন্য তাঁর বক্তৃতায় অতীত ও ভবিষ্যৎ কালেরও খুব সুন্দর মিশেল ঘটান।’